চোখের পলকে ঘটে গেল সমস্ত ঘটনা!

অস্ফুট আর্তনাদ করে চরকির মত ঘুরে দাঁড়িয়েছে নাকাতা, যুগপৎ বিস্মিত ও আতঙ্কিত। খুদে চোখজোড়া ওর যদূর সম্ভব বিস্ফারিত। হাডিড়সার হলদেটে একটা থাবা ক্যাক করে ধরল রানার ঘাড়ের পেছনটা, হঠাৎ চুলকানিতে ধরেছে যেন জায়গাটাকে।

ছুরি! ভাবল রানা। ঘাড়ের খাপে ছুরি রেখেছে। নাকাতাও তারমানে নিঃশব্দে কাজ সারতে চাইছে। বেশ, অন্তত এ বিষয়ে কোন মতবিরোধ নেই ওদের মধ্যে।

আস্তিনে ওর স্টিলেটোটা তৈরি, কিন্তু রানা ঠিক করল ব্যবহার করবে না। ওটা। নাকাতা হতবিহ্বল, চমকিত। লক্ষ্যভ্রষ্ট হবে ওর ছুরি, রানাকে। আক্রমণের ভান করতে দেখলে।

নাকাতাকে উদ্দেশ্য করে লাফ দিতে গেল রানা, তারপর হঠাৎ ব্রেক কষে। একপাশে পিছলে পড়ে গেল। রানা যখন এসব ছল-চাতুরী করছে ঠিক সে। মুহূর্তে পিটপিট করে চোখ মেলল যুবতী। মুখের বাধনের পরোয়া না করে প্রাণপণ চিৎকারের চেষ্টা করতে দেখল তাকে রানা, কিন্তু স্বর ফুটল না। বেচারীর।

ফাঁদে পা দিয়েছে নাকাতা। থ্রোইং নাইফটা বাতাসে শিস কেটে গেল রানা যেখানটায় দাঁড়িয়ে ছিল এই একটু আগে। ছুরিটা নিক্ষেপের পর ভারসাম্য ফিরে পেতে ক্ষণিকের কালবিলম্ব হলো নাকাতার। পূর্ণ সদ্ব্যবহার করল রানা সুযোগটার। তিন পা এগিয়ে এল ও সাভাতের ভঙ্গিতে, ঈষৎ নুয়ে থাকা জাপানীটার উদ্দেশে। শূন্যে লাফিয়ে উঠে, পিঠ ফিরিয়ে, নাকাতার ঊরুসন্ধি লক্ষ্য করে লাথি চালাল সজোরে।

 লোহার হীল লাগানো জুতোটা বেচারা নাকাতার দেহের কোমলতম অংশে আঘাত হানতে পেঁতো হাসল রানা। সো সলি, মিস্তাল হাগামোতা! নিষ্ঠুর কণ্ঠে বলল।

তীব্রকণ্ঠে আর্তচিৎকার দিল জাপানী। হাঁ করা মুখ থেকে লালা গড়িয়ে। মাটিতে পড়ল। ধীরে ধীরে ভাজ হয়ে যাচ্ছে দেহ ওর, দুহাতে অণ্ডকোষ চেপে ধরে রয়েছে। হলদে নয়, এমুইতে সবুজাভ দেখাচ্ছে ওর মুখের চেহারা, চোখ দুটো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসবে। দড়াম করে মেঝেতে পড়ে গেল লোকটা, তখনও কুঁকড়ে রয়েছে শরীর, চেঁচাচ্ছে আর থাবা মারছে নিজেকে লক্ষ্য করে, কিলবিল করছে দুআধখানা করে কেটে ফেলা সাপের মতন।

নাকাতার আর্তনাদ ছাপিয়ে ধুপ করে একটা ভোতা শব্দ কানে এল রানার। সোফায় নেই, মুখ ও হাত বাধা থাকলে কি হবে, তাই নিয়েই মেঝেতে গড়িয়ে পড়েছে ব্যারোনেস। তার সুন্দর মুখটা বিকৃত হয়ে গেছে আতঙ্কে, ঘুম ভেঙেই এসব ভয়ানক কাণ্ড-কারখানা দেখতে হয়েছে বলে চোখ রসগোল্লা। উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো, এবং ধপাস শব্দ তুলে চিতপাত হলো আবার, শূন্যে দোল খেল ওর দুধ সাদা মসৃণ পা জোড়া।

ভাগ্যিস মুখ বেঁধে রেখেছিল, ভাবল রানা, নইলে চেঁচামেচিতে নাকাতাকে নির্ঘাত হার মানাত ব্যারোনেস। মাটিতে বুক ঘষটাতে থাকা নাকাতার উদ্দেশে ঝাঁপিয়ে পড়ল এবার রানা।

হৈ-হুঁলস্থূল যা করল ওরা, যে-কোন মুহূর্তে পুলিসে গিজগিজ করবে হোটেল। নিচে হাত বাড়িয়ে জাপানীটাকে ময়দার বস্তার মতন থাবা মেরে ধরল রানা। পথের একটা কাটা সরানোর মোক্ষম সুযোগটা যখন পাওয়াই গেছে কপাল গুণে, হাতছাড়া করার বান্দা মাসুদ রানা নয়।

নাকাতার দুর্বল দেহটা ভাঙা জানালার কাছে বয়ে নিয়ে যেতে বিন্দুমাত্র বেগ পেতে হলো না রানাকে। ব্যাটা জাতে মাতাল হলেও তালে ঠিক। ব্যথায় কাতরালে কি হবে, রানার বদ মতলব আঁচ করে, হাত-পা ছুঁড়ে, ধারাল নখ। দিয়ে আঁচড়াতে লাগল বিশালদেহী প্রতিদ্বন্দ্বীকে।

শক্ত করে ধরে জাপানীটাকে দুবার সামনে-পিছে দুলিয়ে খোলা জানালা গলিয়ে বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিল রানা।

শুকনো দেহটিকে পলকের জন্যে ফায়ার এস্কেপের রেলিংটার ওপর ঝুলতে দেখল ও। নাকাতা মরচে ধরা লোহা থাবা মেরে ধরতে চেয়ে ব্যর্থ হলো, তারস্বরে চেঁচাতে চেঁচাতে পেছনের উঠানে উড়ে গিয়ে পড়ল সে।

ঝট করে ব্যারোনেসের দিকে ফিরল রানা। নষ্ট করার মত সময় নেই এ মুহূর্তে।

যুবতী ইতোমধ্যে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছে। রানাকে চাইতে দেখে আঁতকে পিছু হটে গেল। রানা কাছে এসে অভদ্রের মত ধাক্কা মেরে ওকে ফেলে দিল সোফার ওপর, শক্তিশালী দুহাতে চেপে ধরেছে মেয়েটির কাঁধ । রানার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইল ব্যারোনেস, ধূসর, কালো চোখে তার। হিস্টিরিয়ার আভাস।

আমি রানা। বিসিআইয়ের মাসুদ রানা। তুমি এখন সম্পূর্ণ নিরাপদ। বুঝতে পেরেছ?

গভীর চোখে মনের ভাব ফুটল না। রানার হাত থেকে ছাড়া পেতে যুঝছে। মেয়েটি। রানার তলপেটে হাঁটু দিয়ে গুতো মারার চেষ্টা করছে।

ওর কাঁধে হাতের চাপ আরও বাড়াল রানা। মুখটা নিয়ে এল মেয়েটির মুখের কাছে। শোনো! এখন গোলমাল করার সময় নয়। যে-কোন মুহূর্তে পুলিস এসে যাবে। আমি বিসিআইয়ের মাসুদ রানা। গত রাতে আমাকে বোটে তুলে নিয়েছিলে তুমি, মনে পড়ে? ছদ্মবেশ না, আমার গলার স্বর লক্ষ করো। আমি মাসুদ রানা আর তুমি ব্যারোনেস জুলি গ্রাফ। আমাদের দুজনের একসাথে কাজ করার কথা মিশন লেপার্ড-এর ব্যাপারে। এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছ?

ধূসর গভীর চোখে বোধশক্তি ফিরে আসছে বানের পানির মতন দুকূল ছাপিয়ে। সহসা ঢিল পড়ল যুবতীর শরীরে। মাথা ঝাঁকাল সে।

থ্যাঙ্ক গড, বলল রানা। হাতের বাঁধন খুলে দিল সে মেয়েটির, বিজলি খেলা করছে ওর আঙুলে। হাতে সময় বড় কম। চতুর্থ শ্রেণীর হোটেল বলেই রক্ষে, নইলে হৈ-হল্লার শব্দ পেয়ে বহু আগেই চলে আসত হোটেলের লোকজন। রানা ভেবে অবাক হচ্ছে এখনও কেন এসে হাজির হয়নি সুইস পুলিস, দক্ষতার জন্যে তো এদের যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। ও আচ্ছা, এই হোটেলের বদনাম তারমানে পুলিস মহলেও সর্বজনবিদিত। কিন্তু হাঙ্গামার কারণ আর ব্যাক কোর্টের ওই দেহটা সম্পর্কে ব্যাখ্যা দেবে কে?

