৪৫২. কালো কুয়াশা – মাসুদ রানা – কাজী আনোয়ার হোসেন

পূর্বকথা

পূর্ণিমার উজ্জ্বল আলো অদ্ভুত এক আভা তৈরি করেছে মিশরের মরুভূমিতে। বালিয়াড়ি পেয়েছে তুষারের শুভ্রতা, অ্যাবাইদোসের পরিত্যক্ত কিছু মন্দির ঝকঝক করছে অ্যালাব্যাস্টারের মতো। আশ্চর্য ওই আলোকসজ্জায় আলোকিত ওই মৃত্যুনগরীর ভিতর দিয়ে এগিয়ে চলেছে কয়েকজন অনুপ্রবেশকারীর একটা মিছিল।

তাদের গতি মন্থর, যাত্রাটা নিরানন্দ; সংখ্যায় নারী-পুরুষ মিলিয়ে ত্রিশজন। সবার পরনে ঢিলাঢালা আলখাল্লা, চেহারার অনেকখানি ঢেকে আছে হুড তুলে রাখার কারণে। সামনের পথের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ তাদের। ফারাওদের সমাধি প্রকোষ্ঠগুলো ঘেঁষে এগিয়ে চলেছে তারা। হাতের দুপাশে এবং সামনে-পেছনে আছে দেবতাদের উদ্দেশে বানানো গুটিকয়েক মন্দির আর সমাধিসৌধ।

পাথরে-বানানো পায়ে-চলা একটা পথে বালি উড়িয়ে আনছে মরুর বাতাস, ওখানে গিয়ে নিঃশব্দে থামল দলটা। কান খাড়া করল তাদের দলনেতা মেনুহোটেপ, আরেকটু শক্ত করে আঁকড়ে ধরল হাতের বর্শাটা। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল।

কয়েকটা পরিবার আছে তার সঙ্গে। কয়েকজন পরিচারকও আছে, বহন করছে পরিবারগুলোর ছোট ছোট বাচ্চাদের।

মেনুহোটেপের পাশে গিয়ে দাঁড়াল ওর স্ত্রী। কিছু শুনতে পাচ্ছ?

মাথা ঝাঁকাল মেনুহোটেপ। মনে হচ্ছে, কারা যেন ফিসফিস করে কথা বলছে।

কিন্তু এই শহর পরিত্যক্ত। এই সমাধিক্ষেত্রে প্রবেশের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন ফারাও। এখানে এসে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়েছি আমরা।

আলখাল্লার হুড ফেলে দিল মেনুহোটেপ। দেখা যাচ্ছে তার কামানো-চাঁদি, আর গলায় সোনার একটা নেকলেস। কণ্ঠহারটা নিঃশব্দে বলে দিচ্ছে, ফারাও আখেনেতেনের রাজদরবারের একজন সদস্য সে। ঝুঁকি? কিছুটা বেপরোয়া কণ্ঠে বলল, ওই ব্যাপারে আমার চেয়ে ভালো আর কে জানে?

অ্যাবাইদোস এখন মৃত্যুপুরী, অথচ একসময় এটা ছিল জাঁকজমকপূর্ণ, কর্মব্যস্ত এক নগরী। কারণ মৃত্যুদেবতা এবং পরকালের শাসক ওসিরিসের পূজারী পুরোহিত আর তাঁদের সহকারীরা থাকতেন এখানে। শহরের এককোনায় আছে গোরস্থান; ফারাও রাজবংশের বেশিরভাগ শাসক এবং সাম্প্রতিক কয়েকজন রাজাকে তাদের মৃত্যুর পর দাফন করা হয়েছে এখানে। কয়েক বছর আগেও এখানে তৈরি করা হয়েছে মন্দির, ওসিরিসের সম্মানার্থে নির্মাণ করা হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ।

কিন্তু আখেনেতেন সিংহাসনে বসেই বদলে দিলেন সব।

ফারাও হওয়ার পর এমন এক কাজ করে বসলেন তিনি যা কখনও চিন্তাও করেনি কেউ। প্রাচীন সমস্ত দেবতাকে অস্বীকার করলেন তিনি, স্রেফ প্রত্যাখ্যান করলেন। হুকুম জারি করে নিষিদ্ধ করলেন তাঁদেরকে, অবসান ঘটালেন তাঁদের উদ্দেশে সবরকমের পূজাঅর্চনা অনুষ্ঠানের। সব দেবতার মূর্তিসহ একটা মন্দির ছিল মিশরে, ভেঙে গুঁড়ো করে ফেলা হলো মূর্তিগুলো। তাঁরই আদেশে ওই মন্দিরে বসানো হলো সূর্যদেবতা আতেনের মূর্তি, ঘোষণা করা হলো তিনিই এখন থেকে মিশরের একমাত্র দেবতা।

এই ঘটনার পর, স্বাভাবিকভাবেই, মৃত্যুপুরীতে পরিণত হলো অ্যাবাইদোস। প্রাণ বাঁচাতে যে যেদিকে পারলেন পালিয়ে গেলেন ওসিরিসের পূজারী পুরোহিতরা। কারণ আখেনেতেন ততদিনে আদেশ জারি করেছেন, যাকেই পাওয়া যাবে ওই শহরের ত্রিসীমানায়, তাকেই কতল করা হবে।

মেনুহোটেপের মতো রাজদরবারের কেউ যদি ধরা পড়ে এখানে, তা হলে শাস্তি হবে আরও ভয়াবহ: যতক্ষণ পর্যন্ত না নিজের মৃত্যু প্রার্থনা করে কাতরাতে থাকবে আদেশ লঙ্ঘনকারী, ততক্ষণ তার উপর চালিয়ে যাওয়া হবে বীভৎস অত্যাচার।

কিছু একটা বলার জন্য মুখ খুলতে যাচ্ছিল মেনুহোটেপ, কিন্তু বলল না–অনতিদূরে নড়াচড়া টের পেয়েছে। অন্ধকার ভেদ করে ছুটে আসছে তিনজন লোক, অস্ত্র দেখা যাচ্ছে ওদের হাতে।

স্ত্রীকে একধাক্কায় একটা স্মৃতিস্তম্ভের গাঢ় ছায়ার দিকে ঠেলে দিল মেনুহোটেপ, পরমুহূর্তেই ঘুরে মুখোমুখি হলো ওই তিনজনের। একটুও দেরি না করে নিজের বর্শাটা ছুঁড়ে মারল একজনকে লক্ষ্য করে। সবার আগে ছুটছিল যে-লোক, তার বুকে গিয়ে বিদ্ধ হলো ওটা। থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল সে, পরক্ষণেই লুটিয়ে পড়ল। কিন্তু বাকি দুজন ততক্ষণে মেনুহোটেপের অনেক কাছে এসে পড়েছে। ওকে ঘাই মারল একজন ব্রোঞ্জের খঞ্জর দিয়ে।

শরীর মুচড়ে সরে যাওয়ার চেষ্টা করল মেনুহোটেপ, পারল না ঠিকমতো, পড়ে গেল। বাঁচার তাগিদে চার হাত পায়ে ভর দিয়ে উঠে বসল মুহূর্তের মধ্যে, বিড়ালের মতো কয়েক লাফে গিয়ে হাজির হলো বুকে-বর্শা-নিয়ে পড়ে-থাকা লোকটার কাছে। একঝটকায় আলগা করে নিল বর্শাটা। দুই হামলাকারী আবার কাছে এসে পড়েছে টের পেয়ে, ঘুরেই বর্শার ফলা দিয়ে গুতো মারার চেষ্টা করল একজনকে। একলাফে সরে গিয়ে নিজেকে বাঁচাল লোকটা।

