পৃথিবীর চারধারের মহাশূন্য অসংখ্য স্যাটেলাইটে বোঝাই হয়ে আছে, গোলকটাকে ঘিরে চক্কর দিচেচ্ছ সবগুলো, প্রতিটি আলাদা কর্ম সম্পাদন ও দায়িত্ব পালন করছে। ওগুলোকে মোটামুটি  পাচভাগে ভাগ করা যায়–কমিউনিকেশনস স্যাটেলাইট, নেভিগেশনাল এইডস স্যাটেলাইট, ইন্টেলিজেন্স-গ্যাদারিং স্যাটেলাইট, মিলিটারি রিকনাইসন্স স্যাটেলাইট আর ওয়েদার স্যাটেলাইট। প্রতিটি স্যাটেলাইটের মালিক নির্দিষ্ট কোন রাষ্ট্র, তবে কিছু কিছু করপোরেশনেরও নিজস্ব স্যাটেলাইট আছে। এ-সব করপোরেশন নানা দিক থেকে একটা রাষ্ট্রের চেয়েও বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে।

দুনিয়ার ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সমস্ত খবর প্রচার নির্ভর করে কমিউনিকেশন স্যাটেলাইটের ওপর, ওগুলো ছাড়া আধুনিক সভ্যতা পঙ্গ হয়ে পড়বে। সারা দুনিয়া জুড়ে টেলিফোন, রেডিও আর টেলিভিশন লিঙ্ক-আপ করা সম্ভব হচ্ছে এই কমিউনিকেশন স্যাটেলাইটের কল্যাণেই। পঞ্চাশ আর ষাটের দশকে প্রথম এক ঝাক স্যাটেলাইট মহাশূন্যে পাঠানো হয়, তখন থেকে যাত্রা শুরু করে ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন স্যাটেলাইট অর্গানাইজেশন। অনেক কঠিন পথ পাড়ি দিয়েছে, আজ তারা গোটা দুনিয়ার মানুষকে কাছাকাছি নিয়ে আসতে পারার গর্বে গবির্ত। স্যাটেলাইট না থাকলে টেলিভিশনে গালফ ওঅর সরাসরি দেখা যেত না, দেখা যেত না বিশ্বকাপের লাইভ খেলাগুলো, গতকালের খবর গতকালের খবর হিসেবেই পরিবেশিত হত।

গত ত্রিশ বছরে কমিউনিকেশন টেকনোলজির উন্নতি দুনিয়ার রাজনৈতিক পরিস্থিতিও বদলে দিয়েছে। স্যাটেলাইটের কল্যাণে এক দেশের লোক আরেক দেশের শিল্প-সংস্কৃতি সম্পর্কে খুঁটিনাটি সব কিছু জানতে পারছে। সমস্ত পাচিল ভেঙে পড়েছে, অপসারিত হয়েছে কঠিন সব বাধা। স্যাটেলাইট না থাকলে এখনও অন্য কোন দেশের সামরিক শক্তিকে ভয় পেত মানুষ, সেই দেশের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সম্পর্কে সংশয়ে ভুগত।

এ-ধরনের বেশ কিছু কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট রয়েছে এফএমজিএন-এর হাতে। এফএমজিএন মানে হলো ফাউলার মিডিয়া গ্রুপ নেটওঅর্ক। এফএমজিএন দুনিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম নিউজ অর্গানাইজেশন, সিএনএন-কে যদি প্রথম ধরা হয়। দুনিয়ার শিক্ষিত প্রায় সব মানুষই এফএমজিএন সম্পর্কে জানে, কারণ অন্য যে-কোন নেটওঅর্কের চেয়ে দ্রুত খবর পরিবেশন করতে পারে তারা। তাদের জনপ্রিয় শ্লোগান হলো, কালকের আগাম খবর। দুনিয়ার এমন কোন প্রান্ত নেই যেখানে এফএমজিএন উপস্থিত নয়। এমন কি, পশ্চিমা জগৎকে ভাল চোখে দেখে না এমন মানুষও এফএমজিএন ক্যামেরা দেখতে পেলে হাসি মুখে ছুটে আসে।

এই মুহুর্তে এফএমজিএন-এর একটা কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মাথায় রয়েছে, অবলোকন করছে চীন উপকূলে জমে ওঠা একটা নাটক। দক্ষিণ চীন সাগরের মাথায় মেঘের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে চাঁদ, স্নান জোছনা আর গাঢ় ছায়ায় ভৌতিক একটা পরিবেশ তৈরি হয়েছে, ফলে প্রতিটি জিনিস থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে তার নিজস্ব  রং।

এইচএমএস নটিংহাম হলো টাইপ টোয়েনটি স্ত্রী ডিউক ক্লাস ফ্ৰিগেট, রুটিন পেট্ৰলে বেরিয়ে ফিলিপাইন থেকে হঙকঙ যাচ্ছে, এই সময় এক জোড়া চীনা মিগ-টোয়েনটিওয়ান জাহাজটার ওপর দিয়ে উড়ে গেল, অ্যান্টেনা আর মাস্তুল প্রায় ছুয়ে দিয়ে। উস্কানিমূলক আচরণ, সন্দেহ নেই। আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। তারচেয়েও বিস্ময়কর ও হতবুদ্ধিকর হয়ে উঠল চীনাদের কথাবার্তা। তারা বলছে, এইচএমএস নটিংহাম নাকি চীনা জলসীমার ভেতরে রয়েছে।

নটিংহামের ক্যাপটেন কমান্ডার জন ফার্মোস। ঝড়ের বেগে ব্রিজে ঢুকলেন। ফাস্ট অফিসার লেফটেন্যান্ট কমান্ডার নাথান মস বলে উঠলেন, স্যার, ওরা কি পাগল হয়েছে? বলে কিনা আমরা নাকি চীনা জলসীমায় রয়েছি!