চড়চড় করে টেনে তুলল রানা মেয়েটির মুখের বাঁধন, ধার ধারল না ভদ্রতার। হাঁ করে শ্বাস টেনে ওর কাছ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিল যুবতী, চোখে আবার তার ভর করেছে. দ্বিধা-দ্বন্দ্ব-সন্দেহ। তুমি-তুমি কি সত্যিই মাসুদ রানা? আমি জানি না! আমি-আমি এখনও কনফিউড।

সুটকেস থেকে কাগজপত্র বের করে দেখিয়ে নিশ্চিন্ত করল ওকে রানা। এখন আল্লার ওয়াস্তে তোমার জিনিসপত্র গুছিয়ে নাও তো। এক্ষুণি পালাতে হবে আমাদেরকে। বাইরে দুটো গুণ্ডাকে পাহারায় বসিয়েছিল নাকাতা। ওদের নিয়ে চিন্তা নেই, চিন্তা পুলিসকে নিয়ে। পালাচ্ছি আমরা, বোঝা গেছে?

কথা বলার ফাঁকে ছোট্ট রূমটায় শশব্যস্তে চলাফেরা করছিল রানা, কুমীরের চামড়ার সুটকেসটার মধ্যে ইতোমধ্যে ছুঁড়ে দিয়েছে ব্যবহৃত বাঁধনগুলো। ওর শ্যেনদৃষ্টি ঘরটির আনাচে-কানাচে ঘোরাফেরা করছে, পুলিসকে কোন ক্রু দিতে রাজি নয় ও নাকাতা বা ব্রিগলের লোকদেরও না। ওরা সবাই এখন রানার বিরুদ্ধে। বিসিআইতে যোগ দেয়ার অর্থ সমস্ত ঝুঁকি মাথায় নিয়ে একা কাজ করা, সুটকেসে একটা অ্যাশট্রে খালি করতে করতে ক্ষুণ্ণ মনে ভাবছে রানা।

পেছনে শুনতে পাচ্ছে ও কাপড়-চোপড় ঝাড়া দিয়ে ঠিকঠাক করে নিচ্ছে। ব্যারোনেস। শব্দ হচ্ছে তার ফলে খস-খস, দ্রুতলয়ে বইছে মেয়েটির শ্বাস প্রশ্বাস। হঠাৎ আঁতকে ওঠার অস্ফুট একটা ধ্বনি কানে এল। পাই করে ঘুরতে দেখতে পেল রানা, স্টকিং টেনে সিধে করতে গিয়ে মাঝপথে থেমে গেছে যুবতী–বিস্ফারিত নেত্রে শূন্য গার্টার হোলস্টার দুটো লক্ষ করছে।

ও নিয়ে ভেবো না, মুচকি হেসে বলল রানা। তোমার খুদে বন্ধুরা নিরাপদেই আছে এখানে। সুটকেসটায় মৃদু চাপড় দিল রানা।

স্কার্টটা ছেড়ে দিয়ে রানার দিকে চেয়ে রইল ব্যারোনেস, মুখের চেহারা টকটকে লাল। হ্যাঁ, সহজ কণ্ঠে বলল রানা। তোমার সুন্দর সুন্দর পা দুটো দেখে ফেলেছি। নাও, হাঁটো। দরজার উদ্দেশে ঠেলে দিল ও মেয়েটিকে। তালা মেরে হল-এ অপেক্ষা করবে আমার জন্যে। এখুনি এসে পড়ছি। আর হ্যাঁ, রানিং শু পরে তৈরি থেকো, জীবনের সেরা দৌড়টা হয়তো দৌড়তে হবে। আজকে।

খুট শব্দ করে লেগে গেল দরজার তালা। দৌড়ে গিয়ে ছোট্ট বাথরূমটায় ঢুকল রানা, দেখে নিল ভেতরটা শেষবারের মত। কিছু নেই। ঘরে এক ছুটে ফিরে এসে সুটকেসটা তুলে নেবে, এসময় মেঝের কোণেতে কি একটা জিনিস পড়ে থাকতে দেখল। কি ওটা?

ছোঁ মেরে তুলে নিল রানা জিনিসটা। নকল দাঁত! ওপরের সারির। স্থান কাল ভুলে হেসে উঠল রানা গলা ছেড়ে। নাকাতার বাঁধানো দাঁত। লালার সঙ্গে নিশ্চয়ই খসে পড়েছিল, তখন লক্ষ করেনি।

 রানার সুটকেস বাধাহ্যাঁদা সারা। খোলার সময় নেই। নকল দাঁতের পাটিটা কি ভেবে পকেটে ফেলে দিয়ে দরজা লক্ষ্য করে দৌড় দিল রানা।

ব্যারোনেস জুলি গ্রাফ দরজার ঠিক বাইরেই অপেক্ষা করছিল। একটা আঙুল ঠেকাল ঠোঁটে। কে যেন উঠে আসছে সিঁড়ি দিয়ে! শব্দ পাচ্ছ? পুলিস। নাকি?

বয়-বেয়ারা না, কর্কশ কণ্ঠে বলল রানা। যা হাঙ্গামা হলো তাতে পুলিস ছাড়া আর কে? জলদি চলো! দেখি কেমন ছুটতে পারো তুমি।

ভারী সুটকেসটা খেলনার মতন হাতে ঝুলিয়ে, অন্ধকারাচ্ছন্ন, ভাপসা করিডরটা ধরে সিঁড়ির উদ্দেশে দৌড়াল রানা। ল্যান্ডিঙের ঠিক আগে থমকে দাঁড়িয়ে, হাত-ইশারায় মেয়েটিকে থামতে বলল পেছনে। রেলিঙের ওপর দিয়ে। সাবধানে উঁকি মেরে, দেখে নিল সিঁড়ির নিচটা। বেশি দেরি হয়ে গেছে? হোটেলের দারোয়ান দুই-ল্যান্ডিং নিচে। উঠে আসছে হন্তদন্ত হয়ে। হাঁফাচ্ছে। দস্তুর মত আর উচ্চকিত গলায় ফরাসিতে আপত্তি জানাচ্ছে। তার পেছনে চ্যাপ্টা ক্যাপ পরা দুজন এজেন্টস দ্য পোলিস। দারোয়ান ব্যস্তভাবে বোঝাচ্ছে এহেন ভদ্র হোটেলে এসব কি ঘটছে তার ব্যাখ্যা পাচ্ছে না সে।

পেছনের উঠানে লাশটা পেয়ে নিক আগে, দোস্ত! হাত বাড়িয়ে মেয়েটাকে হিড়হিড় করে ল্যান্ডিঙের আড়াআড়ি টেনে নিয়ে চলল রানা।

নিচে যেতে পারছি না, ফিসফিস করে বলল। ওপরে যেতে হবে। প্রার্থনা করো, ছাদে যেন একটা রাস্তা পেয়ে যাই পালানোর জন্যে। জলদি, কোন শব্দ নয়।

 মেয়েটিকে সামনে নিয়ে এগোল রানা। ভয় পাচ্ছে, হাই হীলের কারণে হোঁচট খেয়ে না আবার ধরিয়ে দেয় দুজনকেই। অল্প কয়েকটা মিনিট পাবে। ওরা খুব জোর। পুলিস দুটো খালি রূম ও ভাঙা জানালা নিয়ে ব্যস্ত থাকবে যখন।

তিন ল্যান্ডিং উঠে ফুরিয়ে গেছে সিঁড়ি। কিন্তু রানা একটা স্কাইলাইটের তরছা আলো লক্ষ্য করে দৌড়ে গেল ওটার কাছে, অনেক উঁচুতে উড়াল দিয়েছে ওর আশা-আকাক্ষা। ইঁদুরে বোধ হয় শেষমেষ কাটতে পারছে জালটা।

স্কাইলাইটটা দেখে মনটা দমে গেল আবারও রানার। অবিশ্বাস্যরকমের পুরানো, জং ধরা আর ভয়ানকদর্শন জিনিসটা। আকারে প্রায় চার বাই ছয়, রুক্ষ লেভেলের ওপরে মেলে দিয়েছে কাঁচের ছোটখাট একটা চাদোয়া। আশপাশে কোন মই-টই চোখে পড়ল না। স্কাইলাইটটা মাথার ওপরে অন্তত দশ ফিট। সেটা বড় কোন সমস্যা নয়-রানা নিজেই প্রায় ছয় ফিট-কিন্তু হাত রাখার কোন জায়গা ওখানে নেই। নেই ঝুলন্ত শিকল কিংবা দড়ি। আছে শুধু মেঘাচ্ছন্ন। কাঁচের বিস্তার আর ক্ষয়টে কতগুলো কবজা। খিস্তি ঝাড়ল রানা। এটা কি কানাগলি নাকি? আর একেবারে শেষেরটা?

