আটটা বাজতে দশ মিনিট বাকি, এ-সময় অফিসে দালিয়াকে। পাওয়া যাবে না। পে বুদ থেকে দালিয়াদের ফ্ল্যাটের নম্বরে ডায়াল করল রানা।

হ্যালো? সর্তক কণ্ঠস্বর, যেন খুব ভয়ে ভয়ে আছে।

আওয়াজটা চৌচেন ঝাওয়ের বলে চিনতে পারল রানা। আমি। রায়হান চৌধুরী… শুরু করতে না করতে বাধা পেল ও।

কী বললেন? রায়হান ভাই? রুদ্ধশ্বাসে জিজ্ঞেস করল চৌচেন। এক কি দুসেকেন্ডের বিরতি, তারপরই রানাকে হতভম্ব করে দিয়ে আবার বলল, সরি, রঙ নাম্বার! সঙ্গে সঙ্গে কেটে দিল। লাইন।

তারপরও ক্লিক করে একটা আওয়াজ শুনল রানা। তারমানে। কি আরেকটা রিসিভারে ওদের কথা শুনল দালিয়া? নাকি। দালিয়াদের টেলিফোন লাইনে আড়িপাতা যন্ত্র ফিট করা হয়েছে? অন্তত ওর মনে কোন সন্দেহ নেই যে চৌচেন রিসিভার রেখে দেওয়ার পর আরও একজন কেউ তার রিসিভার নামিয়েছে।

তাড়াতাড়ি যোগাযোগ কেটে দিয়ে বুদের ভিতরই দাঁড়িয়ে থাকল রানা, দ্রুত চিন্তা করছে। চৌচেন ঝাও ওকে চিনতে পেরেছে ঠিকই, তা না হলে ভাই বলত না। তা হলে সরি, রঙ নাম্বার বলার কারণ কী?

নিশ্চয়ই ওরা কোন কঠিন বিপদে পড়েছে। কিংবা পড়তে যাচ্ছে। একটা আশঙ্কার কথা মনে জাগতে বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল রানার।

দালিয়া বেঁচে আছে তো?

রঙ নাম্বার বলার কারণটা পরিষ্কার-চৌচেনের মনে পড়ে গেছে বা সন্দেহ হয়েছে যে ওদের ফোনে কান পেতে আছে কেউ, তাই রানাকে আর কিছু বলতে না দিয়ে যোগাযোগ কেটে দিয়েছে।

যোগাযোগ কেটে দিয়েছে নিশ্চয়ই আবার যোগাযোগ করবে বলে। বিপদ বা রহস্য যাই হোক, সেটা কী জানতে হলে অপেক্ষা করতে হবে রানাকে।

তবে কুবলাই খান হোটেলে নয়।

বুদ থেকে বেরিয়ে এসে এলিভেটরে চড়ল রানা। নিজের রুম থেকে সুটকেস নিয়ে হোটেল ছাড়তে পাঁচ মিনিটের বেশি লাগল না ওর।

আধ মাইলটাক হেঁটে উল্টো দিক থেকে আসা একটা ট্যাক্সি থামাল রানা, মধ্যবয়স্কা ড্রাইভার হোটেল গ্রেটওয়াল-এ পৌঁছে দিল ওকে।

নতুন হোটেলে উঠে নিজের স্যুইট থেকে ওর এজেন্সির বেইজিং শাখার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করল রানা, জরুরি কয়েকটা নির্দেশ দেবে ওদেরকে। ওর কল সরাসরি বুন লি রিসিভ করল। সে-ই বেইজিং শাখার বর্তমান প্রধান।

মাসুদ ভাই! কে ফোন করেছে বুঝতে পেরে আবেগে আর উত্তেজনায় কেঁপে গেল বুন লির কণ্ঠস্বর। আপনিও বেইজিঙে?

সমস্ত ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে উঠল রানার। আমিও বেইজিঙে মানে?

ওহ্, গড! মাসুদ ভাই, আপনি সত্যি কিছু জানেন না? উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে দ্রুত কথা বলে যাচ্ছে বুন। বেইজিংকে এখন আপনি স্পাই নগরী বলতে পারেন। এ তল্লাটের এমন কোন ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ নেই যারা গত এক হপ্তার মধ্যে। নিজেদের লোক পাঠায়নি এখানে। আর ইঙ্গ-মার্কিন এজেন্টদের। কথা কী বলব! সিআইএ আর ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ গিজগিজ করছে…

কেন? শান্ত গাম্ভীর্যের সঙ্গে জানতে চাইল রানা, কী ব্যাপার বলো তো?