অসম্ভব, তা কি করে হয়! চীনা সমুদ্রসীমা থেকে অনেক দূরে রয়েছি আমরা। শয়তানি করলে আলাদা কথা। তা না হলে হিসাবে কোথাও ভুল করছে ওরা।

সাগরে চলাচল করছে এমন সব জাহাজকে দিক নির্দেশনা দেয় আরেক ধরনের স্যাটেলাইট। বছর দুই আগে গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম সহ মহাশূন্যে পাঠানো এক ঝাক এনএভিএসটিএআর স্যাটেলাইট সময় আর অবস্থান জানিয়ে মেসেজ প্রচার করছে বিরতিহীন। পৃথিবীর চারপাশে এ ধরনের বাইশটা স্যাটেলাইট কাজ করছে, এবং পজিশন সম্পর্কে ওগুলোর দেয়া হিসাব সামরিক ক্ষেত্রে মাত্র কয়েক ফুট এদিক-ওদিক হতে পারে, বেসামরিক ক্ষেত্রে তিনশো ফুটের বেশি নয়। জাহাজের ম্যাপে নটিংহামের যে পজিশন দেখা যাচ্ছে তা এনএভিএসটিএআর স্যাটেলাইট সিগনাল থেকে পাওয়া, কাজেই ভুল হবার কোন কারণই নেই।

হেলমসম্যান চীনাদের আরও একটা মেসেজ ধরিয়ে দিল ক্যাপটেন জন ফার্মোসের হাতে। মেসেজটা পড়ে মুখ তুললেন তিনি। ওরা দেখছি সত্যি পাগল হয়ে গেছে! বলছে ওদের সঙ্গে কাছাকাছি চীনা বন্দরে যেতে হবে, তা না হলে আমরা যেন যে কোন পরিস্থিতির জন্যে তৈরি থাকি!

ফাস্ট অফিসার নাথান মস একটা বোতামে চাপ দিলেন, গোটা জাহাজে সতর্ক-ঘণ্টা বেজে উঠল। অ্যাকশন স্টেশনস, স্যার, ক্যাপটেনকে রিপোর্ট করলেন তিনি।

ইন্টারকমে রেডিও অপারেটরকে নির্দেশ দিলেন ক্যাপটেন ফার্মোস, চীনা কর্তৃপক্ষকে জানাও, এটা ব্রিটিশ ফ্রিগেট নটিংহাম। আপনারা যে পজিশনের কথা উল্লেখ করছেন আমরা সেখানে নেই। আপনাদের উপকূল থেকে পঁচাত্তর মাইল দূরে, আন্তর্জাতিক জল-সীমায় রয়েছি আমরা। আমরা কোন চাইনীজ বন্দরে যাব না। আপনারা আন্তর্জাতিক আইন লংঘন করছেন

ইয়েস স্যার।

ফোন তুলে অপারেশনস রূমের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন ক্যাপটেন। আমাদের পজিশন সম্পর্কে আমরা পুরোপুরি নিশ্চিত তো?

প্রিন্সিপাল ওঅরফেয়ার অফিসার একটা ডিসপ্লে চেক করলেন। তাতে ওয়াইড, মিডিয়াম আর ক্লোজ-আপে, অর্থাৎ তিনভাবে স্যাটেলাইট ফিক্স দেখানো হয়েছে। ইয়েস, স্যার, জবাব দিলেন তিনি। স্যাটেলাইট ফিক্সে কোন গলদ নেই।

ফার্মোস বিড়বিড় করছেন, স্পৰ্ধা বলিহারি! চীনা পোর্টে যেতে হবে, হুহ! হঙকঙ ফিরে পাবার পর নিজেদেরকে এই এলাকার মালিক মনে করছে ওরা। অত্যন্ত শক্ত ধাতুতে গড়া মানুষ তিনি, অন্যায়ের কাছে নতি স্বীকার করা তার স্বভাব নয়।

কিন্তু চীনা মিগ দুটো আবার নটিংহামের ওপর দিয়ে উড়ে গেল। পাইলটরা তাদের বেস থেকে নির্দেশ পাচ্ছে। তারা ভাবছে, ব্রিটিশরা তো তাদের অভিযোগ অস্বীকার করবেই–চীনা জলসীমায় চুপিচুপি ঢুকে ধরা পড়ে গেছে যে! কোন সন্দেহ নেই নটিংহাম স্পাই মিশন নিয়ে এসেছে।

নটিংহামের ব্রিজে হেলমসম্যান ক্যাপটেনকে জানাল, স্যার, চীনা সিগন্যাল বলছে, ওদের পাইলটরা নিশ্চিত হয়েই রিপোর্ট করছে।

পুরোপুরি হতাশ ক্যাপটেন ফার্মোস বললেন, মেসেজ পাঠান আমরা আন্তর্জাতিক জলসীমায় রয়েছি, আক্রান্ত হলে ।নিজেদেরকে রক্ষা করব। সমস্ত সিগনালের কপি পাঠান অ্যাডমিরাটিতে। আর্জেন্ট।

ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ ফুল স্পীডে। ছুটছে, কেউ লক্ষ করল না গাঢ় ছায়া রঙের একটা অদ্ভুত আকৃতি অনুসরণ করছে ওটাকে। অবশ্য সচেতন করা হলেও কেউ ওটাকে দেখতে পেত না, কারণ সর্বশেষ টেকনলজির বদৌলতে এই জলযান রেডারে ধরা পড়বে না। একজোড়া খোল, বিশাল পনটুন আর মসৃণ তল রয়েছে ওটার, প্রতিটি ইঞ্চি কালো রঙ করা দেখে মনে হবে সাগরের গহীন থেকে উঠে আসা কোন আজব প্রাণী, সুযোগের অপেক্ষায় ওত পেতে আছে, ইচ্ছে হলেই হামলা করে বসবে। জলযানটার ভারী শরীর পানির খুব কাছাকাছি ঝুলে আছে একজোড়া পনটুনের ওপর ভর দিয়ে। দুই পনটুনের মাঝখানে ফাঁক রয়েছে, ফাঁকের মাথায় ছাদ বলা যায় জাহাজের তলাটাকে, ছোট  আকারের জলযান ভেতরে ঢুকতে বা ভেতর থেকে বেরুতে পারবে অনায়াসে।

আকারে বিশাল হলেও, খুব বেশি উঁচু না হওয়ায় শত্রুপক্ষের রেডারে ওটার ধরা পড়ার আশঙ্কা এমনিতেও কম, তার ওপর সারফেস বা বাইরের আবরণ রেডার-ওপেক পদার্থ দিয়ে তৈরি করা  হয়েছে, তার ওপর গোটা জলযানের গায়ে রেডার অ্যাবজরবিং ম্যাটিরিয়াল এর প্রলেপ দেয়া হয়েছে। জাহাজের খোলে কোন ফাঁক বা ফাটল না থাকলে হাই-ফ্রিকোয়েন্সী রেডিও পালস গায়ে লাগলেও তা ফেরত যাবে না।

জাহাজটার ঝুলন্ত শরীরের নিচে, দুই পনটুনের মাঝখানের ফাঁকে, একটা  দরজা খুলে গেল। দোরগোড়া থেকে পানিতে নামানো হলো একটা ডিভাইস, নাম দেয়া হয়েছে উকি। পানিতে ডুব দেয়ার পর ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ নটিংহামের দিকে দ্রুত এগোল উকি। আকারে জেট এঞ্জিনের মত, ওটা। একটা ড্রিলিং মেশিন; দাঁত হিসেবে আছে এক সেট চকচকে রোটারি কাটার, আর চোখ হিসেবে আছে ভিডিও ক্যামেরা। কাটারগুলো তিনটে ইন্টারলকিং হেড, গিয়ার পদ্ধতিতে কাজ  করে। পিছন দিকে ডাইরেকশনাল নজল থেকে পানি বেরুচ্ছে, ওগুলোকে সচল রেখেছে মেশিনটার মাঝখানে বসানো টারবাইন। আধুনিক টর্পেডোর মত প্রোবিং মেশিনও ওয়ায়্যার-গাইডেড। যে-কোন জলযান ভেদ করে ভেতরের ছবি পাঠানোই ওটার কাজ। খায়রুল কবির, একজন বাঙালী, ওটার উদ্ভাবক, সেজন্যেই নামটাও দেয়া হয়েছে বাংলা।

মাদারশিপে বসে একজন জার্মান, ডিক মেনাচিম, উকিকে জ্যান্ত হয়ে উঠতে দেখল মনিটরে। ব্রিটিশ জাহাজের দিকে এগোচ্ছে উকি, পিছনে কুণ্ডলী ছাড়াচ্ছে তার। সব কিছু ঠিকঠাক মত চলছে, কাজেই মেনাচিম খুব খুশি। এই কাজটায় যদি সফলতা আসে, মোটা বোনাস পাওনা হবে তার, সঙ্গে জুটবে এমন একটা সাবজেক্ট, যে সাবজেক্টকে নিয়ে আরও একটা কুখ্যাত ভিডিও ফিন্ম তৈরি করতে পারবে সে। তার এই ভিডিওটেপগুলো বস খুব পছন্দ করেন। ভিয়েতনামী মেয়েটাকে নিয়ে সর্বশেষ যেটা বানিয়েছে সেটাকে ক্লাসিক বলতে হবে। ভায়োলেন্ট পর্ণোগ্রাফীর স্তরে পড়ে যায়, তাই ওগুলো বাজারজাত করা যায় না, সেজন্যে দুঃখের সীমা নেই মেনাচিমের। ভিডিওতে যা-ই সে রেকর্ড করে, শেষ দিকটা কিভাবে যেন বড় বেশি বীভৎস হয়ে ওঠে।

পয়ত্রিশ বছর বয়েস তার, দেখতে সুন্দর ও সুঠাম স্বাস্থ্যের অধিকারী হলেও চেহারায় ভারসাম্যহীন কি যেন একটা আছে; বিশেষ করে অন্তর্ভেদী নীল চোখ থেকে বিছুরিত চকচকে একটা ভাব ইঙ্গিত দেয় তার মাথার অন্তত একটা স্ক্রু নিশ্চয়ই টিলে।

মেনাচিম ভাবছে, বসকে বলে মাদারশিপ সী ঈল-এর  ক্যাপটেনকে বদলাতে হবে। লোকটা বড় বেশি নার্ভাস। ভয় ডরহীন আত্মবিশ্বাসী লোক পছন্দ করে সে। কন্ট্রোল থেকে বারবার ঘাড় ফিরিয়ে তার দিকে তাকাচ্ছে ক্যাপটেন, সম্ভবত ভয় পাচ্ছে। ভুল-ভাল করলে মেনাচিম তার মাথার পিছনে গুলি করবে। সে অবশ্য জানে যে সবাই তাকে ভয় পায়। স্ক্রুদের মধ্যে চীনা, জার্মান আর ভিয়েতনামীরা আছে, তার প্রতিটি নির্দেশ তারা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে।