ফাঁদে পড়লে সুইস পুলিশদের সামলাতে পারবে রানা। এমনকি মেয়েটা সঙ্গে থাকলেও ক্ষতি নেই, খানিকটা কষ্টসাধ্য হবে যদিও। কিন্তু নিতান্ত ঠেকায় না পড়লে পুলিসের সঙ্গে লাগতে যাবে না ও। মেজর জেনারেলের নির্দেশ। কথাটা ওকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন বারবার করে।

তেতো হাসি ফুটল রানার ঠোঁটে। বুড়োকে এখানে পেলে ভাল হত। দাঁড়াতে পারত তার কাঁধে ভর দিয়ে!

এসময় হলদেটে দেয়ালটায়-ওটা লক্ষ করল রানা। রীলের ওপর একটা ফায়ার হোস। হিলসনের মতন হতশ্রী হোটেলেও ফায়ার হোস থাকতে হয়। মান্ধাতা আমলের ভঙ্গুর হোসটা নেতিয়ে পড়ে রয়েছে বহুদিন আগে মরা সাপের মতন। অবশ্য কাজ হয়তো চলে যাবে ঠিকই। ওটার পাশে, একটা গ্লাস ফ্রন্টেড বাক্সে, একটা অ্যালার্ম কী।

ব্যারোনেস মহাশয়া লক্ষ করছে ওকে, হাপরের মত শ্বাস বইছে তার, চোখজোড়া বিস্ফারিত। স্কাইলাইটের মাঝখান বরাবর নিচে বেঢপ সুটকেসটা দাঁড় করাল রানা। ধরে থাকো এটাকে, আদেশ করল। যাতে পড়ে না যাই।

ফায়ার হোসটার উদ্দেশে লাফ দিল ও, রীল থেকে খসিয়ে আনুল ককিয়ে প্রতিবাদ জানানো জিনিসটাকে। ভারী পিতলের নজলটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াল খাড়া করে রাখা সুটকেসটার ওপর। স্কাইলাইটের সবচাইতে ওপরের কিনারাটা। এখন আর মাত্র তিন ফিট উঁচুতে। নিচে মেয়েটির দিকে তাকাল রানা। সুটকেসের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে আছে। রানার দেহের চাপে কাবু জিনিসটাকে ধরে রাখতে প্রাণান্ত লড়ছে।

দেঁতো হাসি উপহার দিল ওকে রানা। এই তো, লক্ষ্মী মেয়ে! খুব শব্দ হবে কিন্তু! জলদি কেটে পড়তে হবে আমাদের, কারণ পুলিশ দুজন যে কোন মুহর্তে এসে পড়বে। গ্লাস ভেঙে, লোহার শার্শির গায়ে হোসটা আটকে নিচে নামিয়ে আনব আবার।.তোমাকে তখন ওটা বেয়ে ছাদে উঠে যেতে হবে। খুব। তাড়াতাড়ি। পারবে তো?

আ-আমি জানি না। আমার গায়ে অত জোর নেই। তবে চেষ্টা করব।

চেষ্টা-ফেষ্টা বাদ দাও পারতে হবে, কঠোর শোনাল রানার কথাগুলো। মেয়েদের নিয়ে কাজ করার এইই ঝকমারি! এমুহূর্তে সময় প্রয়োজন ওদের। হোস রীলের পাশে ফায়ার অ্যালার্ম বেলের ওপর রানার দৃষ্টি গিয়ে পড়ল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিক্ষেপও অত্যন্ত জরুরী, ভিন্নমুখী করে দিতে হবে প্রতিপক্ষের মনোযোগ। তাহলে হয়তো ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে পার পেয়ে যেতে পারে এ দফা।

সুটকেসের ওপর থেকে লাফ দিয়ে নেমে পরনের কোটটা খুলতে শুরু করল রানা। মেঝেতে শার্টটা ফেলে দিয়ে ছিঁড়ে ফালাফালা করল। মি. উইলিয়াম হথর্নের ধবধবে ফর্সা শার্টটার দফারফা হয়ে গেল।

রানার লোহাপেটা বুক ও কাঁধ  লক্ষ করে বলল ব্যারোনেস। এসবের মানে–

 দুনিয়ার প্রাচীনতম কৌশল, কথা কেড়ে নিল রানা। নিচের বন্ধুদের জন্যে একটু ডাইভারশনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। কসরত করে কোটটা ফের পরে নিয়ে তুলে নিল ছিন্নভিন্ন শার্টটা। এক টানে দাঁড় করিয়ে দিয়ে মেয়েটিকে ঠেলে দিল ফায়ার অ্যালার্ম বক্সের উদ্দেশে। আমি সিঁড়ির খাদে শার্টটা ফেলে দিলে বোতামটা পুশ করবে তুমি-সেইসঙ্গে প্রার্থনা করতে থাকবে বুদ্ধিটা কাজে লাগে যাতে।

মাথা ঝাঁকাল যুবতী। কিন্তু রানা বারো কদম এগোতে এগোতেই মৃদু স্বরে পিছু ডাকল রানা! আমি-আমি বক্সটা খুলতে পারছি না। জং ধরে আটকে গেছে।

ত্বরিত ফিরে এল রানা। ঠিকই বলেছে ও। ওর কাঁধ চাপড়ে দিল রানা। ভাগ্যিস চেক করেছিলে। একটু পিছনে সরো দেখি।

বলেই ডান হাতের মুঠোয় শার্টটা পেঁচিয়ে দুম করে এক ঘুসি মেরে বসল বক্সটার ওপর। রুনঝুন শব্দ তুলল কাঁচ।

মেয়েটির দিকে চাইল রানা। মনে রেখো। শার্টটা যেই ফেলর সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু মুভ করতে হবে।

পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে, এক ছুটে করিডর পেরিয়ে, সিঁড়িঘরে চলে এল রানা। উঁকি দিল সন্তর্পণে। কানে এল আবছা কণ্ঠস্বর।

ওদেরকে জল্পনা-কল্পনার জন্যে আরেকটা সাবজেক্ট দেয়া দরকার, ভেবে। কোট পকেট থেকে সিগারেট লাইটারটা বের করল রানা।

ছেঁড়া-ফাটা শার্টটা সামনে বাড়িয়ে ধরে লাইটার জ্বেলে ধরল ওটার নিচ দিকে। মুহর্তে দপ করে ধরে গেল আগুন। ওর হাত লক্ষ্য করে লকলক করে এগিয়ে আসছে অগ্নিশিখা, ধোয়ার কটু গন্ধে হলওয়ে ভরাট হতে শুরু করেছে। চট করে পেছনে মেয়েটিকে এক ঝলক দেখে নিল রানা। অ্যালার্ম বক্সে আঙুল ওর। জ্বলন্ত শার্টটা স্টেয়ার ওয়েল দিয়ে এবার ছেড়ে দিল রানা। দাউ দাউ করে জ্বলতে জ্বলতে, প্রচুর ধোয়া ছড়িয়ে দ্রুত নেমে যাচ্ছে ওটা নিচে।

দুদ্দাড় করে করিডর ধরে ফিরে আসার সময় খুশি হয়ে উঠল রানার মনটা। ঘণ্টী বাজতে লেগেছে হোটেলটার অজ্ঞাত কোন স্থানে। ধন্যবাদ, খোদা! কাজ হয়েছে। কপালগুণে খানিকটা সময় হাতে পাওয়া গেল। তবে খুবই সামান্য!

দশ সেকেন্ড পর আবারও সে চড়াও হলো সুটকেসটার ওপর। স্কাইলাইটের উদ্দেশে পিতলের নজলটা গদার মত করে ধরে ধাই করে চালিয়ে দিল। চুরচুর হয়ে গেল কাঁচ প্রথম আঘাতেই। বারে বারে নজলটা দিয়ে মেরে। চলল রানা, কাঁচের ঝর্নার হাত থেকে বাচতে এক হাতে ঢেকে রেখেছে চোখ। বেশ কয়েকবার সামান্য যন্ত্রণা ভোগ করতে হলো, ওদিকে কানে আসছে ফায়ার অ্যালার্মের অবিরাম ঢং-ঢং শব্দ।

এক মিনিটও লাগেনি, স্কাইলাইটের একপাশের কাঁচ ভেঙে চুরমার করে দিল রানা। এবার মরচে পড়া একটা ফ্রেমের ওপর নজলটা ছুঁড়ে দিল। ওটা ওখানে আটকে যেতে, নেমে পড়ল এক লাফে। হোসটাকে গোটা দুই প্যাঁচ মেরে, নিচের দিকটায় একটা গিঠ দিয়ে দিল।

মেয়েটির দিকে ফিরল এবার ও। জলদি পিঠে চাপো। শক্ত করে ধরে থাকবে। ওটা বেয়ে উঠব এখন আমরা!