এটাই তো সবার মাথা খারাপ করে দিচ্ছে, মাসুদ ভাই! কেউ বলতে পারছে না কী ঘটেছে বা ঘটতে যাচ্ছে। অথচ এদিকে আমরা খবর পাচ্ছি বিগ ব্রাদাররা পর্যন্ত মাঠে নেমে পড়েছে…

মনে মনে একটা ধাক্কা খেল রানা। লিজ-এর মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় ১ জুলাই, ১৯৯৭ সালে হংকং ছেড়ে চলে গেছে ইংরেজরা। তবে অনেক আগেই হংকঙের মাটিতে বিভিন্ন খাতে। নৈতিক অধঃপতনের মারাত্মক বীজ বপন করেছিল তারা, সে-সব এখন বিশাল একেকটি মহীরুহ। মূল ভূখন্ডের সঙ্গে নতুন করে এক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হংকঙের সেই বিষাক্ত বীজের ফলশ্রুতি, অর্থাৎ পশ্চিমা ধাঁচের গ্যাঙস্টাররা নিজেদের পেশিশক্তি নিয়ে ঢুকে পড়েছে সাংহাই আর বেইজিং সহ চিনের সবগুলো বড় শহরে। এই সব মহা প্রতাপশালী গ্যাঙস্টার বা গডফাদারদের বলা হয় বিগ ব্রাদার।

বিগ ব্রাদারদের দমন করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করছে পুলিশ, তবে এখনও ঠিকমত পেরে উঠছে না-নানান ধরনের ছলচাতুরীর মাধ্যমে টিকে আছে তারা মূল ভূখণ্ডে।

বিগ ব্রাদাররা সাধারণত মোটা টাকার গন্ধ না পেলে কোন অপারেশনে আগ্রহ দেখায় না। তবে একবার যদি দেখায়, ওই ব্যাপারটায় আর কারও কিছু করার থাকে না।

বিগ ব্রাদারদের কাজের ধারাই হলো প্রথমে একের পর এক লাশ ফেলে আতঙ্ক সৃষ্টি করা, মাঠে যাতে তারা ছাড়া আর কেউ না থাকে।

আমাদের সোর্স? বুনকে জিজ্ঞেস করল রানা। আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে তারাও কিছু জানাতে পারেনি?

আন্ডারগ্রাউন্ডে শুধু একটা গুজব শোনা যাচ্ছে, যাই ঘটে থাকুক, তার সঙ্গে নাকি মার্কিন দূতাবাস জড়িত।

বুনকে আরও দুএকটা প্রশ্ন করে নিশ্চিত হলো রানা, এব্যাপারে তার কাছ থেকে আর কিছু জানার নেই। তাকে জরুরি কয়েকটা নির্দেশ দিল ও, তারপর বলল, শোনো, বুন, আমার একটা পিস্তল দরকার, কাউকে দিয়ে হোটেলে পাঠিয়ে দাও। আর একটা ফোন নম্বর দিচ্ছি, মুখস্থ করে নাও।

যোগাযোগ কেটে দিয়ে গভীর চিন্তায় ডুবে গেল রানা। দালিয়া মার্কিন দূতাবাসে চাকরি করে। আর আন্ডারগ্রাউন্ডে গুজব ছড়িয়েছে-যাই ঘটে থাকুক, তার সঙ্গে মার্কিন দূতাবাস জড়িত।

এই দুটো তথ্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে টেলিফোনে চৌচেন ঝাওয়ের অদ্ভুত আচরণের একটা তাৎপর্য আছে বলে মনে হয় না?

রানার ধারণা, দালিয়া বা চৌচেন ওর সঙ্গে অবশ্যই যোগাযোগ করবে। তবে সেটা আজ রাতে না হয়ে কাল সকালে হবারই সম্ভাবনা বেশি।

কাজেই, সিদ্ধান্ত নিল ও, বেজিঙের অন্যতম বিগ ব্রাদার হুন। চেননি-র একটা আস্তানায় ঢু মারা যেতে পারে। ভাগ্য ভালো হলে। রানা এজেন্সির সোর্স তুন পানচু-র সঙ্গে ওর দেখাও হয়ে যেতে পারে ওখানে।