কিন্তু মেনুহোটেপের বর্শা থেকে বাঁচতে পারলেও মৃত্যুর কবল থেকে বাঁচতে পারল না সে। তার দিকে উড়ে এল আরেকটা বর্শা, পিঠ দিয়ে ঢুকে পেট ফুটো করে বেরিয়ে এল ফলাটা। খুশিতে মৃদু চিৎকার করে উঠল লড়াইয়ে-যোগ-দেয়া একজন ভৃত্য।

হাঁটু আপনাআপনি ভাঁজ হয়ে গেছে মুমূর্ষ লোকটার, বসে পড়তে বাধ্য হয়েছে। দম নেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছে, ব্যথায় চিৎকার করার চেষ্টা করছে, কিন্তু কোনওটাই পারছে না। একদিকে কাত হয়ে পড়ে গেল, নড়ছে না।

অবস্থা বেগতিক, বুঝতে দেরি হয়নি তৃতীয় হামলাকারীর। ঘুরেই ছুট লাগিয়েছে প্রাণ বাঁচানোর উদ্দেশ্যে। ছোট্ট একটা লাফ দিয়ে আগে বাড়ল মেনুহোটেপ, পা দুটো জমিন স্পর্শ করামাত্র সর্বশক্তিতে ছুঁড়ে মারল বর্শাটা পলায়নরত লোকটাকে লক্ষ্য করে। একটুর জন্য বেঁচে গেল লোকটা। তারপর কয়েক মুহূর্তের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল অন্ধকারে।

চোর নাকি? জিজ্ঞেস করল কে যেন। কবর খুঁড়ে ভিতর থেকে সোনাদানা নিতে এসেছিল?

হতে পারে, বলল মেনুহোটেপ। আবার গুপ্তচরও হতে পারে। গত কয়েকদিন থেকেই আমার মনে হচ্ছে, কারা যেন অনুসরণ করছে আমাদেরকে।

জলদি করতে হবে আমাদের, বলল আরেকজন। যে লোক পালিয়ে গেছে সে যদি দরবারে গিয়ে আমাদের কথা বলে, আগামীকাল সকাল হওয়ার আগেই মরব সবাই।

আমাদের এই জায়গা ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত, বলল মেনুহোটেপের স্ত্রী। আমরা ভুল করছি।

হ্যাঁ, ভুল করেছি আমরা, স্বীকার করার ভঙ্গিতে বলল মেনুহোটেপ, তবে সেটা এখানে এসে না, আখেনেতেনের কথা মান্য করে। ওর কথামতো ওসিরিসকে অস্বীকার করেছি, ফলে শাস্তি দিয়েছেন তিনি। এখন উপায় একটাই: ওসিরিসের কাছে নতজানু হয়ে ক্ষমাপ্রার্থনা করতে হবে। …চলো।

শহরের আরও ভিতরে ঢুকে পড়ল দলটা। সবচেয়ে বড় স্থাপনার সামনে হাজির হতে বেশি সময় লাগল না। ওসিরিসের মন্দির নামে পরিচিত এই ভবন।

দালানের ছাদটা চওড়া, সমতল। উঁচু উঁচু অনেকগুলো স্তম্ভ যেন ঠেক দিয়ে রেখেছে ছাদটাকে। স্তম্ভগুলোর ভিত্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে গ্ল্যানেটের বড় বড় ব্লক। মন্দিরের পুরোভাগে নিঃসঙ্গ নিঃশব্দ প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে ব্রোঞ্জের বিশালকায় একটা দরজা। ওটার কাছে গিয়ে হাজির হলো মেনুহোটেপ, ধাক্কা দিল পাল্লায়।

আশ্চর্য! দরজাটা খোলা!

ভিতরে ঢুকে পড়ল ও একে একে।

পাথর কেটে চমৎকারভাবে বানানো একটা প্ল্যাটফর্মের দিকে এগিয়ে গেছে ক্রমশ-উঁচু-হওয়া একটা পথ, সিঁড়ির পরিবর্তে ব্যবহৃত হচ্ছে পথটা। মেঝের প্রায় পুরোটাই ইথিয়োপিয়ান মার্বেলের, পার্শিয়ান নীলকান্তমণির সঙ্গে গ্র্যানেট মিশিয়ে বানানো বিচিত্র নকশা আছে জায়গায় জায়গায়।

ধূপের হালকা গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। বেদীর সামনে আগুন জ্বলছে, দুদিকের দেয়ালের হুকে আটকে দেয়া হয়েছে একটা করে জ্বলন্ত মশাল। আবারও আশ্চর্য না হয়ে পারল না মেনুহোটেপ।

অনতিদূরে অনুজ্জ্বল আলোয় অস্পষ্টভাবে চোখে পড়ে অর্ধবৃত্তাকারে সাজানো কয়েকটা বেঞ্চ। বেশ কয়েকটা লাশ, সেইসঙ্গে কয়েকজন মৃতপ্রায় নারী-পুরুষ-শিশুকে শুইয়ে রাখা হয়েছে সেসব বেঞ্চে। ওদেরকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে ওদের পরিবারের জীবিত সদস্যরা। কাঁদতে চেয়েও কাঁদতে পারছে না তারা, তাই ফোঁপাচ্ছে। কেউ কেউ এত নিচু গলায় প্রার্থনা করছে যে, শুনলে মনে হয় ফিসফিস করছে।

আমাদের মতো আরও কেউ অমান্য করেছে আখেনেতেনের আদেশ, নিচু গলায় বলল মেনুহোটেপ।

বেঞ্চগুলো ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকদের কেউ কেউ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল ওর দিকে। কোনও প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না ওদের কারও মাঝে।

মন্দিরের যেখানেই সুবিধাজনক জায়গা পাচ্ছে সেখানেই বয়ে-আনা বাচ্চাগুলোকে নামিয়ে রাখছে চাকররা। ইতিমধ্যে ওসিরিসের বেদীর উদ্দেশে হাঁটছে মেনুহোটেপ। আগুনের কাছে গিয়ে বসে পড়ল হাঁটু গেড়ে, অনুনয় করার ভঙ্গিতে নত করে ফেলেছে মাথা। আলখাল্লার ভিতর থেকে বের করল উটপাখির দুটো পালক।

মৃত্যুদেবতা, ফিসফিস করে বলছে সে, পরকালের অধিপতি, সীমাহীন দুঃখকষ্টে পতিত হয়ে আজ আপনার কাছে এসেছি। রহস্যময় অসুখে অসুস্থ হয়ে পড়েছে আমার পরিবারের সদস্যরা। অভিশপ্ত হয়ে গেছে আমাদের ঘরবাড়ি। মরুভূমির মতো বিরান হয়ে গেছে আমাদের চাষের জমি। একটার পর একটা গরুবাছুর মারা পড়ছে। …দেবতা, আপনি যদি মৃত্যুই নির্ধারিত করে থাকেন আমাদের জন্য, তা হলে আমাদের যারা মারা যাচ্ছে তাদেরকে পরকালে সুখী করুন। আপনাকে ভুলে গিয়ে পাপ করেছি আমরা, আপনি দয়া করে ক্ষমা করুন আমাদেরকে। আপনি দয়া করে জীবন ফিরিয়ে দিন আমাদের পরিবারের সদস্যদের। অভিশাপ তুলে নিন। আমাদের চাষের জমিন আর গরুবাছুরের উপর থেকে।

শ্রদ্ধাবনত ভঙ্গিতে পালক দুটো নামিয়ে রাখল সে বেদীর উপর, সিলিকা আর স্বর্ণগুড়ার মিশ্রণ ছিটিয়ে দিল ওগুলোয়। তারপর উঠে দাঁড়াল, আগুনের দিকে উল্টো না-ঘুরে নেমে এল বেদী থেকে।

একঝলক বাতাস বয়ে গেল মন্দিরের ভিতরে, একদিকে কাত হয়ে গেল মশাল দুটোর অগ্নিশিখা। অদ্ভুত এক গুম গুম শব্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে দূরে কোথাও।