মৃণাল দুই বাহু পেছন থেকে গলা সাপটে ধরল রানার। কোমল বুকের চাপ এখন পিঠে, শুনতে পাচ্ছে রানা মেয়েটির মৃদু শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ। কি একটা পারফিউম মেখেছে, নাকে আসছে হালকা সুবাস।

এক হাত এক হাত করে উঠে যাচ্ছে রানা। শার্শির ওপর একটা হাত রেখে এবার অপর হাতে ঠেলা দিয়ে তুলে দিল মেয়েটিকে ছাদে।

ব্যারোনেসের হাই হীল জোড়া সহসা খসে রানার মুখের পাশ দিয়ে নিচে পড়ে গেল। ওপর থেকে শোনা গেল বলছে জুলি গ্রাফ, দুচ্ছাই! রানা। প্রথমটায় ভেবেছিল বিরক্তির কারণ, ওর জুতোজোড়া। কিন্তু পরে লক্ষ করল জং ধরা একটা কবজায় আটকে গেছে মেয়েটির স্কার্ট। টানা-হেঁচড়া করছে যুবতী। পা ছুঁড়ে মুক্ত করতে চাইছে নিজেকে, এবং অভিশাপ দিয়ে চলেছে। ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ, জার্মান-সীমাবদ্ধ থাকছে না ওর অসন্তুষ্টি কোন ভাষাতেই।

 স্কার্টটাকে নিচে থেকে মুক্তি দিতে হলো রানাকেই। পরক্ষণে ওর শক্তিশালী, প্রকাণ্ড হাতের এক ঠেলা খেয়ে, স্কাইলাইট ফুড়ে বেরিয়ে গেল মেয়েটি শ্যাম্পেন কর্কের মত। আঁক করে উঠে, আরও একটা গালি ঝাড়ল। ব্যারোনেস ল্যান্ড করার পর, শুনতে পেল রানা।

হোস বেয়ে পিছলে নামার সময় হাসি চাপা দায় হলো রানার পক্ষে। হতে পারে ব্যারোনেস, কিন্তু বস্তিবাসীদের ভাষাও ভালই রপ্ত করেছে জুলি গ্রাফ।

ভাগ্য এখন পর্যন্ত সঙ্গ দিচ্ছে ওদের। অ্যালার্ম বেল বেজে চলেছে খেয়াল করল রানা কুমীরের চামড়ার সুটকেসটা তুলে নিতে নিতে। নিচে, সিঁড়িতে, তুমুল তর্জন-গর্জন। মুচকি হাসল রানা। পুলিশরা নির্ঘাত মনে করবে ভুলক্রমে কোন ইয়ো-ইয়ো অ্যাকাডেমিতে সেঁধিয়ে পড়েছিল ওরা। নাকাতার লাশটা ওরা খুঁজে পেলেই রানা ও ব্যারোনেস হাতে পেয়ে যাবে পর্যাপ্ত সময়।

এক হাতে সুটকেসটা ধরে হোস বেয়ে উঠে যাচ্ছে রানা, পা ব্যবহার করছে এবারে। স্কাইলাইটের কিনারে সুটকেসটা রেখে উঁকি মেরে চাইল। ছাদে দাঁড়িয়ে যুবতী, হানি ব্লন্ড চুল তার এলোমেলো। সুন্দর মুখটা ধুলো মেখে মলিন আর উত্তেজনায় লালচে। পিটপিট করে রানার দিকে চাইল ও।

রানা! এই-এই ছাদ থেকে আমরা নামব কিভাবে?

চারধারে দৃষ্টি বুলিয়ে নিল রানা। মৃদু শিস দিল। ছাদের ঢালটা ওপরের অংশের চাইতে দুরারোহ। প্রাচীন উতরাইটা শেল পাথরের মতন পিছল ও বিপজ্জনক চূড়া থেকে পাশ দুটো নেমে গেছে খাড়াখাড়ি। তিমি মাছের পিঠের ওপর দাঁড়িয়ে থাকার মতন অসহায় অবস্থা।

মনে সাহস রাখো, অভয় দিল রানা। ভয়ের কিছু নেই।

ওকে অবাক করে দিয়ে মুচকি হাসিতে উদ্ভাসিত হলো ব্যারোনেসের মুখটা। মৃদু, আবছা কণ্ঠে বলল সত্যি বলতে কি, ভীষণ ভয় লাগছে। এমন অভিজ্ঞতা আগে কখনও হয়নি তো। যাকগে-কি করতে হবে এখন? পুলিস তো শিগগিরিই উঠে আসবে ছাদে। ওদেরকে অত বোকা পাওনি।

ঠিকই বলেছ, সায় জানাল রানা। রিজের শেষ প্রান্তে চোখ রাখল ও, ব্যারোনেসের পাশ দিয়ে। পেছন দিকে মুভ করো। ধরে নাও, এটা একটা ছেলেমানুষী খেলা। রিজের শেষে কি আছে দেখা দরকার।

জুলিকে অনুসরণ করে রিজের কিনারে চলে এল রানা, শক্ত হাতে ধরে আছে সুটকেস।

ছাদের চূড়ার শেষপ্রান্তে, মেয়েটির পাশ ঘুরে, ওপাশে কি আছে দেখার সুযোগ পেল রানা। চিকন ঘাম দেখা দিয়েছে ওর মুখে। বলাবাহুল্য, পরিশ্রম সম্পূর্ণ দায়ী নয় এরজন্যে। নিচে কি দেখবে রানা তার ওপর নির্ভর করছে অনেক কিছু। ওদের এখানে আটকা পড়ার অর্থ পুলিসের কাছে সিটিং ডাক হওয়া, স্কাইলাইট থেকে পিস্তল দেখিয়ে ফিরে যেতে বাধ্য করবে তাহলে পুলিস। রানার পক্ষেও এতখানি প্রতিকূলতার বিপক্ষে লড়া অসম্ভব। বিশেষ করে মেয়েটির জীবনের নিরাপত্তা যেখানে জড়িত। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিতে পরোয়া করে না রানা-নিচ্ছেও প্রতিদিন-এবং পঞ্চাশ-পঞ্চাশ চান্স থাকলে ব্যারোনেসেরটাও নিতে পারত। কিন্তু কোন সুযোগ যেখানে নেই সেক্ষেত্রে এটা স্রেফ খুনের পর্যায়ে পড়বে!

বিল্ডিঙটার কিনার দিয়ে উঁকি মারল রানা। লাগোয়া বাড়িটার সমতল ছাদ, মাত্র দশ ফিট নিচে। আটকে রাখা শ্বাস ছেড়ে এবার লাফ দিল রানা।

পায়ের নিচে আরামপ্রদ ঠেকল আলকাতরা মেশানো চ্যাপ্টা ছাদটা। ওপরদিকে চেয়ে দুবাহু প্রসারিত করল এবার ও। ইশারায় ঝাঁপ দিতে বলল জুলিকে। সামান্য তালগোল পাকানো একটা পুতুলের মতন ঝটপটিয়ে নেমে এল ব্যারোনেস। আলতো হাতে, জন্টি রোডসের দক্ষতায় ক্যাচ আউট করল ওকে রানা। মুহূর্তের জন্যে ওকে আঁকড়ে ধরল ব্যারোনেস দুহাতে। পরক্ষণে ঝাড়া মেরে মাটিতে নামিয়ে দিতে বাধ্য করল রানাকে।

ওদিকে একটা ফায়ার এস্কেপ আছে। শিগগির এসো। সুটকেসটা তুলে নিয়ে বলল রানা।

খোঁড়াতে খোঁড়াতে ওর পাশাপাশি ছুটছে ব্যারোনেস। আউউ! পা-টা গেছে। ইস, খালি পায়ে-জুতো খসে গেছে আমার, জানোই তো। হঠাৎ এ্যাচ করে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে, রোষ কষায়িত চোখে রানার দিকে চাইল। রানা! জুতো ছাড়া কিভাবে আমি মানে, আমরা কিন্তু লোকের চোখে পড়ে যাব। এভাবে খালি পায়ে…

কোটের দুপকেট থেকে দুপাটী হাই হীল জুতো বের করে, ব্যারোনেসের হাতে ধরিয়ে দিল রানা। তোমার পদসেবাই আমার জীবনের লক্ষ্য। নাও, আল্লার ওয়াস্তে এগুলো পরে নিয়ে উদ্ধার করো আমাকে। একদম সময় নেই।

রানার কাঁধে মসৃণ একটা হাত রেখে তাল সামলাল জুলি, পায়ে গলিয়ে নিল জুতোজোড়া। চলো! ফায়ার এস্কেপের দিকে এবার ওকে ঠেলে দিল। রানা। সরু একটা গলিতে পৌঁছেছে ওটা। আশপাশে জমনিষ্যির চিহ্ন নেই।

আঙুলের ইশারায় ব্যারোনেসকে নামার ইঙ্গিত দিল রানা। লেডিজ ফার্স্ট। আমরা লেজ গুটিয়ে পালাচ্ছি বটে, কিন্তু এখনও একটা সুযোগ হয়তো আছে আমাদের। নাকাতার দেহ ওদের ব্যস্ত রাখবে বেশ কিছুক্ষণ। আর জাপানীটার চামচা দুটো খুব সম্ভব ব্রিগলের কাছে রিপোর্ট করতে ছুটবে। তারমানে দম নেয়ার একটা চান্স পাচ্ছি আমরা। এখন সবার আগে লুকানোর মত একটা গর্ত দরকার আমাদের, পরিষ্কার হওয়া দরকার কিছু বিষয়। কঠোর হলো রানার দৃষ্টি। অনেক কথা আছে তোমার সাথে।

লোহার মইটা বেয়ে ব্যারোনেসের পিছু পিছু নেমে এল রানা।

.