চেহারা একটু পাল্টে নিতে আধ ঘণ্টা সময় নিল রানা। সুতি ক্যাপের বাইরে বেরিয়ে থাকা জুলফিতে সামান্য পাক ধরেছে, গোঁফ জোড়া পাকানো, নাকের ডগায় ঝুলে আছে ঢাউস গ্লাস লাগানো চশমা।

একটা ট্যাক্সি নিয়ে বেইজিঙের দক্ষিণ উপকণ্ঠে চলে এল রানা। শহর আর ইন্ডাস্ট্রিয়াল এরিয়ার মাঝখানে জায়গাটার নাম তাইমাই।

হঙকঙ থেকে আসা বিগ ব্রাদাররা তাইমাইকে বেইজিঙের ক্রাইম জোন হিসাবে কুখ্যাত করে তুলেছে। বিশাল এলাকা, ত্রিশ। লাখ লোকের বসবাস। পুলিশকে আমরা সাহায্য করতে চাই, একথা বলে এলাকাটাকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়ে এখানকার। আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে কুখ্যাত পাঁচজন বিগ ব্রাদার।

গুরুতর অপরাধ সারাক্ষণই ঘটছে এখানে, তবে সে-সব। ধামাচাপা দিয়ে পুলিশের ভাবমূর্তি অম্লান রাখতে সম্ভাব্য সব কিছু করছে পাঁচ বিগ ব্রাদার।

গোটা এলাকায় শুধু বৈধ মদের দোকানই আছে হাজার দুয়েক। বলা হয় প্রতিদিন কম করেও দশ হাজার ছদ্মবেশী বেশ্যা। আসা-যাওয়া করে এখানে-এরা আসলে কল-কারখানার শ্রমিক, বিশেষ করে গার্মেন্টস-এর, ছুটি পেলেই উপরি রোজগারের আশায় চলে আসে এদিকে।

আইনের চোখকে ফাঁকি দিয়ে প্রতিদিন আলাদা জায়গায় চোরাই মালের পাইকারী বাজারও বসে, অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের ছড়াছড়ি সেখানে।

আর বসে জুয়ার আসর।

বিশেষ করে ট্যুরিস্টদের কথা মনে রেখে সম্প্রতি ক্যাসিনো খোলার অনুমতি দেওয়া হয়েছে, ফলে তাইমাই এলাকার প্রতিটি হোটেলে জমজমাট জুয়ার আসর বসছে।

এলাকায় ঢোকার আধ ঘণ্টার মধ্যেই রানা এজেন্সির সোর্স বা ইনফর্মার তুন পানচুকে খুঁজে নিল রানা। ছদ্মবেশ থাকায় ওকে প্রথমে চিনতে পারেনি সে, ও-ই কাছে ডেকে পরিচয় দিল।

আপনিও চলে এসেছেন, সার? ছুঁচোর মত চেহারা, রানাকে চিনতে পেরে নিজের টাকে একটা টোকা মারল পানচু। এটা তার একটা মুদ্রাদোষ।

একটা বার-এ বসে মিনিট দশেক কথা বলল ওরা।

না, বিভিন্ন দেশের স্পাইরা কী কারণে রাজধানীতে ভিড় করেছে পানচু তা জানে না। তবে শুনতে পাচ্ছে মার্কিনিদের কিছু একটা নাকি হারিয়ে গেছে।

কী হারিয়েছে? জিজ্ঞেস করল রানা।

চকচকে মাথাটা নাড়ল পানচু। তা কেউ বলতে পারছে না, বলল সে। একটু পর আবার বলল, তবে তিনশো ডলার দামের একটা ইনফরমেশন আছে আমার কাছে।

কী ইনফরমেশন? জানতে চাইল রানা।

কথা না বলে টাকে আরেকটা টোকা মারল পানচু।

মানিব্যাগ বের করে তার হাতে দুটো একশো ডলারের নোট গুঁজে দিল রানা। বলো এবার।

প্রথমে টাকাটা পকেটে ভরল পানচু। তারপর বলল, হংকঙের মিন ভাইরাও এখন বেইজিঙে।

আচ্ছা? শিরদাঁড়া একটু খাড়া হলো রানার। চৌ আর থৌ দুজনই?