চট করে ঘুরে শব্দের উৎসের দিকে তাকাল মেনুহোটেপ।

বন্ধ হয়ে গেছে মন্দিরের দরজাটা। সমানে কাঁপছে মশালের অগ্নিশিখা, যে-কোনও সময় নিভে যেতে পারে। কিন্তু শেষপর্যন্ত নিভল না কোনওটাই। বাতাস বন্ধ হয়ে গেল, আবার আগের মতো জ্বলছে মশাল দুটো। বেদীটা আগের চেয়ে বেশি আলোকিত মনে হচ্ছে।

চমকে উঠল মেনুহোটেপ-বেদীর উপর দেখা যাচ্ছে পাঁচটা ছায়ামূর্তি। অথচ মেনুহোটেপ নিশ্চিত কয়েক মুহূর্ত আগেও ওরা ছিল না সেখানে। যা দেখছে, তা ভেলকিবাজি বলে মনে হচ্ছে ওর।

কালচে সোনালি কাপড় পরে আছে চার ছায়ামূর্তি-ওসিরিসের পূজারীরা ও-রকম কাপড় পরত একসময়। পঞ্চমজনের গায়ের ভিন্ন পোশাক দেখলে মনে হয়, তিনি প্রেতলোকের প্রভু। কোমর আর দুই পায়ে চওড়া সাদা ফিতা পেঁচিয়ে রেখেছেন তিনি মমির-গায়ে-পেঁচানো ব্যাণ্ডেজের কায়দায়। অদ্ভুত সবুজাভ চামড়ায় শোভা পাচ্ছে সোনার ব্রেসলেট, নেকলেস আর অন্যান্য অলঙ্কার। উটপাখির পালকওয়ালা একটা মুকুট দেখা যাচ্ছে মাথায়। তাঁর একহাতে রাখালছেলেদের মতো বাঁকা ছড়ি, অন্যহাতে শস্য মাড়াই করার সেকেলে কস্তনী।

আমি ওসিরিসের বার্তাবাহক, অনুনাদে ভরা ভারী গলায় বললেন তিনি। পরকালের প্রভুর অবতার।

তাঁর উদ্দেশে মাথা নোয়াল মন্দিরে উপস্থিত সবাই।

বাকি চার ছায়ামূর্তি ধীর পায়ে নেমে আসছে বেদী থেকে। বেঞ্চগুলোর কাছে গিয়ে হাজির হলো ওরা। মৃত অথবা প্রায় মৃত মানুষগুলোর আশপাশে ছড়িয়ে দিচ্ছে গাছের পাতা, ফুল, পাপড়ি এবং সরীসৃপ ও উভচরদের শুকনো চামড়া।

ওসিরিসের আশীর্বাদ চাও তোমরা, বললেন স্বঘোষিত অবতার। কিন্তু একজন বিশ্বাসঘাতকের সঙ্গে হাত মিলিয়েছ সবাই। কাজেই তোমরাও বিশ্বাসঘাতক।

মেনুহোটেপসহ বাকিদের মাথা আপনাআপনি নিচু হয়ে গেল।

মাথা নিচু করে রেখেই মেনুহোটেপ বলল, স্বীকার করছি, আখেনেতেনের কথা মতো কাজ করে পাপ করেছি। কিন্তু, প্রভু, আমাদের বাচ্চারা তো কোনও অপরাধ করেনি! পরকালের সুখশান্তির যে-প্রতিজ্ঞা করেছেন মহান ওসিরিস, আমি প্রার্থনা করি তা দেয়া হোক ওদেরকে।

কোনও জবাব এল না।

মুখ তুলে তাকাল মেনুহোটেপ।

ওর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন “অবতার”, কালো দুই চোখের পলক পড়ছে না। বললেন, তুমি যে আসলেই অনুশোচনায় ভুগছ, তা প্রমাণ করে দেখাতে বলেছেন ওসিরিস।

কী করতে হবে আমাকে? নিজের বুকের ধুকপুকানি টের পাচ্ছে মেনুহোটেপ।

বেদীর একদিকে রাখা আছে একটা লাল অ্যামফোরা, কঙ্কালসার আঙুলের ইশারায় ওটা দেখিয়ে “অবতার” বললেন, স্বাদহীন একজাতের বিষ আছে ওটার ভিতরে। অন্ধ করে দেয়। নিয়ে যাও কলসিটা। বিষ মিশিয়ে দাও আখেনেতেনের মদৈ।

দ্বিধা করছে মেনুহোটেপ। আখেনেতেনের আদেশ অমান্য করা এক কথা, কিন্তু লোকটাকে বিষ খাইয়ে অন্ধ করে দেয়া…

নড়ে উঠলেন “অবতার”, বেদীর আগুনে ঢুকিয়ে দিলেন কস্তনীর একটা প্রান্ত। আগুন লেগে গেল ওই প্রান্তের সঙ্গে আটকানো চামড়ার তন্তুগুলোতে, পরমুহূর্তেই ছোট একটা বিস্ফোরণের মাধ্যমে বর্ধিত হলো অগ্নিশিখা-দাহ্য কোনও তরল মাখানো ছিল ওগুলোয়। একটু আগে যেসব পাতা ছিটিয়েছে “অবতারের” চার অনুসারী, জ্বলন্ত কস্তনী দিয়ে সেগুলোতে আগুন লাগিয়ে দিলেন তিনি। আগুনের একটা রেখা ছড়িয়ে পড়ল বেদীর উপর।

উত্তাপ লাগছে গায়ে, আরও পিছিয়ে এল মেনুহোটেপ। অসহ্য ঠেকছে ধোঁয়া আর পোড়াপাতার গন্ধ, কেমন ঝাপসা হয়ে আসছে দৃষ্টি, মাথা ঘুরাচ্ছে। চোখ কচলাচ্ছিল সে; আবার যখন তাকাল বেদীর দিকে, ততক্ষণে পাতায় লাগানো আগুন আরও বেড়েছে, লাশ এবং সেগুলো ঘিরে যারা শোক করছিল তাদেরকে যেন ঘিরে ধরছে চক্রাকারে। ওদিকে চার অনুসারীকে নিয়ে গায়েব হয়ে যাচ্ছেন “অবতার”-বেদীর পেছনের একটা সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাচ্ছেন।

এটা কী করলে? চিৎকার করে উঠল মেনুহোটেপের স্ত্রী। কেন কোনও জবাব দিলে না অবতারকে?

আমি ঘাবড়ে গেছি, বিড়বিড় করে বলল মেনুহোটেপ। ভাবল, ওদের সবাইকে শেষ সুযোগ দিয়েছিলেন ওসিরিস, কিন্তু সেটা নিতে পারল না সে।

মর্মবেদনায় ভুগতে ভুগতে বেদীর সেই বিষের অ্যামফোরার দিকে তাকাল মেনুহোটেপ। তাপে কাঁপছে বাতাস, মনে হচ্ছে কাঁপছে কলসিটাও–আস্তে আস্তে ঝাপসা হয়ে আসছে যেন।

একসময় ধোঁয়া এত বেড়ে গেল যে, আরও পিছিয়ে আসতে বাধ্য হলো মেনুহোটেপ। আবার চোখ কচলাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর যখন চোখ খুলে তাকাল, ততক্ষণে বাড়ন্ত ধোঁয়া অদৃশ্য করে দিয়েছে অ্যামফোরাটাকে।

আগুন নিভে গেল একসময়, বেদীর উপর এখন জায়গায় জায়গায় পড়ে আছে শুধু ছাই। পাতলা ধোঁয়ার একটা চাদরও আছে, ক্ষণে ক্ষণে আকার বদল করছে সেটা। কে বা কারা যেন খুলে দিয়েছে মন্দিরের দরজাটা, সেখান দিয়ে ঢুকছে ঠাণ্ডা বাতাস।