০৪.

চার মেইন গট, বলে উঠল ব্যারোনেস জুলি গ্রাফ। মাসুদ রানার সঙ্গে পরিচয়ের পর এই প্রথম তুবড়ি ছোটাল মাতৃভাষায়; হোটেল হিলসনের ছাদে উচ্চারিত খিস্তি-খেউড়গুলো যদি অবশ্য ভুলে যাওয়া হয়। মেইন গট, পুনরাবৃত্তি করল। জন্মেও ভাবিনি এসব পাগলামি কাণ্ড-কারখানা বাস্তবে কোনদিন ঘটতে পারে।

ফ্যান্টাস্টিক! ভয়ঙ্কর সুন্দর! কি যেন বলে না-একেবারে তুলনারহিত!

কর্মজীবীদের খুদে রেস্তোরাঁটার চারধারে নজর বুলিয়ে নিল রানা, এমুহূর্তে যেখানে ওরা চকোলেট ও ব্রিওখে খাচ্ছে। বারের কাছে টেবিলে বসা এক নাবিক, ঢুলুঢুলু চোখে একদৃষ্টে চেয়ে রয়েছে মদের গেলাসটার দিকে। শ্রমিক গোছের আরও জনা দুই লোককে দেখা গেল আরেকটা টেবিলে, কিন্তু রানাদের দিকে দৃষ্টি নেই কারও। মনে মনে সেজন্যে কিছুটা স্বস্তি বোধ হচ্ছে রানার। ইতোমধ্যে যদূর সম্ভব পরনের পোশাকের ভাজ-টাজ মেরামত করে নিয়েছে। ব্যারোনেস, মিশে যেতে পারবে লোকের ভিড়ে। কিন্তু মাসুদ রানা, ওরফে উইলিয়াম হথর্নের অবস্থা বড়ই করুণ। সমস্যা নেই ছোট করে ছাটা চুল নিয়ে, কিন্তু মুখের জায়গায় জায়গায় কেটে গেছে। পরনে শার্ট নেই, বিজনেস স্যুটটা ধুলো-ময়লা লেগে মলিন, আর ফকিরের ঝোলার মত টুটা-ফাটা। রবারের ভুড়ির অভাবে রীতিমত ঢলঢল করছে পোশাকটা রানার শরীরে। অনেক আগেই জিনিসটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে ও।

ওদের আগমন এখন অবধি বিশেষ কোন সাড়া জাগাতে পারেনি রেস্তোরাঁর ভেতর। খেটে খাওয়া লোকজনেরই জায়গা এটা, ফলে সকলেই ওদের শ্রেণীর মানুষজন দেখে অভ্যস্ত। ভাল কাপড়-চোপড় পরে ঢুকে পড়লেই বরং বিপদ হত।

রিস্ট ওয়াচে নজর বুলাল রানা। মাত্র সোয়া নটা বাজে দেখে অবাক হয়ে গেল। মধ্য সেপ্টেম্বরের নীলচে-সোনালী সকাল। ওদের সামনে স্বচ্ছ কাঁচের। মতন বিছিয়ে পড়ে রয়েছে ল্যাক লেম্যান, কিংবা কোন জাপানীর বাগানের। কৃত্রিম হ্রদের মত।

ছোট টেবিলটার ওপাশে হাত বাড়িয়ে চাপড়ে দিল রানা মেয়েটির হাত। সত্যিই ভাল খেল দেখিয়েছ তুমি, আবারও বলছি। কিন্তু আমার বস বলেছিলেন তুমি নাকি বনের হয়ে অনেকদিন কাজ করেছ-এত অবাক হচ্ছ কেন তাহলে? তুমি যদি এজেন্টই হয়ে থাকো, মানে—

রানার আঙুলগুলোয় আলতো চাপ দিয়ে হাতটা ছাড়িয়ে নিল জুলি। এরকম কোন অভিজ্ঞতা কখনও হয়নি আমার। সত্যি বলছি, রানা! হ্যাঁ, বনের। হয়ে কিছুদিন কাজ করেছি বটে, কিন্তু খুব শিগগিরিই বিরক্ত হয়ে পড়ি। ডেস্ক ওঅর্ক করতে করতে হাফ ধরে গেছিল। অনেকবারই ছেড়ে দেব ছেড়ে দেব করতে করতে রয়ে গেছি, মনকে বুঝিয়েছি দেশের কাজ করছি। অন্য কোনভাবে দেশকে যে কিছু দেব তার উপায় ছিল না-কাজেই ছাড়তে পারিনি। কিন্তু এটা একদম-হেসে উঠে হাত বাড়িয়ে তুলে নিল রানার একটা হাত।

আবার বলছি–এরকম কাণ্ড আগে কোনদিন দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। চাপ বাড়াল রানার হাতের ওপর। তোমার মত তুখোড় লোকও এই প্রথম দেখলাম, রানা! তুমি ম্যাগনিফিক! তোমার সম্পর্কে যা শুনেছিলাম এখন দেখছি মিথ্যে নয়।

ভ্রূ কুঁচকে গেল রানার। কিংবদন্তী হওয়ার এই এক মুশকিল। বহু লোক জানে তোমাকে।

চকোলেট শেষ করে চারপাশে আরেক ঝলক দৃষ্টি বুলিয়ে নিল ও। উদ্বিগ্ন হওয়ার মত কোন কারণ ঘটেনি। ঝুলে পড়া কোটটা টেনেটুনে ওটার সঙ্গে আন্তরিক হলো রানা। কুৎসিত দেখাচ্ছে ওকে। কোন অত্যুৎসাহী পুলিশ এখন এখানে এসে হাজির হলে, বিব্রতকর নানা প্রশ্নের সম্মুখীন করতে পারে।

 ব্যারোনেস, বলল রানা, চকোলেট আর বান জলদি শেষ করো। আমাদের সটকে পড়তে হবে এখান থেকে। কোথায় যাব জানি না, তবে একটা কিছু ভেবে বের করতে হবে। আসলে, ভাবল রানা, এজেন্সীর ওই ডিপোটা ছাড়া এখন আর কোন নিরাপদ আশ্রয় নেই। পুলিশ, নাকাতার ও ব্রিগলের লোকদের হাত এড়াতে চাইলে ওটাই মোক্ষম জায়গা। তাছাড়া, বসের সঙ্গে কথা বলাটাও জরুরী। তাকে জানাতে হবে মারা পড়েছে নাকাতা, এবং ক্রমেই আগুনের মত উত্তপ্ত হয়ে উঠছে খেলাটা।

সময় নষ্ট হচ্ছে খামোকা। রুডলফ ব্রিগল হয়তো এমুহূর্তে ফ্রেঞ্চ কী-টা ব্যাঙ্ক ম্যানেজারের হাতে দিয়ে, ভল্ট খুলে হাতিয়ে নিচ্ছে দুষ্প্রাপ্য চিতাবাঘ।

রাহাত খান অবশ্য যথারীতি প্রতিটি অ্যাঙ্গেল কাভার করেছেন। পালা করে ব্যাঙ্ক পাহারা দিচ্ছে অন্যান্য এজেন্টরা। কিন্তু সে তো রুডলফ ব্রিগল তার চেহারা প্লাস্টিক সার্জারি করে বদলে ফেলার আগেকার সেট আপ। ও একা। ব্যাঙ্কে গেলে চেনার সাধ্য নেই কারও। ওদের কাছে যে ছবি আছে এখন তার এক কানাকড়ি দামও নেই।