নিষ্ঠুর বলে কুখ্যাতি থাকায় মেনাচিম নিজের ওপর খুশি। এই কুখ্যাতি অর্জন করার জন্যে তাকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। এক বন্ধুকে টুকরো টুকরো করে কাটার অভিযোগে প্রথমে তার আট বছরের জেল হয়। প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী না থাকায় সেবার মৃত্যুদণ্ড থেকে বেঁচে যায় সে। জেলে থাকতেই একটা রেপ কেসে আরও বিশ বছরের জেল দেয়া হয় তাকে। বস কৌশলে ছাড়িয়ে না আনলে আজও ঘানি টানতে হত । মুক্তি পাবার পরও নিজেকে সংশোধন করেনি সে। মারপিট করতে এখনও তার ভাল লাগে। শুধু ব্যথা দিতে নয়, পেতেও ভালবাসে সে; ব্যথা তার কাছে  কষ্টকর নয়, আনন্দময় অভিজ্ঞতা।

নটিংহামের অপারেশনস রূমে লোকজন ছুটোছুটি শুরু করেছে। প্রোবিং মেশিন উকিকে তারা রেডারে দেখতে পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু চিনতে ভুল করছে। স্যার! কামরার ভেতর কমান্ডার।

ফার্মোস আর লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মস ঢুকতেই চেঁচিয়ে উঠল লিডিং সীম্যান। টর্পেডো বেয়ারিং ওয়ান ওয়ান ফোর, রেঞ্জ এইট থাউজেন্ড।

ফার্মোস সাড়া দিলেন, অলটার টু ওয়ান ওয়ান ফোর। হতভম্ব পিডব্লিউও রেডারে তাকিয়ে আছে। সারফেসে কিছুই নেই, স্যার। কথাটা সত্যি, জাহাজটার কয়েক মাইলের মধ্যে কিছু নেই, অন্তত স্ক্যানার একদম খালি।

মস বললেন, নিশ্চয়ই মিগগুলো ওটাকে ফেলে গেছে।

নটিংহাম তীক্ষ একটা ঝাক নিল, বাক ঘুরে প্রোবিং মেশিন উকিও পিছু নিল আবার। দ্রুত কাছে চলে আসছে ওটা।

লিডিং সীম্যান রিপোর্ট করল, টর্পেডোও আমাদের সঙ্গে কোর্স বদল করেছে!

পিডব্লিউও চেঁচিয়ে উঠল, সংঘর্ষের জন্যে তৈরি হন!

দম বন্ধ করল সবাই।

উকির প্রচণ্ড ওঁতো খেয়ে গোটা নটিংহাম কেঁপে উঠল। নিচের জেনারেটর রূমে এঞ্জিনিয়াররা ছিটকে পড়লেন মেঝেতে। ওপর দিকে তাকিয়ে একদিকের দেয়াল কাপতে দেখলেন তারা। সেখানে একটা বৃত্ত তৈরি হলো। বৃত্তের মাঝখান থেকে বাস্প বেরুচ্ছে। পরমুহুর্তে ভেতরে ঢুকল উকি, বিস্ফোরিত বিপুল জলরাশি নিয়ে।

মেইন পাওয়ার সাপ্লাই বন্ধ হয়ে গেল, জ্বলে উঠল ইমার্জেন্সী লাইট। মস রিপোর্ট করলেন, জেনারেটরগুলো ডুবে গেছে, স্যার। সি-ডেকে পানি ঢুকছে।

আমাদের স্টার্নও ডুবে গেছে, স্যার, যোগ করল লিডিং সীম্যান।

পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্যে গোটা জাহাজ জ্যান্ত হয়ে উঠল। নাবিকরা মেস কাম থেকে ইকুইপমেন্ট বের করছে, বাকি সবাই ছুটছে অ্যাকশন স্টেশনে। তবে এরপর মেস রূমই অদৃশ্য হয়ে গেল, কারণ প্রোবিং মেশিন উঁকি মেঝে ফুড়ে উঠে এল ওপরে, সঙ্গে মোটা থামের মত পানির উচ্ছাস নিয়ে।

ওপরের বি ডেকে নাবিকরা ওয়াটারটাইট হ্যাচ বন্ধ করার জন্যে ছুটল। বাকি সবাই মই বেয়ে ওপরে উঠে এল, পিছু ধাওয়া করেছে পানির পাচিল। দেরি করে ফেলেছে ওরা।বিপুল জলরাশি গ্রাস করে ফেলল, সঙ্গে করে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

সী ঈলের ব্রিজ থেকে সবই দেখছে ডিক মেনাচিম, বত্রিশ পাটি দাত বের করে হাসছে আপন মনে। ইতোমধ্যে আবার ফিরে আসছে চীনা মিগ দুটো। সঠিক পজিশনে আসবে ওগুলো, তার জন্যে অপেক্ষায় থাকল সে। তারপর চিৎকার করে নির্দেশ দিল, ফায়ার নাম্বার ওয়ান! ফায়ার নাম্বার টু! ছোট এক জোড়া হিট সীকিং মিসাইল সী ঈলের ডেক থেকে আকাশে উঠল, প্লেন দুটোর দিকে ছুটে যাচ্ছে।