ছোট্ট কয়েকটা আঙুল কাঁপতে দেখে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল মেনুহোটেপ। এমনভাবে কাঁপছে ওর মেয়েটা, যেন আক্রান্ত হয়েছে তীব্র জ্বরে। ডাঙায় তোলা মাছের মতো বার বার হাঁ করছে বেচারী, যেন দম নিতে পারছে না।

মেয়ের দিকে এগিয়ে গেল মেনুহোটেপ। বেচারীর গা আসলেই গরম। পুরো শরীরটা কাঁপছে সমানে। একই অবস্থা হয়েছে মেনুহোটেপের ছেলেরও।

ওরা কিছু বলতে চাইছে কি না, বোঝার চেষ্টা করল মেনুহোটেপ, কিন্তু পারল না। থামানোর চেষ্টা করল ওদের কাপুনি, তা-ও পারল না। অসহায়ের মতো আবার তাকাল এদিকওদিক।

অসুস্থ হয়ে পড়া বাচ্চাদের প্রায় সবারই একই অবস্থা হয়েছে।

কী হয়েছে ওদের? চাপা গলায় জানতে চাইল মেনুহোটেপের স্ত্রী।

জীবন আর মরণের মাঝখানে আটকা পড়েছে মনে হয়, বলল মেনুহোটেপ। ইসস…না জানি কী কষ্ট হচ্ছে বাচ্চাগুলোর!

কী হবে এখন?

দ্বিধা কেটে গেল মেনুহোটেপের, সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল সে। ওসিরিস যা চান তা-ই হবে। আখেনেতেনের মদে বিষ মিশিয়ে দেব আমি।

উঠে দাঁড়াল সে, এগিয়ে যাচ্ছে বেদীর দিকে। অ্যামফোরাটা জায়গামতোই আছে, তবে ধোয়ার স্কুলের কারণে লাল রঙ বদলে গিয়ে কালচে হয়ে গেছে। দুহাতে হাতল ধরে কলসিটা তুলে নিল মেনুহোটেপ নতুন বিশ্বাস আর আশা ভর করেছে ওর উপর।

এবার অবস্থার পরিবর্তন হবে।

বাকিদেরকে সঙ্গে নিয়ে মন্দির ছেড়ে বেরিয়ে গেল সে।

.

০১.

একবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকের তুলনায় এম.ভি, টায়ানাকে পুরনোই বলা চলে।

জাহাজটা দৈর্ঘ্যে তিন শ ফুট। ওটার কাঠামো স্টিলের। শুরুতে ছিল একটা ফ্রেইটার। নির্মিত হয়েছিল উনিশ শ তিয়াত্তর সালে। ওটার বয়স যত বেড়েছে, গতি তত কমেছে; কাজেই ওটাকে এখন একটা কোস্টার হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।

টায়ানা এই মুহূর্তে আছে মাল্টা উপকূল থেকে সত্তর মাইল পশ্চিমে, আজ রাত থাকতেই ছেড়েছে মাল্টার বন্দর। এগিয়ে চলেছে ইটালি-নিয়ন্ত্রিত দ্বীপ লিনোসার দিকে। লিবিয়া, সিসিলি, মাল্টা আর গ্রিসসহ ভূমধ্যসাগরের কয়েকটা দ্বীপে বাণিজ্যিক কার্যক্রম চালাচ্ছে ওটা।

ভোরের আলো এখনও ফোটেনি, তারপরও ব্রিজে জড়ো হয়েছে বেশ কয়েকজন নাবিক। তাদের সবাই উদ্বিগ্ন। গত প্রায় এক ঘণ্টা ধরে অচেনা একটা জাহাজ পিছু নিয়েছে টায়ানার। একটা বাতিও জ্বলছে না ভূতুড়ে ওই জাহাজে। ব্যাপারটা প্রভাব ফেলেছে নাবিকদের মনে।

হুইলের দায়িত্বে থাকা শিপমাস্টারের নাম শেলড্রেক, গাঁট্টাগোট্টা এক লোক। পাইল ড্রাইভারের মতো বাহু ওর, চুল সাদাকালো, গালের না-কামানো দাড়ি দেখলে মনে হয় শিরিশ কাগজের কথা। জিজ্ঞেস করল, ওরা কি এখনও লেগেই আছে আমাদের পেছনে?

হ্যাঁ, চেঁচিয়ে জবাব দিল ফার্স্ট মেইট। যতবার কোর্স বদল করছি আমরা, ততবার তা-ই করছে ওরাও। এবং এগিয়ে আসছে আস্তে আস্তে।

আমাদের সব লাইট নিভাও, আদেশ দিল শেলড্রেক।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আবছা অন্ধকারে ঢাকা পড়ল টায়ানা।

জাহাজের দিক আরেকবার পাল্টাল শেলড্রেক।

ওদের কাছে রেইডার অথবা নাইট ভিশন গগলস থাকলে কোর্স বদলে লাভ হবে না, বলল ফার্স্ট মেইট।

অন্তত কিছুটা হলেও সময় আদায় করে নিতে পারব আমরা, কণ্ঠ শুনে বোঝা গেল অনিশ্চয়তায় ভুগছে শেলড্রেক।

ওরা কাস্টমসের লোকও তো হতে পারে? বলল আরেকজন নাবিক। অথবা ইটালিয়ান কোস্ট গার্ডঃ

মাথা নাড়ল শেলড্রেক। কাস্টমস বা কোস্টগার্ড জানান দিয়ে আসে, বাতি নিভিয়ে ভূতের মতো আসে না।

কথাটা বুঝতে পারল ফার্স্ট মেইট। মাফিয়া?

মাথা ঝাঁকাল শেলড্রেক। ওদের সঙ্গে বনিবনা করে নেয়া উচিত ছিল আমাদের। ওদের জলসীমাতেই চোরাকারবারি করছি আমরা। খবর পেয়ে গেছে ওরা, হাজির হয়েছে ভাগ বসাতে। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখল, খসাতে পারেনি পেছনের জাহাজটাকে।

আসলে একটা সুযোগ নিতে চাইছিল সে। ভেবেছিল, শেষরাতের অন্ধকার যতক্ষণ আছে, বার বার দিক পাল্টে ফাঁকি দিতে পারবে ভূতুড়ে জাহাজটাকে। কিন্তু বেশিরভাগ জুয়াড়িই প্রতি দশ দানে জেতে এক কি দুবার।

অস্ত্র বের করো, নতুন আদেশ দিল সে। লড়াই করতে হবে।

কিন্তু যে-জিনিস বহন করছি আমরা, ফাস্ট মেইটের কণ্ঠে একইসঙ্গে প্রতিবাদ আর দ্বিধা, লড়াই করলে তার ফল কী হবে…

কথাটা ভাবছে শেলড্রেকও। শিপিং কন্টেইনার দিয়ে বোঝাই হয়ে আছে টায়ানা, বেশিরভাগ কন্টেইনারে লুকানো আছে বড় বড় প্রেশারাইড়-ট্যাঙ্ক, ভিতরে তরলীকৃত প্রোপেন। স্মাগলিং করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বিশটা রহস্যময় ব্যারেল, ভিতরে হাশিশ আছে বলে ধারণা করছে টায়ানার সবাই, মোটা টাকার বিনিময়ে ওগুলো জাহাজে তুলেছে হানুফের খালফানি নামের মিশরীয় এক লোক। ব্যারেলগুলো কোনও ব্যাপার না, আসল ব্যাপার হচ্ছে প্রোপেন। ইউরোপের বন্দরগুলোতে তরলীকৃত জ্বালানির শুল্কমূল্য চড়া, তাই একেকটা প্রেশারাইড়-ট্যাঙ্ক যেমন একেকটা বোমা, তেমনই একেকটা স্বর্ণখনিও।

শেলড্রেক বলল, মাফিয়ার হাতে ধরা পড়লে টাকা তো দিতে হবেই, মালও খোয়াতে হবে। এমনকী জানও যেতে পারে।

মাথা নাড়ল ফার্স্ট মেইট। আরেকজনের প্রোপেনের জন্য জান দিতে রাজি না আমি। যাই, অস্ত্র নিয়ে আসি।

ওর দিকে একটা চাবি ছুঁড়ে দিল শেলড্রেক। ঘুম থেকে ডেকে তোলো সবাইকে।

ওয়েপনস্ লকারের দিকে ছুট লাগাল ফার্স্ট মেইট।

একদিক দিয়ে উধাও হলো সে, আরেকদিক দিয়ে হুইলহাউসে আবির্ভাব ঘটল খালফানির। লোকটা লম্বা, হালকাপাতলা। দৃষ্টি অন্তর্ভেদী, চাঁদি কামিয়ে রাখে সবসময়। গায়ের রঙ ক্যারামেলের মতো। ভোতা গলায় বলল, জাহাজের সব বাতি নিভিয়ে দেয়া হলো কেন? আর বার বার দিক বদল করে আসলে কোথায় যাচ্ছি আমরা?