এদেশ থেকে বেরোনোর সম্ভাব্য প্রতিটি পয়েন্টে চোখ রাখা হয়েছে, কিন্তু তাই বলে গোটা একটা দেশকে তো আর সর্বক্ষণ কভার করে রাখা সম্ভব নয়। রুডলফ ব্রিগল যদি সুইটজারল্যান্ড ত্যাগ করার জন্যে অস্ত্রের ভাষায় কথা বলে, এবং রানার ধারণা বলবে, সেক্ষেত্রে ব্যাপক রক্তপাত ঘটতে চলেছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আকর অনন্যসাধারণ এই দেশটিতে।

মুসলিম বিশ্বের একাধিক দেশ অনুরোধ করেছিল রাহাত খানকে, রুডলফ ব্রিগল ও হিদেতোশি নাকাতার হাত থেকে সোনার চিতাবাঘটা উদ্ধার করতে যেন মাসুদ রানাকে পাঠানো হয়। লোক দুটো মূর্তিটা হাত করতে পারলে নাকি ভয়ানক বিপদ নেমে আসতে পারে মধ্যপ্রাচ্যের ওপর। কি বিপদ জানে না। রানা। মেজর জেনারেল বলেননি, ও-ও জানতে চায়নি। বলা যায় এবার একটা ব্লাইন্ড মিশন নিয়ে কাজে নেমেছে রানা।

গুল্লি মারো! কিছু একটা করতে হবে, নিজেকে মনে মনে কঠোর কণ্ঠে শোনাল রানা। এবং দ্রুত। ব্যারোনেসের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে বসে থাকতে পাঠানো হয়নি ওকে। ও সেজন্যে আসেওনি।

এই যুবতীটিকেও করার মতন লাখো প্রশ্ন মাথার মধ্যে রয়েছে ওর। এর। একটা না একটা মিথ্যে ধরার জন্যে অস্থির হয়ে রয়েছে রানা। মেজর জেনারেল একে বিশ্বাস করতে পারেন। বন কর্মকর্তারা হয়তো বাইবেল ছুঁয়ে সাফাই গাইবেন এর পক্ষে। কিন্তু মন গলবে না তাতে মাসুদ রানার। অন্তত এখন পর্যন্ত গলার মত কোন কারণ ঘটেনি। গত রাতে যেভাবে ওকে বোটে তুলে নিয়েছিল ব্যারোনেস, সে ব্যাপারে সন্দেহ দূর হয়নি ওর।

কিন্তু সে সব সন্দেহের অবসান পরেও ঘটানো যাবে। এই মুহূর্তে রানাকে

ওর হাতে চাপড় দিল ব্যারোনেস। কি ভাবছ অত? আমাকে বিশ্বাস করতে পারছ না, তাই না?

কথা-বার্তা ওর উচ্চশিক্ষিতা নারীর মত। ছবি আর পাসপোর্ট মিলে গেছে। মেজর জেনারেল আর বন সাক্ষ্য দিয়েছে ওর পক্ষে। সত্যিকারের ব্যারোনেস জুলি গ্রাফই এই মেয়ে। তাহলে এত দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কিসের রানার? এর জবাব পেল না ও।

সেজন্যেই ড্রাগ দিয়েছিলে আমাকে। সার্চ করেছিলে আমার পার্স, নাছোড়বান্দার মতন বলল জুলি।

রুটিন ওঅর্ক, এক কথায় জবাব দিল রানা। তার কারণও আছে। স্টীমারে নিজের পরিচয় দাওনি তুমি, আগেই ঢলাঢলি শুরু করে দিয়েছিলে। ব্যাপারটা তাজ্জব করে আমাকে। তাছাড়া আরেকটা ব্যাপার, ওই পাসপোর্টটা ছাড়া আর কোন আইডেন্টিফিকেশন দেখাওনি আমাকে তুমি, এবং পাসপোর্টটা তোমার না কার বুঝব কি করে আমি?

রহস্যময় হাসি ঠোঁটে ধরে রেখে চকোলেটে চুমুক দিল জুলি। দুটোই খুব সিম্পল, রানা। তোমার দ্বিতীয় সন্দেহটার অবসান আগে ঘটানো যাক। আমাকে কোন আইডেন্টিফিকেশন দেয়া হয়নি। যাতে বন কিংবা বিসিআইয়ের সঙ্গে আমাকে কেউ জড়াতে না পারে। আমার বস ভেবেছিলেন আমি যেহেতু দীর্ঘদিন ধরে স্পাইং করছি রুডলফ ব্রিগলের ওপর, সে-ও হয়তো স্পাই লাগিয়েছে আমার পেছনে। সে হয়তো জানে, এখন একমাত্র আমিই আইডেন্টিফাই করতে পারব তাকে। তার মানেটা বুঝতে পারছ?

পানির মতন, বলল রানা। তোমাকে খতম করার চেষ্টা করবে ও যত শিগগির পারে।

ব্যারোনেসের সুন্দর মুখশ্রীর ওপর একটা চঞ্চল ছায়া খেলে গেল। সসারে কাপ, রেখে মাথা ঝাঁকাল জুলি গ্রাফ। আমার শরীরে কোন চিহ্ন থাকুক চাননি বস, বোঝোই তো কেন।

ব্যাপারটা মেনে নিল রানা। এসপিওনাজ, কাউন্টার এসপিওনাজ সম্পর্কে ওকে আর নতুন করে কি বোঝাবে ব্যারোনেস?

আর ঢলাঢলির কথা বললে, সেটারও কারণ আছে, বলে চলেছে ব্যারোনেস। আমি নিশ্চিত হতে পারছিলাম না তুমিই মাসুদ রানা কিনা। বড় জব্বর ভড়ং ধরেছিলে তো। সত্যিকারের মাঝি-মাল্লা মনে হচ্ছিল। আর মদও যা টেনেছিলে, বাপরে!

দাঁত বেরিয়ে পড়ল রানার। সবই অভিনয়ের অংশ। সন্দেহ ক্রমে ক্রমে দূর হতে লেগেছে ওর।

তোমার সঙ্গে ঘেঁষটা-ঘেঁষটি করে সুটকেসের স্টিকারগুলো পড়তে চেষ্টা করছিলাম, বলল জুলি। কিন্তু তুমি তো স্টার্নের ছায়ায় থাকার জন্যে নাছোড়বান্দা। বুঝব কি করে তুমি ব্রিগলের লোক নও? কাজেই শ্রাগ করল ব্যারোনেস, ছেঁড়া, ধুলোমাখা ফেইল জ্যাকেটেও অদ্ভুত সুন্দর দেখাল ভঙ্গিটা। কাজেই ঢলানি সাজতে হলো আমাকে। তাও শিয়োর হতে পারলাম কই?

কথাগুলোয় যুক্তি আছে, মনে মনে স্বীকার করল রানা। আলাপচারিতার মাধ্যমে জেনে নিল এক ফাঁকে, নাকাতাকে চেনে না জুলি। ব্রিগলের সঙ্গে কি সম্পর্ক তার সেটাও জানে না। রানাও ভেঙে বলতে গেল না আর। কথা যত কম ফাস হয় ততই মঙ্গল। নাকাতাকে ব্যারোনেস একজন সুযোগসন্ধানী ধর্ষণকারী হিসেবেই জানুক না, ক্ষতি কি ওর?

 কোটের পকেট থেকে একটা বলপয়েন্ট পেন বের করল রানা। এটার কথাও তোমাকে নিশ্চয়ই জানানো হয়েছে? লেখা যায় না এটা দিয়ে, শুধু কালি ছেটায়।

হাসল না জুলি। তাও ভাল, মাথা ধরিয়ে দেয় না। তুমি কিন্তু খুব অন্যায় কাজ করেছ-আমাকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে আমার জিনিসপত্র ঘাটাঘাটি…তোমাকে ঘেন্না করা উচিত আমার।

হেসে উঠল রানা। কিন্তু করছ না?