কানে মিসাইল লক অ্যালার্মের আওয়াজ পেতেই চীনা পাইলটরা একটা রেডিও মেসেজ পাঠাল বেসে। তারা তাদের পুেনগুলোকে নিয়ে বিপদ এড়াবার যথাসাধ্য চেষ্টা করল, কিন্তু কোন লাভ হলো না, হিট-সীকিং মিসাইল সরাসরি এঞ্জিনে আঘাত করল। মিগ দুটো বিস্ফোরিত হলো শূন্যে, একজোড়া আগুনের গোলা নেমে এল অন্ধকার সাগরে।

ওদিকে নটিংহামের প্রোপালশন সিস্টেম ডুবে গেছে, এঞ্জিনরুম থেকে কোন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না, জাহাজের স্টার্নও ডুবে গেছে চোদ্দ ডিগ্রীর মত। সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্যে কমান্ডার ফার্মোস সময় পেলেন মাত্র দুই সেকেন্ড। ঠিক আছে, জাহাজ ত্যাগ করার নির্দেশ দিলাম, বললেন তিনি। তারপর হেলমসম্যানকে বললেন, অ্যাডমিরান্টিতে এই মেসেজটা পাঠাও–চীনা মিগের নিক্ষিপ্ত টর্পেডোর আঘাতে ডুবে যাচ্ছি। আমাদের পজিশন জানাবে।

মাথা ঝাকিয়ে মেসেজ পাঠাতে শুরু করল হেলমসম্যান। মস চেঁচিয়ে উঠলেন,  আমরা তলিয়ে যাচ্ছি, স্যার!

এবার ইমার্জেসী লাইটও নিভে গেল।

পানির নিচে তলিয়ে যাচ্ছে নটিংহামের পিছন দিকটা। ফলে পানি থেকে ওপর দিকে উঠছে বো। লাইফজ্যাকেট পরা লোকজন ঠাণ্ডা পানিতে লাফ দিচ্ছে। লাইফ র্যাফট অ্যাকটিভেট করার সময় নেই হাতে। কারও ধারণাই ছিল না, কোন জাহাজ এত দ্রুত ডুবতে পারে।

যতক্ষণ পারা যায় জাহাজ খালি করার কাজটা চাক্ষুষ করলেন কমান্ডার ফার্মোস, তারপর স্ট্র্যাপ দিয়ে একটা লাইফজ্যাকেট বেধে তিনিও লাফ দিলেন পানিতে। পাচ মিনিট পর সারফেসে তেলতেলা একটা ভাব আর রয়্যাল নেভীর নাবিকদের ছোট্ট একটা গ্রুপ ছাড়া আর কিছু থাকল না। জানামতে জমিন বা তীর থেকে অনেক দূরে রয়েছে তারা। আশপাশে আর কোন জাহাজও নেই, কাজেই মৃত্যু প্ৰায় অবধারিত। চাদের ম্লান আলো দৃশ্য ও পরিবেশটাকে আরও করণ করে তুলল।

তারপর যখন কালো ছায়াটা তাদের মাথার ওপর চলে এল, ঢেকে দিল চাঁদটাকে, বিহবল ও হতচকিত হয়ে পড়ল সবাই, জানে না কি ঘটছে। চোখ তুলে বিশাল কালো কাঠামোটা দেখে নিঃশ্বাস ফেলতেও ভুলে গেল। সী ঈল এগিয়ে এসে এমন একটা পজিশন নিল, নাবিকরা যাতে দুই পনটুনের মাঝখানে থাকে।

সী ঈলের পোর্টসাইড পনটুনে চলে এল মেনাচিম, বড় আকৃতির একটা বেস্টফেড মেশিন গানের ব্ৰীচ টানল অভ্যস্ত হাতে। পাশে দাঁড়িয়ে আছে একজন স্ক্রু, হাতে একটা ক্যামকর্ডার। ট্রিগার টানার আগে সামনের পানিতে তাকিয়ে দৃশ্যটা উপভোগ করল মেনাচিম, খুনের নেশায় চকচক করছে চোখ দুটো। ফায়ার ওপেন করল সে, মাজল ঘুরিয়ে সী ঈলের সামনের পুরোটা অংশ কাভার করল। নিষ্ঠুর এই হত্যাকাণ্ড ক্যামকর্ডারের মাধ্যমে ভিডিওটেপে ধারণ করা হলো।

বুলেটে ঝাঁঝরা লাশগুলো সাগরের তলায় যদি নামত, তাহলে ছয়জন ডাইভারকে পাশ কাটাতে হত। সী ঈলের খোল থেকে বেরিয়ে এসেছে তারা, সঙ্গে নানা ধরনের যন্ত্রপাতি আর টর্চ। একজনের হাতে রয়েছে আন্ডারওয়াটার ভিডিও ক্যামেরা। একজন বাদে কারও কাছে কোন অস্ত্র নেই।

উকির তার অনুসরণ করে নটিংহামের কাছে পৌছে গেল ডাইভাররা। সাগরের মেঝেতে, গভীর একটা ফাটলের কাছে, স্থির হয়ে আছে ওটা। বিশাল কাঠামোর কোথাও কোন আলো বা প্ৰাণের ইঙ্গিত নেই। একজনের পিছনে আরেকজন, গর্তের ভেতর দিয়ে নটিংহামের খোলে ঢুকল তারা, এখনও উকির তার অনুসরণ করছে। আবর্জনা আর ধ্বংসস্তুপের ভেতর দিয়ে এগোল, তারপর লীডারের ইশারায় স্থির হলো। ইঙ্গিতে একটা দরজা দেখাল সে। ভেতরে বড় একটা কামরা। বড় আকৃতির, লম্বা কি যেন সব রয়েছে। ভেতরে ঢুকে ওগুলোর গায়ে টর্চের আলো ফেলল লীডার। মাথা ঝাকাল সে, কাজ শুরু করার নির্দেশ দিল সঙ্গীদের।