উত্তরটা কষ্ট করে অনুমান করে নিন নিজেই, ইঙ্গিতে পেছনের জাহাজটা দেখিয়ে দিল শেলড্রেক।

খালফানি বুঝতে পারল, ঘটনা কী। জামার নিচে, ট্রাউজারের বেল্টে আটকানো একটা নাইন মিলিমিটার পিস্তল বের করল। ওটা আলগোছে ধরে এগিয়ে গেল দরজার দিকে, একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কালো সাগরের দিকে।

পেছনে না দেখালাম? খালফানি ভুল জায়গায় দেখছে ভেবে শুধরে দেয়ার চেষ্টা করল শেলড্রেক।

কিন্তু পরমুহূর্তেই প্রমাণিত হলো, আসলে ভুল হয়েছে শেলড্রেকেরই। অন্ধকার চিরে দিল আলোর দুটো রেখা। একটার কারণে উদ্ভাসিত হয়েছে ব্রিজ, আরেকটা নেচে বেড়াচ্ছে রেইলিং-এর উপর।

ছুটে আসছে দুটো রাবার বোট। টায়ানার নাক ঘুরিয়ে নিল শেলড্রেক, পিষে ফেলতে চায় বোট দুটোকে। কিন্তু কোনও লাভ হলো না, ওর উদ্দেশ্য বুঝে গেছে বোটের চালকরা। চট করে দুদিকে সরে গেল ওরা, মাঝখানের গ্যাপ দিয়ে টায়ানা বেরিয়ে যেতেই পিছু নিতে শুরু করল ওটার। দূরত্ব কমাচ্ছে আস্তে আস্তে।

সুযোগ বুঝতেই বোট দুটো থেকে ছুঁড়ে মারা হলো দুটো হুক, টায়ানার রেইলিঙের সঙ্গে আটকে গেল ওগুলো। হুকের সঙ্গে আটকানো ধাতব দড়ি বেয়ে বোট থেকে জাহাজে উঠে আসার চেষ্টা করছে দুই দল সশস্ত্র লোক।

গুলির আওয়াজ পাওয়া গেল। অটোমেটিক ফায়ারআর্ম চালানো হচ্ছে একটা বোট থেকে।

মাথা নামান! খালফানির উদ্দেশে চেঁচিয়ে উঠল শেলড্রেক।

ব্রিজের একটা জানালা চুরমার করে দিয়ে ভিতরে ঢুকেছে কয়েকটা বুলেট, উল্টোদিকের ধাতব দেয়ালে লেগেছে। কিন্তু কোনও ভাবান্তর হয়নি খালফানির চেহারায়। ধীর পায়ে হেঁটে বাল্কহেডের ভিতরে ঢুকে পড়ল সে, একবার উঁকি দিয়ে দেখল বাইরে, পরমুহূর্তে কয়েকবার গর্জে উঠল ওর নাইন মিলিমিটার।

আশ্চর্য হয়ে গেল শেলড্রেক, লোকটার নিশানা সাংঘাতিক। ধাতব দড়ি বেয়ে যারা উঠে আসছিল তাদেরকে কভার দিতে গুলি চালানো হচ্ছিল একটা বোট থেকে, টায়ানার ডেকে উঠেও পড়েছিল দুজন, কিন্তু দুজনই কপালে একটা করে ছিদ্র নিয়ে পড়ে আছে রেইলিং ঘেঁষে। খালফানির তিন নম্বর গুলিতে, অকেজো হয়ে গেছে একটা বোটের স্পটলাইট।

লোকটা জানত, স্ফুলিঙ্গ লক্ষ্য করে পাল্টা জবাব দেয়া হবে কোনও-না-কোনও বোট থেকে, তাই নিজের ভেল্কিবাজি দেখিয়েই চট করে সরে গেছে আরেকদিকে।

বোট দুটো থেকে আসা দ্বিতীয়বারের বুলেটবৃষ্টি কাঁপিয়ে দিল হুইলহাউসটাকে। একটা বুলেট আঁচড় কেটে গেল শেলড্রেকের এক বাহুতে। রেগে গেল সে। হুইল ছেড়ে দিয়ে শোল্ডার হোলস্টার থেকে বের করল ওর পিস্তল, প্রস্তুত হয়ে গেছে লড়াইয়ের জন্য। খালফানির খোঁজে এদিকওদিক তাকাচ্ছে। অনতিদূরে গা ঢাকা দিয়ে এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে লোকটা যে, ওর ছায়ামূর্তি দেখতে পাবে না বোটের কেউ।

আবারও গুলির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে, এবার জাহাজের পেছনদিক থেকে। বসে পড়েছিল শেলড্রেক, সুযোগ বুঝে উঠে দাঁড়াল, চুরমার হয়ে যাওয়া জানালা দিয়ে গুলি করল দুবার।

বুলেটের অপচয় করছ, বলল খালফানি। দুই বোট থেকে কম-করে-হলেও একডজন লোক হাজির হয়ে গেছে ডেকে, সংখ্যাটা বেশিও হতে পারে। জাহাজের পেছনদিকে ঘেঁষার চেষ্টা করছে তৃতীয় আরেকটা বোট।

আরেকদফা বুলেটবৃষ্টি হলো টায়ানার পেছনদিক থেকে, প্রমাণিত হলো খালফানির কথাই ঠিক।

ওয়েপন্স লকারটা জাহাজের পেছনদিকে, অসহায়ের মতো শোনাল শেলড্রেকের কণ্ঠ। আমার লোকেরা যদি ওখানে পৌঁছাতে না পারে, স্রেফ কচুকাটা হয়ে যাব।

বাল্কহেডের দরজার দিকে এগিয়ে গেল খালফানি, একটু ফাঁক করল ওটা, তাকাল প্যাসেজের দিকে। মনে হয় ইতোমধ্যেই কচুকাটা হয়ে গেছে তোমার লোকেরা।

থপ্ থপ্ আওয়াজ করতে করতে প্যাসেজ ধরে এগিয়ে আসছে কে যেন। শব্দের উৎস লক্ষ্য করে পিস্তল তুলল। শেলড্রেক। কিন্তু গুলি করার দরকার হলো না–দরজা আরও ফাঁক করেছে খালফানি, খোঁড়াতে খোঁড়াতে হুইলহাউসের ভিতরে ঢুকে পড়েছে টায়ানার এক রক্তাক্ত নাবিক। বলল, নিচের ডেক দখল করে নিয়েছে ওরা। ওয়েপন্স্ লকারের কাছেও যাওয়ার সুযোগ পাইনি আমরা।

পেট চেপে ধরল সে, বুলেট ক্ষত তৈরি করেছে সেখানে, সমানে রক্ত বের হচ্ছে। মেঝেতে আছড়ে পড়ল, নড়ছে না।

আবারও গুলির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। খুব সম্ভব গুলি করতে করতে এগিয়ে আসছে দখলদাররা, সামনে যাকে পাচ্ছে তাকেই শেষ করে দিচ্ছে।

হুইল ছেড়ে দিয়ে আহত নাবিকের দিকে এগিয়ে গেল শেলড্রেক।

ওর কথা ভুলে যাও, কড়া গলায় বলল খালফানি। পালাতে হবে আমাদেরকে।

সহকর্মীদের মৃত্যুর মুখে ফেলে পালাতে ঘৃণা করে শেলড্রেক, কিন্তু আহত লোকটার জন্য আসলেই কিছু করার নেই ওর। টের পেল, রক্তপিপাসা জেগে উঠেছে ওর ভিতরে। পিস্তলটা কক করে হ্যাঁচওয়ের দিকে পা বাড়াল সে। কিন্তু ওকে খামচে ধরল খালফানি।

যেতে দাও আমাকে, ভয়ঙ্কর গলায় বলল শেলড্রেক।

খামোকা মরতে চাও?