না। আমার কোন ক্ষতি করোনি তুমি। বরঞ্চ হনুমানটার হাত থেকে রক্ষা করেছ। কিন্তু আমার খুদে বন্ধু দুটোকে তোমার এখন ফিরিয়ে দেয়া উচিত।

পাশে রাখা কুমীরের সুটকেসটায় হাত বুলাল রানা। এখানে আছে। সময় হলেই ফেরত পাবে। এবার আমার একটা কথার জবাব দাও তো, ব্যারোনেস।

আর ব্যারোনেস নয়, এখন থেকে জুলি, কেমন? মিষ্টি হেসে বলল ব্যারোনেস।

বেশ, জুলি, সায় জানাল রানা। অবশ্য তোমাকে দেখে কিন্তু মোটেই ব্যারোনেস মনে হয় না—

আমি ব্যারোনেস, খানিকটা উদ্ধত শোনাল জুলির কণ্ঠ। বহু পুরনো টাইটেল। আলমানাক ডি গথা-য় আমার ফ্যামিলির নাম আছে।

হয়েছে, হয়েছে, বলল রানা। খেপো কেন? আমি আসলে জানতে চাইছিলাম, নাকাতা জানল কিভাবে আমরা ওই হোটেলে উঠেছি? জবাবটা আমি জানি, কিন্তু তোমার ধারণাটা জানতে চাইছি।

পার্স হাতড়ে বেনসনের প্যাকেটটা বের করল জুলি, তল্লাশীর সময় রানা। যেটা লক্ষ করেছিল। লাইটার বাড়িয়ে ধরতে ধোয়া ভেদ করে একদৃষ্টে চেয়ে। রইল ওর দিকে মেয়েটি। আমার আইডিয়া আলাদা কিছু হবে কেন, রানা, তোমার মতই। ওরা ফলো করছিল তোমাকে নয়, আমাকে। ওরা আসলে ব্রিগলের চর। গত রাতে বোট থেকে নিশ্চয়ই পিছু নিয়েছে আমাদের।

সরু চোখে মাপল ওকে রানা। একশো মাইল বেগে মাথার মধ্যে দুশো রকম চিন্তা ঘুরছে ওর। দ্বিমত করল না মেয়েটির ধারণার সঙ্গে। খুব একটা কিছু এখন এসে না গেলেও, মিশন লেপার্ডের সফল পরিণতি কিন্তু হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়ল। এই অভাবিত মোচড়টার জন্যে তৈরি ছিল না রানা। রাহাত খানই কি ছিলেন? ব্যারোনেস চিহ্নিত করবে ব্রিগলকে রানার জন্যে, ব্যাপারটা ছিল তাই। কিন্তু এখন কি হলো, রানার সঙ্গে ওর উপস্থিতি উল্টে রানাকেই ফাস করে দেবে। ব্যারোনেসের সঙ্গে যে লোক থাকবে তাকে নিশ্চয়ই বন্ধু মনে করতে যাবে না ব্রিগল। আরও মুশকিল হচ্ছে, মেয়েটিকে যে মিশন শেষ। না হওয়া পর্যন্ত কোথাও লুকিয়ে রাখবে তারও উপায় নেই। রুডলফ ব্রিগলকে আইডেন্টিফাই করতে, এ মেয়ে অপরিহার্য।

রানার চিন্তা-ভাবনা বয়ে গেল অন্য খাতে। এ মুহূর্তে রুডলফ ব্রিগল সম্পর্কে নিশ্চিত অনুভূতি হচ্ছে ওর। লোকটা হুট করে কোন হঠকারী সিদ্ধান্ত নেবে না। এতদিন ধরে সোনার চিতাবাঘটার জন্যে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করার পর তো নয়ই। না, রুডলফ ব্রিগল অপেক্ষা করবে, পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবে এবং গুটি চালবে বিশেষ সতর্কতার সঙ্গে। ওর প্ল্যান হবে খুঁতহীন ও ক্ষুরধার, এব্যাপারে বাজি ধরতে রাজি মাসুদ রানা। বাবার কাছ থেকে চাবির অর্ধাংশ পাওয়ার পর বহু সময় পেয়েছে সে পরিকল্পনাটাকে নিখুঁত করতে। জাপানে যোগাযোগ করে খুঁজে বের করেছে ইয়ামাগুচি নাকাতার ছেলে হিদেতোশি নাকাতাকে। সন্ত্রাসী হিসেতোশি নাকাতা তেরো বছরের জেল খেটে বেরোনোর পর একত্র হয়েছে দুইজন।

গোটা বিষয়টা উল্টেপাল্টে বিবেচনা করতে, পরিষ্কার হয়ে গেল রানার কাছে, ভয়ের কিছু নেই। রুডলফ ব্রিগল ব্যাঙ্ক থেকে চিতাবাঘ বের করতে পারবে না। চাবির বাকি অর্ধাংশ তো নাকাতার কাছে। দুজনের কেউই কাউকে এক কানাকড়ি দিয়েও বিশ্বাস করবে না! জীবনবাজি রেখে এ-কথা বলতে পারে রানা।

ব্যারোনেসের দিকে চাইল ও। ওকে। আমার মনে হচ্ছে ব্যাপারটা। এভাবে সাজানো যায়-ওরা তোমার পেছনে লেগেছে। আমার পরিচয় ফাস হয়নি এখন পর্যন্ত। কেনেট ডাহলিন পালিয়েছে হোটেল হিলসন ছেড়ে। উইলিয়াম হথর্নকে চেনে না ওরা। কারণ সকালে ওয়াচার দুজনের তরফ থেকে কোন প্রতিক্রিয়া পাইনি, আমি–এবং মারা গেছে নাকাতা। কোন সন্দেহ নেই এ ব্যাপারে। তবে যাই হোক, এমুহূর্তে আমার ধারণা, ব্রিগল এবং তার লোকেরাও আমাদের মতই বিভ্রান্ত বোধ করছে। নাকাতার মৃত্যু খানিকটা দুর্গন্ধ ছড়ারে, কাজেই ওই হোটেলের আশপাশে ঘুরঘুর করার সাহস পাবে না ওরা।

এখন প্রবলেম হচ্ছে-তোমাকে সাথে রেখে কিভাবে এগোনো যায়, যাতে প্রয়োজনের সময় রুডলফ ব্রিগলকে তুমি স্পট করতে পারো। তার আগে পর্যন্ত তোমাকে বাঁচিয়ে তো রাখতে হবে, আর আমি আছি তোমার সাথে। সেটাও বোঝানো চলবে না। এই সমস্যার একটা মাত্র সমাধানই মাথায় আসছে, আমার। তোমার সুনাম কেমন, ব্যারোনেস-মানে, জুলি?

অপূর্ব চোখজোড়া প্রস্ফুটিত হলো মেয়েটির। তুমি কিসের কথা বলছ, রানা?

ওর ভুবনভোলানো হাসিটা উপহার দিল এবার রানা। আমাদেরকে এখন প্রেমিক-প্রেমিকা সাজতে হবে, মাই গার্ল। মানে লোকের চোখে ধুলো দিতে আরকি। তাই জানতে চাইছিলাম প্রেমিকা হিসেবে তোমার সুনাম কেমন। ইমেজ হানি-টানি হবে না তো? রুডলফ ব্রিগল ধূর্ত লোক, আর তুমি ওকে যতখানি চেন, সে-ও তোমাকে ঠিক ততখানিই চেনে। কাজেই কুমারী হিসেবে তোমার সুখ্যাতি থেকে থাকলে ওকে ধোকা দেয়া যাচ্ছে না, বুঝতে পেরেছ?

গোলাপী হয়ে গেল ব্যারোনেসের গাল দুটো। অদ্ভুত সুন্দর এক দুতি ওর চোখে। অপেক্ষা করছে রানা। হঠাৎ হেসে উঠল জুলি। দাতে কাটছে ভেজা। অধর। রানার মনে হলো সহসা অদ্ভুত এক ইঙ্গিত আবিষ্কার করেছে ও মেয়েটির চোখে। সঙ্গে খানিকটা বিদ্বেষও কি?

মাথা ঝাঁকাল জুলি। কোন আপত্তি নেই আমার, কোন সমস্যা ও নেই। তবে মনে থাকে যেন, রানা, এটা স্রেফ অভিনয়। নিছক একটা কাভার, ঠিক আছে?

ফাইন, বলল রানা। ওভাবেই অভিনয় করব আমরা। সাময়িকভাবে পেয়েও যেতে পারি এর সুফল। যত যাই হোক, গতরাতে একটা নোংরা নাবিককে বোটে তুলে নিয়েছ তুমি। ব্রিগলের লোকেরা দেখেছে সেটা। ফলে করেছে আমাদের হোটেল হিলসন পর্যন্ত। চিন্তা-ভাবনা ওদের মাথাতেও চলছে।

বলার অপেক্ষা রাখে না।

পকেট হাতড়ে গোল্ডলীফের প্যাকেটটা বের করল রানা। কিন্তু খুলে দেখে খালি। ধ্যাত্তেরি! স্বগতোক্তি করল।

বেনসনের প্যাকেটটা এগিয়ে দিল জুলি। এটা নাও। আরেক পকেট হাতড়াচ্ছে তখন রানা। থাকার তো কথা-আরেহ, এটা কি?

জনাব হিদেতোশি নাকাতার বাধানো দাঁতটা টেবিলে ওদের মাঝখানে রাখল। বেমালুম ভুলেই গিয়েছিল ও কুড়িয়ে পাওয়া অমূল্য রতনটার কথা।

অস্কুট বিস্ময়ধ্বনি বেরিয়ে এল ব্যারোনেসের মুখ দিয়ে। বিদ্রুপের হাসি হাসল রানা। মরহুম নাকাতার বিকশিত দন্ত। জিনিসটা পুলিশের হাতে পড়ক চাইনি।

মুখ কুঁচকে গেছে জুলির। ছিঃ! ফেলো, ফেলো, শিগগির ফেলে দাও। মাগোহ

কিন্তু রানা সে কথায় কান না দিয়ে বাঁধানো দাঁতের পাটীটা তুলে নিল। খুব আমোদ পাচ্ছে ও। দেখো, দেখো, বাক টীথ! আগের পাটীগুলোর সাথে মিল রেখে ইচ্ছে করে কোদাল মার্কা করা হয়েছে। কৌশল জানে বটে জাপানীরা, কি বলো?