একজন ডাইভার একটা অ্যাসেটিলিন টর্চ অন করে লঞ্চ  প্যাডে কাজ শুরু করল, ক্ল্যাম্পগুলো গলিয়ে ফেলছে। ক্ল্যাম্পগুলো লঞ্চ প্যাডের সঙ্গে আটকে রেখেছে সাতটা সারফেস-টু-সারফেস এজ মিসাইল।

কাজটা শেষ হতে পনেরো মিনিট লাগল। নটিংহাম থেকে বেরিয়ে এসে সী ঈলে ঢুকে পড়ল ডাইভাররা। সঙ্গে করে নিয়ে এল একটা ক্রুজ মিসাইল। প্রোবিং মেশিন উকির তার টান টান হয়ে উঠল, সেটাও ধীরে ধীরে বেরিয়ে এল নটিংহাম থেকে। ফাউলার মিডিয়া গ্রুপ নেটওঅর্ক তার পূর্ব গোলার্ধের হেডকোয়ার্টার বানিয়েছে  ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায়, সাতানব্বুইয়ের পয়লা  জুলাইয়ে। হঙকঙ চীনাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবার পর। তবে পশ্চিম গোলার্ধের জন্যে নতুন একটা হেডকোয়ার্টার খোলা হয়েছে জার্মানীর হামবুর্গে।

হামবুর্গের এফএমজিএন কমপ্লেক্স জনসাধারণের জন্যে এখনও খোলা হয়নি। সাড়ম্বর শুভ  উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হবে কাল সন্ধ্যায়। ফিতে কাটা উপলক্ষে বিরাট পার্টি দেয়া হবে, প্রস্তুতি নিতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা। দুনিয়ার সমস্ত নামকরা প্রচার মাধ্যম তাদের প্রতিনিধি পাঠাবে, উপস্থিত থাকবেন বিশ্ব বিখ্যাত সব ব্যক্তিরা। মেঝে এখনও পালিশ করা হচ্ছে, শুকানো হচ্ছে রঙ। রান্নাবান্নার আয়োজন চলছে, শুরু হয়ে গেছে। ফার্নিচার সাজানোর কাজ। অনুষ্ঠানটা সবার জন্যেই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ অর্ধচন্দ্র আকৃতির ভবনের ভেতর রয়েছে দুনিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম মিডিয়া কমপ্লেক্স, মাকড়সার জালের মত গোটা দুনিয়াকে ঘিরে  রাখা ফাউলার কমিউনিকেশন নেটওঅর্কের হৃৎপিণ্ড ও  মস্তিষ্ক।

মাঝরাতের পর বেশিরভাগ কর্মচারী বাড়ি ফিরে গেল। বিল্ডিঙের বিভিন্ন অংশে অল্প কিছু লোক থাকলেও, তারা নিজেদের কাজে এত ব্যস্ত যে অন্য কোন দিকে খেয়াল নেই। বিশাল ও গোলাকৃতি কন্ট্রোল রুমে এখনও যে দুজন লোক আছে, তারা তা জানে না। কমপ্লেক্সের শোপীস বলা চলে কন্ট্রোল রুমটাকে। নিউজরুমের বেশিরভাগই অন্ধকার, শুধু একজোড়া কনসোলে আলো জ্বলছে। কামরার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত একটা ফিতে খুলছে, কাল সন্ধ্যায় কয়েকশো আমন্ত্ৰিত অতিথির সামনে জন ম্যাডক ফাউলার ওটা কেটে নতুন হেডকোয়ার্টার

উদ্বোধন করবে।

ম্যাডক ফাউলার সারাদিন পরিশ্রম করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। কাউকে দায়িত্ব দিয়ে স্বস্তিবোধ করে না, ফলে প্রতিটি কাজের অগ্রগতি তার নিজেকে গিয়ে দেখে আসতে হয়। এই মুহুর্তে একটা কনসোলের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে। যতই ক্লান্ত হোক, সামনের মনিটর তাকে পুরোপুরি সজাগ ও ব্যাকুল করে তুলেছে।

খায়রুল কবির আপাতত তার বেতনভুক কর্মচারী, তবে তথ্যটা আর সবার কাছে গোপন রাখা হয়েছে। কনসোলে বসে কন্ট্রোল নাড়াচাড়া করছে সে। ফাউলার জানে, খায়রুল কবির দুনিয়ার সবচেয়ে সফল টেকনো-টেরোরিস্ট। ইলেকট্রনিক্সের দ্বারা সম্ভব যা কিছু আছে সব সে করতে পারে। ফাউলার খুশি হত কবিরকে এফএমজিএন-এর বৈধ কাজে লাগাতে পারলে, কিন্তু তার ক্রিমিনাল রেকর্ডের জন্যে তা কখনও সম্ভব নয়। সেজন্যেই তাকে নেপথ্যে রাখতে বাধ্য হয়েছে সে।