আমার লোকদের নির্বিচারে খুন করছে ওরা। ওদের যতজনকে পারি শেষ করতে চাই।

যারা ইতোমধ্যেই খুন হয়ে গেছে তাদের কথা ভেবে কোনও লাভ আছে? বরং আমার মালের কথা ভাবো।

এই পরিস্থিতিতেও থতমত না খেয়ে পারল না শেলড্রেক। তুমি কি পাগল? তোমার ওই হাশিশ নিয়ে পালানোর কথা ভাবছ কী করে?

হাশিশ? বিশকে দুই ভেবে নিয়েছ নিজে নিজেই?

মানে?

জায়গামতো নিয়ে চলো আমাকে, নিজেই বুঝে যাবে।

কিন্তু পালাবে কীভাবে?

 আহ্, ওটা আমার দায়িত্ব।

অন্ধকারেও যেন জ্বলজ্বল করছে খালফানির চোখ, সেদিকে তাকালে ঐকান্তিকতা টের পাওয়া যায়।

হয়তো…সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল শেলড্রেক…মিথ্যা বলছে না লোকটা। চলো। দরজা দিয়ে বের না হয়ে এগিয়ে গেল চুরমার হওয়া জানালার দিকে। ওটা গলে বেরিয়ে লাফিয়ে পড়ল সবচেয়ে কাছের কন্টেইনারের উপর। ছফুট নিচে লাফ দিতে হয়েছে ওকে, তাল সামলাতে পারেনি অন্ধকারে, ব্যথা পেল একহাঁটুতে।

লাফিয়ে ওর ঠিক পেছনেই ল্যাণ্ড করল খালফানি, কিছুই হলো না ওর। বরং মুহূর্তের মধ্যে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে গেছে কিছুদূর, অপেক্ষা করছে শেলড্রেকের জন্য।

উঠে দাঁড়াল শেলড্রেক, হাঁটুতে ব্যথা নিয়েই দৌড়ে গিয়ে লাফিয়ে পড়ল আরেকটা কন্টেইনারের ছাদে। এভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে দুজনে হাজির হয়ে গেল কন্টেইনারের প্রথম সারির কাছে। দুটো কন্টেইনারের মাঝখানের ফাঁকা জায়গা দিয়ে পিছলে ঝুলে পড়ল শেলড্রেক, তারপর নিঃশব্দে ল্যাণ্ড করল জাহাজের ডেকে।

ওর সঙ্গে আঠার মতো সেঁটে আছে খালফানি।

কিছুদূর যেতে-না-যেতেই আবার শেলড্রেককে খামচে ধরল লোকটা, টেনে নিয়ে গেল দুটো কন্টেইনারের আড়ালে। স্তিমিত হয়ে এসেছিল গুলির শব্দ, এখন আবার শোনা যাচ্ছে মাঝেমধ্যে, এখানে-সেখানে। লড়াই শেষ হয়নি এখনও, তবে শেষ হয়ে আসছে।

 কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর খালফানি যখন বুঝল পরিস্থিতি নিরাপদ, এগোনোর ইশারা করল শেলড্রেককে।

মিশরীয় লোকটাকে নিয়ে একটা কন্টেইনারের সামনে গিয়ে থামল শেলড্রেক।এসে গেছি।

খোলো এটা।

নিজের মাস্টার-কী ব্যবহার করে তালা খুলে ফেলল শেলড্রেক। দরজা আটকে রাখা লিভার ধরে টান মারল। কাঁচকোচ করে উঠল জংধরা কজা, কলিজা কেঁপে গেল শেলড্রেকের।

ভিতরে ঢোকো, আদেশ দিল খালফানি।

ভিতরে ঢুকে একটা হ্যাঁণ্ডহেল্ড লাইট খুঁজে নিল শেলড্রেক, জ্বালল ওটা।

কন্টেইনারটার বেশিরভাগ জায়গা দখল করে রেখেছে সিলিণ্ডারের মতো দেখতে কয়েকটা প্রোপেন-ট্যাঙ্ক, ওগুলো ছাড়িয়ে আরও ভিতরে দেখা যাচ্ছে ঝকঝকে সাদা বিশটা ব্যারেল। পায়ে পায়ে সেদিকে এগিয়ে গেল শেলড্রেক।

এবার?

জুবাব দিল না খালফানি। পিস্তলটা জল ট্রাউজারের কোমরে, একটা ব্যারেল হাতে নিয়ে চাপ দিয়ে খুলল ওটার ঢাকনা।

আবারও আশ্চর্য হয়ে শেলড্রেক দেখল, ধোঁয়ার মতো কিছু-একটা বের হতে শুরু করেছে ব্যারেলটা থেকে, নামছে নিচের দিকে, ছড়িয়ে পড়ছে আস্তে আস্তে। তরল নাইট্রোজেন নাকি? আশপাশের বাতাসে শীতলতা টের পেয়ে জিজ্ঞেস করল। এটা দিয়ে শত্রু মারার ফন্দি করেছ?

ওকে আবারও উপেক্ষা করল খালফানি, মুখ বন্ধ করে কাজ করে যাচ্ছে। ব্যারেলের ভিতর থেকে বের করল অদ্ভুত প্রতীকযুক্ত ঠাণ্ডা একটা বোতল।

প্রতীকটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে শেলড্রেক। ভাবছে, নার্ভ গ্যাস? বায়োলজিকাল ওয়েপও হতে পারে। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, তোমার এই ব্যারেলগুলো নেয়ার জন্যই এসেছে ওরা, না? প্রোপেন নিতে আসেনি, চাদাও দাবি করবে না আমার কাছে। আমি শিয়োর, তোমার আর তোমার এই রাসায়নিক তরলের কারণেই মরেছে আমার লোকেরা! খপ করে চেপে ধরল সে খালফানির শার্টের কলার।

একটু থমকে গিয়েছিল খালফানি, কিন্তু সামলে নিতে সময় লাগল না ওর। পাল্টা ঝটকায় শেলড্রেকের হাত ছুটিয়ে দিল নিজের কলার থেকে, পরমুহূর্তেই মোচড় দিয়ে হাতটা নিয়ে গেল শেলড্রেকের পিঠের কাছে, তারপর ওকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল মেঝেতে।

উপুড় হয়ে পড়ে গেল শেলড্রেক, চিৎ হওয়ামাত্র টের পেল, ওর বুকে চড়ে বসেছে খালফানি। একজোড়া নির্দয় চোখ মেলে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।

তোমাকে আর দরকার নেই আমার, নির্দয়ের মতোই বলল খালফানি।

সঙ্গে সঙ্গে তলপেটে তীব্র ব্যথা টের পেল শেলড্রেক-একটা খঞ্জর বের করে ঢুকিয়ে দিয়েছে খালফানি। ওটার হাতল ধরে মোচড় দিল কয়েকবার, পেট চিরে তুলে আনল ফলাটা বুকের কাছে, তারপর মোচড় দিয়ে ওটা বের করে নিয়ে উঠে দাঁড়াল।