টাক চুলকাল অপরাধ জগতের বাসিন্দা পানচু। আমি তো সেরকমই শুনেছি। তবে একা শুধু বড়টাকে দেখেছি, চৌ মিনকে।

উত্তেজনা বোধ করছে রানা, কারন জানে মায়ানমার আর হংকঙের গোপন আস্তানা ছেড়ে মিন ভাইরা সাধারণত বেরোয় না। তাদের মাথায় যত চুল, শত্রুর সংখ্যা তার চেয়ে বেশি হবে তো কম নয়।

তথ্য সওদাগর বলা হয় মিন ভাইদের। তাদের পণ্য হলো এওপিওনাজ জগতের চুরি করা টপ সিক্রেট ইনফরমেশন। গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-প্রমাণ যেমন চড়া দামে কেনে, তেমনি অবিশ্বাস্য। দামে বিক্রিও করে। ওদের বেশিরভাগ তথ্যই মিলিয়ন ডলারের কমে বিকোয় না। সব তথ্য যে কেনে তারা, তা নয়, অনেক সময় চুরিও করে।

ক্রেতার সংখ্যা বেশি দেখলে নিজেদের পণ্য নিলামে তুলে দেয় মিনরা। তাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগটা সবচেয়ে বেশি শোনা যায়-একই তথ্য একাধিক ক্রেতার কাছে বিক্রি করে। তবে রানাকে কখনও ঠকাবার চেষ্টা করেনি তারা। রানা ওদের নাড়িনক্ষত্রের সমস্ত খবর জানে, আর তারাও ওর ক্ষমতা সম্পর্কে। ওয়াকিফহাল-সেটাই বোধহয় কারণ।

কোথায় সে? পানচুর হাতে আরও একটা একশো ডলারের একটা নোট গুজে দিয়ে জানতে চাইল রানা।

আধ ঘণ্টা আগের খবর জানি, বিগ ব্রাদার হুন চেননির নতুন ক্যাসিনোয় বসে তাস খেলছে চৌ মিন, বলে কাঁধ ঝাঁকাল পানচু, টোকাও মারল টাকে। তার চারপাশে হুন চেননির স্পেশাল গার্ডরা যেভাবে দেয়াল তুলে রেখেছে, কাছে ঘেঁষতে পারবেন বলে মনে হয় না। দেখেন!

তাকে টেবিলে বসিয়ে রেখে বার থেকে বেরিয়ে এল রানা। দশ মিনিট এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করে নিশ্চিত হয়ে নিল কেউ ওর পিছু নেয়নি, তারপর কাজ শুরু করল।

হুন চেননির ক্যাসিনোয় ঢুকে চৌ মিনকে খুঁজলই না রানা। মেইন কাউন্টারে এসে একটা কাগজে কিছু লিখল, তারপর সেটা বাড়িয়ে ধরল একজন অ্যাটেনড্যান্টের দিকে, মেয়েটিকে দেখিয়ে কাগজের ভাঁজে একশো ডলারের একটা নোট ঢুকিয়ে দিতে ভোলেনি। এটা এই মুহূর্তে মিস্টার চৌ মিনের কাছে পৌঁছে দিতে হবে, প্লিজ।

রানা লিখেছে, কোন্ স্পর্ধায় গর্ত থেকে বেরিয়েছ, তোমাদের কি মরার ভয় নেই? জিনিসটা কী জানাও আমাকে। আর ক্রেতার তালিকায় আমাকেও যেন রাখা হয়। মাসুদ রানা। মোবাইল নম্বর…।

নাকি সুরে চি-চিঁ করে চৈনিক সুন্দরী বলল, ইউ আর ওয়েলকাম, সার। তারপর ইউনিফর্ম পরা একজন ওয়েটারকে ডেকে কী করতে হবে বুঝিয়ে দিল। কাগজটা নিয়ে এলিভেটরের দিকে ছুটল ওয়েটার।

আট মিনিটের মাথায় ফিরে এল সে, হাতে সেই একই কাগজ, তবে এবার তাতে চৌ মিনের লেখা কয়েকটা লাইন রয়েছে।

রানার প্রশ্নের উত্তরে চোরাই তথ্যের সওদাগর চৌ মিন লিখেছে, আমাদেরকে দাওয়াত দিয়ে আনা হয়েছে, বস্, এখানে আমরা বিগ ব্রাদার হুন চেননির মেহমান। জিনিসটা কী এখনও জানার সুযোগ হয়নি। তবে বলা হচ্ছে কালো একটা নকশা। তালিকায় নাম আছে একুশজনের, আপনার নামটা তিন নম্বরে। রাখতে চেষ্টা করব। চৌ মিন।

<

Super User