ফাউলার দীর্ঘদেহীব্যক্তিত্বসম্পন্ন চেহারা। গত মাসে পঞ্চাশে পড়েছে, স্বাস্থ্য এখনও সবল। হাবভাব আর চালচলনে কর্তৃত্ব আর আভিজাত্য প্রকাশ পায়। কাঠামোটা ভুল নয়, চুল সরতে শুরু করায় কপালটা বড় হয়ে উঠছে। ব্যক্তিত্বে এক ধরনের জাদু আছে, আশপাশের মানুষকে সম্মোহিত করে ফেলে। যখন কথা বলে, শুনতে বাধ্য হয়। সবাই। পৌরুষদীপ্ত ভরাট কণ্ঠস্বর, তবে সুরটা মোলায়েম। প্রথম জীবনে উপস্থাপকের কাজ করেছে টেলিভিশনে, তখনই মিডিয়া কমিউনিকেশন সম্পর্কে তার আগ্রহ জন্মে, তার মাত্র তিরিশ বছর পর বিশাল এক সাম্রাজ্যের মালিক বনে গেছে। বালজাক যেমন বলে গেছেন, বিহাইন্ড এভরি ফরচুন দেয়ার ইজ আ ক্রাইম, কথাটা ফাউলারের ক্ষেত্রেও সত্যি। ভদ্রলোক এক ইংরেজ লর্ডের অবৈধ সন্তান, মা জার্মান পতিতা। তার জন্ম হয় হঙকঙে। অবৈধ সস্তান হওয়ায় স্বভাবতই উত্তরাধিকার সূত্রে লর্ডের বিষয়সম্পত্তির কিছুই তার পাবার কথা নয়, পায়ওনি। তবে জ্ঞান হবার পর ফাউলার শপথ করে, লর্ডের সমস্ত সয়-সম্পত্তি একদিন না একদিন সে দখল করে নেবে। যা সে আইনের সাহায্যে পায় না, তা সংগ্রহ করেছে কৌশল, বুদ্ধি আর নিষ্ঠুরতা প্রয়োগ করে। ত্রিশ বছর বয়েসে পিতা লর্ডের সঙ্গে দেখা করে সে। ছেলেকে সামাজিকভাবে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করলেও, লর্ড ওয়েনডেল নিজের দৈনিক পত্রিকায় একটা এডিটোরিয়াল পোস্টে চাকরি দিতে রাজি হন। সুই হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরুবার পরিকল্পনা পাকা করে ফেলে ফাউলার। সে যে ওয়েনডেলের সস্তান, কথাটা যতভাবে সম্ভব প্রচার শুরু করে, সেই সঙ্গে পত্রিকার নীতিতে আনে। মৌলিক পরিবর্তন। এ নিয়ে লর্ডের সঙ্গে তার বিরোধ বাধলেও পত্রিকার প্রচার সংখ্যা দিনে দিনে বাড়তে থাকায় ওয়েনডেল কোণঠাসা হয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে অবসর নিতে বাধ্য হন তিনি, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক করেন ফাউলারকে। ধীরে ধীরে জনপ্রিয়  দৈনিকটির একমাত্র নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে ফাউলার। বছর দুই পর অাত্মহত্যা করেন লর্ড ওয়েনডেল। অনেকেরই সন্দেহ, তার এই অাত্মহত্যায় ফাউলারের প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল, কিন্তু তা প্রমাণ করার জন্যে কেউই আইনের সাহায্য চায়নি।

বাপের ওপর ফাউলারের ক্ষোভ আর ঘূণার কথা গোপন কোন ব্যাপার নয়, তেমনি হঙকঙ ফিরে পাওয়ায় মূল চীনের ওপর তার ক্ষোভ আর ঘৃণাও চাপা থাকেনি। বাপ ইংরেজ, সেজন্যে ব্রিটেনকে সে শক্র রাষ্ট্র হিসেবে জ্ঞান করে; আর চীনকে শক্র মনে করে হঙকঙকে ফিরিয়ে নেয়ায়। তার চিন্তাধারার মধ্যে যুক্তির অভাব যতই থাকুক, নিজেকে সে কখনোই সংশোধন করার কথা ভাবে না।

ফাউলারের মা সন্তান প্রসবের পরপরই মারা যান। হঙকঙের একটা গরীব চীনা পরিবারে মানুষ হয় ফাউলার।

পত্রিকার মালিক হবার পর মিডিয়া ব্যবসায়ী হিসেবে অবিশ্বাস্য উন্নতি করে সে। কয়েকটা টিভি ও রেডিও সেন্টার কিনে নেয়। জার্মানী, হঙকঙ আর ব্রিটেন থেকে এক ডজন দৈনিক আর বাইশটা সাপ্তাহিকী বের করে। এনএভিএসটিএআর-এর গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম, জিপিএস, তখনও কাজ শুরু করেনি, তা সত্ত্বেও ব্যবসায়িক দূরদৃষ্টির পরিচয় দিয়ে তাতে সে পুঁজি লাগায়। সেই পুজি সহস্র গুণ হয়ে উঠল জিপিএস স্যাটেলাইট নেভিগেশনের ক্ষেত্রে স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ায়। খায়রুল কবিরের অধীনে তার এঞ্জিনিয়াররা কমিউনিকেশন স্যাটেলাইটের ক্ষেত্রে

নতুন। টেকনলজি উদ্ভাবন করল, গালফ ওঅর-এর লাইভ কাভারেজ ট্রান্সমিট করল প্রথম যে-কটা নিউজ নেটওঅর্ক তার মধ্যে এফএমজিএন-ও থাকল। মাত্র অল্প কয়েক বছরের মধ্যে দুনিয়া জুড়ে নিজের একটা বিশাল যোগাযোগ সাম্রাজ্য গড়ে তুলল ম্যাডক ফাউলার।