তীব্র যন্ত্রণায় বার বার কুঁকড়ে যাচ্ছে শেলড্রেক, হাত থেকে আপনাআপনি ছুটে গেছে পিস্তলটা। উঠে বসার চেষ্টা করতে গিয়ে আছড়ে পড়ল কন্টেইনারের ধাতব মেঝেতে। টের পাচ্ছে, ওরই রক্তে ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে ওর কাপড়। চিৎকার করার চেষ্টা করছে, কিন্তু প্রচণ্ড ব্যথায় তা-ও পারছে না।

খঞ্জরের হাতল থেকে রক্ত মুছে ফেলল খালফানি, ঢুকিয়ে রাখল কোমরের লুকানো-খাপে। ট্রাউজারের পকেট থেকে বের করল একটা স্যাটেলাইট ফোন, একটা বাটন চাপল। হামলা চালিয়ে দখল করে নেয়া হয়েছে টায়ানা, চাপা গলায় বলল অপরপ্রান্তের লোকটাকে।

কিছুক্ষণের বিরতি।

মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করছে শেলড্রেক, ওর দিকে তাকিয়ে আছে খালফানি, কিন্তু মনোযোগ দিয়ে শুনছে কী বলা হচ্ছে ওকে ফোনে।

মাথা নাড়ল সে। লড়াই করা সম্ভব না। ওরা সংখ্যায় অনেক…হা, জানি কী করতে হবে…এমন ব্যবস্থা করছি যাতে অন্য কারও হাতে না পড়ে কালো কুয়াশা।

ফোনের লাইন কেটে দিল। এগিয়ে গেল একটা প্রোপেন ট্যাঙ্কের দিকে, রিলিফ ভাড় ধরে জোরে মোচড় দিল। হিসহিস শব্দে ভরে গেল কন্টেইনারের ভিতরটা, গ্যাস বের হতে শুরু করেছে।

শার্টের পকেট থেকে ছোট একটা এক্সপ্লোসিভ চার্জ বের করল খালফানি, প্রোপেন-ট্যাঙ্কের একদিকে লাগিয়ে দিল ওটা, টাইমার সেট করল। এগিয়ে গেল কন্টেইনারের দরজার দিকে। পাল্লাটা নিজের ভারে চেপে এসেছিল, ওটা ফাঁক করে বেরিয়ে এল অন্ধকার ডেকে।

কন্টেইনারের ভিতরে, মেঝেতে পড়ে আছে শেলড্রেক; মরেনি এখনও। রক্তের একটা পুকুর তৈরি হয়েছে ওর আশপাশে। তাকিয়ে তাকিয়ে অসহায়ের মতো দেখেছে খালফানির কাজ, বুঝে গেছে কী ঘটতে চলেছে একটু পর। বুঝতে পারছে মরণ ঠেকানোর কোনও উপায় নেই। তারপরও সিদ্ধান্ত নিল, পারলে ঠেকানোর চেষ্টা করবে আসন্ন বিস্ফোরণ।

কয়েকবার গড়ান খেল সে, প্রতিবারই গুঙিয়ে উঠল প্রচণ্ড ব্যথায়। যে-ট্যাঙ্কে টাইমার লাগানো হয়েছে সেটা থেকে যখন আর সামান্য দূরে আছে, যেন অপার্থিব কোনও শক্তির প্রভাবে ভর দিতে পারল চার হাত-পায়ে; হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ট্যাঙ্কের দিকে। ওর পেছনে রয়ে যাচ্ছে রক্তের মোটা ধারা।

রিলিফ ভালভ যেদিকে ঘুরিয়েছে খালফানি, শেলড্রেক সেটা ঘোরানোর চেষ্টা করল বিপরীত দিকে, কিন্তু পারল নাশক্তিতে কুলাচ্ছে না। ওটা এমনকী ধরতেও পারছে না ঠিকমতো। ইতিমধ্যে অসহ্য হয়ে উঠেছে প্রোপেনের গন্ধ, বমি আসছে। পেটের যে-জায়গায় খঞ্জর ঢুকিয়েছে খালফানি, একটু নড়াচড়া করলেই মনে হচ্ছে আগুন ধরে যাচ্ছে। সেখানে। কষ্টেসৃষ্টে হাজির হতে পারল এক্সপ্লোসিভ চার্জটার কাছে।

ঝাপসা হয়ে এসেছে শেলড্রেকের দৃষ্টি, প্রতি মুহূর্তে আরও ঝাপসা হচ্ছে; টাইমারের গায়ে সংযুক্ত বাটনগুলো দেখতে পাচ্ছে না ঠিকমতো। হাত বাড়িয়ে টাইমারটা ধরল, কিছুক্ষণ ধরে রেখে টান দিল সর্বশক্তিতে। ট্যাঙ্কের গা থেকে খুলে চলে এল ওটা।

ঠিক তখন তৃতীয়বারের মতো খুলে গেল কন্টেইনারের দরজা।

ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল শেলড্রেক।

অস্ত্র উঁচিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়েছে দুজন লোক, শেলড্রেককে দেখতে পেয়ে ছুটে আসছে ওর দিকে। কিন্তু শেলড্রেকের কাছে এসে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল ওরা, ওর হাতে কী আছে দেখতে পেয়েছে।

দুই…এক…তারপর শূন্য দেখা গেল টাইমারের ডিসপ্লেতে।

বিস্ফোরিত হলো শেলড্রেকের হাত, আগুন ধরে গেল প্রোপেনে। অত্যুজ্জ্বল সাদা একটা ঝলকানি দিয়ে মুহূর্তেই বিস্ফোরিত হলো পুরো কন্টেইনার। প্রচণ্ড ধাক্কায় নড়ে উঠল কন্টেইনারের সারি, কোনও কোনওটা ছুটে গিয়ে জাহাজের রেইলিং ভেঙে পড়ল সাগরে।

নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে শেলড্রেক এবং কন্টেইনারটার ভিতরে থাকা অন্য দুজন; কিন্তু যেহেতু টাইমারটা ট্যাঙ্ক থেকে ছুটিয়ে ফেলেছিল শেলড্রেক সেহেতু খালফানির পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি পুরোপুরি। ভয়ঙ্কর একটা বিস্ফোরণের বদলে তুলনামূলক অনেক-কম শক্তিশালী বিস্ফোরণ ঘটেছে। ট্যাঙ্কের খোলা ভাড় থেকে এখনও সমানে বের হচ্ছে প্রোপেন, এবং বের হওয়ামাত্র পরিণত হচ্ছে অগ্নিকুণ্ডলীতে। সেই কুণ্ডলী সামনে যা পাচ্ছে, তা-ই পুড়িয়ে দিচ্ছে কাটিং টর্চের মতো। গলে যাচ্ছে কন্টেইনারের মেঝে, একটু একটু ফাটল ধরছে জাহাজের ডেকে।

যে যার মতো পারছে পালাচ্ছে হামলাকারীরা। ফাটল বড় হতে হতে ফোকর দেখা দিল টায়ানার ডেকে, সেখান দিয়ে হুড়মুড় করে নিচের খোলে পড়ে গেল একটা কন্টেইনার, ওটাকে অনুসরণ করল আরও কয়েকটা। জাহাজের ইঞ্জিন বন্ধ করেনি কেউ, ওটা তাই আপনগতিতে এগিয়ে চলেছে আগুনের একটা গোলক হয়ে। ভোর হওয়ার কিছুক্ষণ আগে লিনোসা উপকূল থেকে আধ মাইল দূরের একটা শৈলশ্রেণীতে বাড়ি খেল ওটা।

ঘুম থেকে সকাল সকাল ওঠা যাদের অভ্যাস, মজা করে জ্বলন্ত টায়ানা দেখল তারা; কেউ কেউ ছবি তুলল। ওদের চোখের সামনে আরেকদফা বিস্ফোরণ ঘটল জাহাজে-প্রচণ্ড উত্তাপে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল পনেরো হাজার গ্যালনের প্রোপেন ট্যাঙ্ক, আলোর প্রচণ্ড ঝলকানি দেখে বোধহয় লজ্জা পেল দিগন্তের এককোনায় সবে-উঁকি-দেয়া সূর্যটা।