প্লীজ, রানা! ফেলে দাও ওটা। বমি পাচ্ছে আমার।

ব্যারোনেসকে আরেকটু সহনশীল হতে পরামর্শ দিতে যাবে রানা, এসময় আচমকা ওর চোখ আটকে গেল নকল দাঁতের সারিটার ওপর। কোনাকুনিভাবে চিড় খেয়ে গেছে প্লেটটা। লাল নিয়োপ্রেনের ভেতর দিয়ে উঁকি দিচ্ছে চকচকে ধাতব কিছু। আঙুল দিয়ে টেনে বের করতে চেষ্টা করল রানা। কিন্তু এটে আছে, জিনিসটা, খসবে না।

রানা! আমাদের এখন চলে যাওয়া দরকার। আমার মনে হচ্ছে—

 একটা হাত তুলে বাধা দিল রানা। চুপ থাকো!

টেবিলে আলতো করে ঠুকছে ও পাটীটাকে। নিয়োপ্ৰেনের ফাঁদটা বড় হলো আরেকটু। অসহিষ্ণু মাসুদ রানা এবার সহসা জোর খাটিয়ে ফেড়ে ফেলল প্লেটটাকে। টেবিলে পড়ে গড়িয়ে গেল খুদে একটা ঝকঝকে লোহা, থাবা মেরে ধরল ওটাকে রানা। নিমেষে বুঝে গেছে জিনিসটা কি। ফ্রেঞ্চ কী-র একাংশ!

মাসুদ রানার কঠোর মুখটায় ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ল আনন্দের চওড়া হাসি। বিসিআইয়ের তীক্ষ্ণবুদ্ধি ছেলেগুলোর ধারণা তারমানে অমূলক ছিল না। ওরা অনুমান করেছিল, ফ্রেঞ্চ কী-র অর্ধেকটা ব্রিগলের ও বাকি অর্ধেকটা নাকাতার কাছে রয়েছে। করাত দিয়ে কাটা ফ্রেঞ্চ কী-টাকে সমান দুভাগে ভাগ করে নিয়েছিল ওদের বাবারা। কাজেই পরস্পরকে বিশ্বাস না করে কোন উপায় আছে লোক দুটোর?

 নাকাতার অর্ধাংশ এ মুহূর্তে, যেন আকাশ থেকেই, রানার কোলে এসে পড়েছে। মৃদু হাসি ফুটল ওর মুখে। হাফ কী-র হাফ গ্রহণ করবে না কোন সুইস ব্যাঙ্ক। হাসি চাপল রানা। এতবছর নাকাতার জেলমুক্তির জন্যে অপেক্ষা করে গেল ব্রিগল, সোনার চিতাবাঘটা যাতে কজা করতে পারে-কিন্তু পেলটা কি? লবডঙ্কা। মারা পড়েছে নাকাতা এবং তার ভাগের টুকরো চাবিটা এখন মাসুদ রানার হাতে। ব্রিগলকে আসতে হবে ওর কাছে। না চাইতেই দর কষাকষির মস্ত সুযোগ পেয়ে গেছে ও।

ঘামের দুর্গন্ধ নাকে আসতে মুখ তুলে চাইল রানা। ওয়েটার এসে দাঁড়িয়েছে। রানা টেবিলে দাঁত ঠোকাতে সে মনে করেছে ডাক পড়েছে। মাথা নেড়ে এক মুঠো ফ্রা ঢেলে দিল রানা টেবিলে। কলজেটা অ্যা-ও বড় হয়ে গেছে। ওর। ফুর্তি অনুভব করছে মনে। অলৌকিকভাবে ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে এমনই লাগে মানুষের। ফ্রেঞ্চ কীর টুকরোটা পকেটে ছেড়ে দিল ও। এতক্ষণ একটি কথাও বলেনি ব্যারোনেস, বেশিরভাগ সময় চোখ সরিয়ে রেখেছিল ঘেন্নায়।

সটান উঠে দাঁড়াল এবার রানা, তুলে নিল সুটকেস। ব্যারোনেসের উদ্দেশে চোখ টিপল, নতুন ভূমিকায় মানিয়ে নিচ্ছে স্বচ্ছন্দে। এসো, ডার্লিং। যাওয়া যাক। অনেক দেরি হয়ে গেল।

দেরি মানে দেরি?দরজার দিকে পা বাড়িয়ে ফিসফিস করে বলল ব্যারোনেস। তোমাকে যেটা বলতে চাইছিলাম। পুলিস-রাস্তার ওমাথায়। বায়ে-আরেকটা কাফেতে ঢুকেছে।

তাহলে ডানে টার্ন নেব আমরা, বলল রানা। দৌড় দিয়ো না, আস্তে আস্তে হাঁটো কাছের একব্জিটটার দিকে। প্রেমিক-প্রেমিকার মত হাত ধরাধরি করে হাঁটব আমরা। কোটের কলার তুলে দিয়ে, ঢোলা পোশাকটা টেনেটুনে আটসাট করল দেহের চারপাশে। এবার পা বাড়াল একব্জিটের উদ্দেশে। এটা। খুব সম্ভব রুটিন চেক, কিন্তু এমুহর্তে ওকে থামানো যোক চায় না রানা। শার্টবিহীন লোকের ব্যাপারে কৌতূহলী হয়ে উঠতে পারে ওরা। আর সুটকেসটা চেক করলে তো কথাই নেই, খেল খতম।

ফ্রেঞ্চ কী ভাগ্যগুণে হাতে পাওয়ার পর কিছুতেই এ সুযোগ দেয়া যায় না। হাতে হাত ধরে রাস্তায় বেরিয়ে এসেছে ওরা। কাজে দিয়েছে বুদ্ধিটা। কারও সন্দেহ জাগেনি। কানে আসেনি কোন তর্জন-গর্জন, কাঁধে পড়েনি পুলিসী থাবা।

পাশ থেকে মৃদু স্বরে বলল এসময় ব্যারোনেস  পেয়ে গেছি, রানা। লুকানোর জন্যে একটা চমৎকার জায়গা পেয়ে গেছি। আমার এক পুরানো বন্ধুর বাড়ি, কিন্তু সে এখন ওটা ব্যবহার করছে না। তার অনুমতি নেয়ারও প্রয়োজন পড়বে না। আমাকে পারমিশন দিয়ে রেখেছে, যখন খুশি উঠতে পারি। ওখানে, খুশি হবে সে। কাজের লোকেরও অসুবিধা নেই। যাবে?

চট করে চাইল একবার ওর দিকে রানা। ব্যারোনেসের হানি-ব্লন্ড মাথাটা ওর কাঁধ ছুঁই-ছুঁই করছে। স্বৰ্গটা কোথায়?

লেকটার বিশ মাইল উজানে, সুইস অংশে। আমাদের জন্যে পারফেক্ট হবে জায়গাটা।

যাব কিভাবে ওখানে? সাঁতরে?

লঞ্চ ভাড়া করা যায়। ওই দেখছ না জেটি?

বেশ, চলো। ছোট জেটিটা হ্রদের শান্ত পানিতে কাঠের আঙুলের মত মাথা উঁচিয়ে রয়েছে। ঝট করে পেছনটা এক নজর দেখে নিল রানা। পুলিস বা আর কারও কোন আগ্রহ নেই ওদের প্রতি।

লেকের পারে বাতাস চঞ্চল ও ঈষৎ ঠাণ্ডা। জেটির চারপাশে পতাকা ও বান্টিং সাহসী ভঙ্গিতে পতপত করছে। সাদা রঙের ছোটখাট একটা লঞ্চ নোঙর করা, পুরানো টায়ারে তৈরি ফেন্ডার প্রতিরক্ষা দিচ্ছে ওটাকে।

জেটির তক্তা ও পায়ের নিচে অনুভব করতে ব্যারোনেস বলল বাধানো দাঁতটা পেয়ে অত খুশি হয়ে উঠেছ কেন, রানা? আমাদের কাজের সঙ্গে কোন সম্পর্ক আছে ওটার? চিতাবাঘটার সাথে?

ধীরে বৎস, ধীরে, রহস্য করে বলল রানা।

কি ছিল দাঁতের পাটীটার ভেতরে? নাছোড়বান্দার মত জবাব চাইল জুলি।

জানবে, বলল রানা। তবে এখন নয়, পরে। গুনগুন করে সুর ভাঁজছে ওঃ কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা–

<

Super User