আর এ-সব ছিল মাত্র শুরু।

তার একমাত্র শারীরিক সমস্যা হলো টিএমজে-

টেমপোরোমান-ডিবিউলার জয়েন্ট সিনড্রোম। কোন ব্যাপারে উত্তেজিত বোধ করলে চোয়ালের পেশী ব্যথা করে, ক্লিক ক্লিক এমন একটা শব্দ শুনতে পায় যা প্রায় ধাতব বলে মনে হয়, আর যখনই মুখ খোলে বা খাবার চিবায় তখনই কর্কশ ঘর্ষণের একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি হয়। ডাক্তার কারণ হিসেবে বলেছেন যে ঘুমের মধ্যে দাতে দাত ঘষায়  এমনটি হয়–বড় বেশি টেনশনের এ আরেকটা লক্ষণ। সাবধানতা অবলম্বনের জন্যে রাতে শোয়ার আগে ওপরের দাঁতে প্লাষ্টিক গার্ড পরার পরামর্শ দেয়া হয়েছে তাকে, কিন্তু তা সে পরে না। যে-কোন পরামর্শ বা নির্দেশ অমান্য করার প্রবণতা এজন্য দায়ী হতে পারে। ব্যথায় কষ্ট পায়, কিন্তু ভুলেও আর ডাক্তারের কাছে যায় না।

সামনের তিনটে মনিটরের বোতামে চাপ দিল খায়রুল কবির। একটায় জার্মান স্যাডিস্ট ডিক মেনাচিমের চেহারা ফুটে উঠল। দক্ষিণ চীন সাগরে, সী ঈলে রয়েছে সে। সব কিছু রেকর্ড করা হয়েছে, ক্যামেরার দিকে মুখ তুলে বলল মেনাচিম। এখনও আমি টেপ দেখিনি, তবে শুনলাম ভিউফাইন্ডারের মাধ্যমে দারুণ ছবি পাওয়া গেছে।

দ্বিতীয় মনিটরে ছয়জন ডাইভারের পা দেখা গেল, জলমগ্ন ও বিধ্বস্ত নটিংহামের দিকে এগোচ্ছে। ছবির রঙ ও আলো খুবই ভাল। তৃতীয় মনিটর জ্যান্ত হয়ে উঠল, তাতে দেখা যাচ্ছে  সী ঈলের ত্রুুরা মেশিন-গান থেকে গুলি করছে পানিতে।

দেখুন, দেখুন, ব্যাটা পালাবার চেষ্টা করছে। হা হা হা। ওই পটল তুলল। একটু হয়তো সবুজের ভাব বেশি, তাছাড়া সব ঠিকই আছে, কি বলেন?

ফাউলার ভাবছে, এ-ধরনের কাজ বড় বেশি উপভোগ করে মেনাচিম, তবে লোকটা তার খুব দামী কর্মচারী।

ডাইভারদের নটিংহামে ঢুকতে দেখল ফাউলার, সাতটা এজ মিসাইলের একটা নিয়ে বেরিয়ে এল তারা। তারপর দেখল নটিংহামের নাবিকরা একে একে মারা গেল গুলি খেয়ে। পরিচ্ছন্ন কাজ, কোথাও কোন খুঁত নেই। মাইক্রোফোনে কথা বলল সে, ভাল কাজ দেখিয়েছ, মেনাচিম। এবার খানিক ঘুম দাও…যদি

আসে আর কি।

হেসে উঠল মেনাচিম। ঘুম? বস্, আপনি ঠাট্টা করছেন। এরকম একটা রাত কাটাবার পর আমাকে একটা উৎসবের আয়োজন করতে হবে। হা হা হা।

শিউরে উঠল ফাউলার, কারণ মেনাচিমের উৎসব সম্পর্কে তার ধারণা আছে। শোনা যায় মেনাচিম যখন উৎসব থেকে বিদায় নেয়, পিছনে কয়েকটা পঙ্গু ও থেতলানো শরীর পড়ে থাকে।

উৎসবের ভিডিওটেপ দেখতে চান, বস? জানতে চাইল মেনাচিম।

এবার না, ডিক।

স্যাটেলাইট আপলিঙ্কক-ডাউনলিঙ্ক লেখা অন্য একটা কনসোলে সরে গেল খায়রুল কবির। সীটে বসে চারকোনা, রুলার আকৃতির একটা ডিভাইস খুলল কট্রোল প্যানেলের প্রাগ থেকে। চৌকো লাল একটা বাক্সে ডিভাইসটা ভরে রাখল সে। এই বাক্সটাই

খাইবার পাসে কিনেছিল। কনসোল ছেড়ে ফাউলারের পাশে এসে দাঁড়াল, বলল, এবার বলুন, মি. ফাউলার, আমার কারিগরি বিদ্যা আপনাকে মুগ্ধ করেছে কিনা। আমি কি একটা জিনিয়াস নই?

উত্তর না দিয়ে মাইক্রোফোনে মেনাচিমকে নির্দেশ দিল ফাউলার, ডিক, টেপটা আবার চালাও তো দেখি ।

রয়্যাল নেভীর নাবিকদের মেশিন গানের ঝাক ঝাক বুলেট ঝাঝরা করে ফেলছে, দৃশ্যটা আরেকবার দেখল ফাউলার। তৃতীয়বার দেখল পোমোশনে। তারপর কবিরের দিকে ফিরে বলল, হ্যাঁ, কোন সন্দেহ নেই। আপনি সত্যি জিনিয়াস ।

স্বীকৃতি পেয়ে তৃপ্তির হাসি হাসল টেকনোটেরোরিস্ট খায়রুল কবির।

<

Super User