ঝলকানিটা আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাওয়ার পর দেখা গেল নতুন আরেক অদ্ভুত দৃশ্য। দুমড়েমুচড়ে যাওয়া টিনের ক্যানের মতো অবস্থা হয়েছে টায়ানার, সেটা থেকে সাগরের জোরালো বাতাসে ভর করে কালো কুয়াশার একটা চাদর এগিয়ে আসছে লিনোসা দ্বীপের দিকে। কিন্তু কখনও কখনও মেঘ যেমন জমাট বেঁধে থাকে আকাশে, বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে না, দ্বীপটার উপর সেভাবে স্থির হয়ে থাকল কালো কুয়াশার চাঁদরা।

আকাশ থেকে ঝরে পড়তে শুরু করল শত শত সামুদ্রিক পাখি। কোনও কোনওটা আছড়ে পড়ছে সাগরের পানিতে, কোনওটা আবার ভোতা আওয়াজ তুলে পড়ছে জমিনের বুকে। যারা মজা দেখতে এসেছিল, মুহূর্তের মধ্যে উধাও হয়ে গেল তাদের সব আনন্দ; আতঙ্ক ভর করল তাদের মনে। ছুটে পালানোর চেষ্টা করল তারা সৈকত থেকে, কিন্তু কিছুদূর গিয়েই মাটিতে লুটিয়ে পড়ল সবাই। সাগরের জোরালো বাতাস কালো কুয়াশার সেই চাদরকে যেন ধাক্কিয়ে নিয়ে গেল আরও পশ্চিমে।

লিনোসা দ্বীপে পড়ে থাকল চলৎশক্তিহীন অনেক পাখি আর কিছু মানুষ।

.

০২.

সাগরের তলদেশের দিকে আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছে মাসুদ রানা।

ওর নিচে নামার গতি ছন্দময়, সুন্দর। শরীরের সঙ্গে বাঁধা দুটো স্কুবা ট্যাঙ্ক, স্থূলকায় হার্নেস আর পোপালশন ইউনিটের কারণে স্বাভাবিকের চেয়ে বড়সড় দেখাচ্ছে ওকে। দুটো শোল্ডার-মাউন্টেড লাইটের হলুদাভ আলো পথ দেখাচ্ছে ওকে অন্ধকারে।

সমুদ্র সমতল থেকে এক শ ফুট নামার পর খেয়াল করল, জ্বলন্ত লাইটের কারণে দুটো বৃত্ত তৈরি হয়েছে তলদেশের জমিনে। বৃত্ত দুটোর মাঝখানে যেন ভেসে বেড়াচ্ছে বিসিআই-এর কয়েকজন শিক্ষানবীশ এজেন্ট।

ডান হাতে বাঁধা ইন্টারকম সুইচে চাপ দিল রানা। হেলমেট-মাউন্টেড মাইক্রোফোনের সাহায্যে বলল, তলদেশের কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। এজেন্টদের সঙ্গে আছি।

ঠিক আছে, হেলমেটের ভিতরে বিশেষ-কায়দায়-বসানো স্পিকারে শোনা গেল সোহেলের কণ্ঠ।

প্রোপালশন ইউনিট চালু করল রানা, ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে শিক্ষানবীশ এজেন্টদের দিকে। ওদের বেশিরভাগের পরনে ড্রাই স্যুট। রানা এবং অন্য দু-একজন ডাইভার পরেছে নুমার নতুন উদ্ভাবিত হার্ড স্লট। ফলে কন্সট্যান্ট প্রেশার ধরে রাখতে পারছে ওরা, ডিকম্প্রেশন-স্টপ ছাড়াই ডাইভ দিতে পারছে, সার্ফেস করতে পারছে। এখন পর্যন্ত স্যুটটা ব্যবহার করতে কোনও অসুবিধা হয়নি রানার।

হঠাৎ ওর হেলমেটের স্পিকারে খড়খড় করে উঠল, তারপর ভেসে এল অচেনা এক নারীকণ্ঠ, শুনছেন? শুনতে পাচ্ছেন কেউ?

থমকে গেছে রানা, শিক্ষানবীশ এজেন্টদের দিকে এগোনো বন্ধ হয়ে গেছে। বুঝতে পারছে, পানির উপর থাকা নুমার স্পেশালাইযড় শিপ সি-হর্স-এ কোনও-না কোনওভাবে হাজির হয়েছে নারীকণ্ঠটা, ওটাই শুনতে, পেয়েছে ও।

ভূমধ্যসাগরে আসার পর রিফুয়েলিং আর রসদের জন্য প্রতি সপ্তাহে একবার করে লিনোসা দ্বীপে যাচ্ছে সি-হর্স, একটা করে রাত কাটাচ্ছে সেখানে। লজিসটিক্স সাপোর্টের জন্য বিসিআই-এর পাঁচ এজেন্ট এখনও আছে ওখানে।

রানা? এবার শোনা গেল সোহেলের কণ্ঠ।

আমাদের ইন্টারকম সিস্টেম বোধহয় কানেক্টেড হয়ে গেছে প্রাইভেট কোনও চ্যানেলের সঙ্গে, বলল রানা। কোথাও কোনও সমস্যা হয়েছে?

মনে হয়। সাহায্যের আশায় অন্য কোথাও যোগাযোগ করার চেষ্টা করছিল কেউ, ঢুকে পড়েছে আমাদের সিস্টেমে।

যে মেয়ে বা মহিলা যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে, আমার ধারণা সে আছে লিনোসায়।

সি-হর্সের রেডিওরুমের অপারেটররা ইতোমধ্যে রেকর্ড করে ফেলেছে মেসেজটা।

শোনাতে পারবি?

একটু দাঁড়া।

কয়েক মুহূর্ত পর মৌমাছির গুঞ্জনের মতো আজব এক আওয়াজ শুনতে পেল রানা ওর হেলমেটের স্পিকারে। তারপর শুনল একসঙ্গে কথা বলছে কারা যেন, আলাদা করে বোঝা যাচ্ছে না কারও কথাই। এরপর কিছুক্ষণের নীরবতা, গুঞ্জন কমছে আস্তে আস্তে। ওটা পুরোপুরি থেমে যাওয়ার পর শোনা গেল নারীকণ্ঠটা।

সম্পূর্ণ শান্ত গলা ওর, কিন্তু কথা বলার ভঙ্গি খেয়াল করলে বোঝা যায় বাইরের-সাহায্য খুব দরকার বেচারীর। ইটালিয়ান ভাষায় বিশ সেকেন্দ্রে মতো বকবক করল সে, তারপর কথা বলতে শুরু করল ইংরেজিতে।

আবারও বলছি…আমি ডক্টর সিয়োর লামিয়া…আক্রান্ত হয়েছি আমরা…এখন আটকা পড়ে আছি একটা হাসপাতালে…সাহায্য খুব দরকার আমাদের…বাইরে বের হতে পারছি না, আস্তে আস্তে ফুরিয়ে আসছে অক্সিজেন। প্লিয কেউ সাহায্য করুন।

গুঞ্জনধ্বনি শোনা গেল আবারও, তারপর আরও একবার সাহায্যের আবেদন জানাল লামিয়া।

খুট করে একটা শব্দ শোনা গেল।

বন্ধ করা হয়েছে রেকর্ড বাজানো।

ডক্টর লামিয়ার মেসেজ পাওয়ার পর লজিসটিক্স টিমের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি আমি, রানাকে বলল সোহেল,.রিপ্লাই দিচ্ছে না ওদের কেউ।

চেষ্টা করে দেখ অন্য কারও সঙ্গে যোগাযোগ করা যায় কি না, পরামর্শ দিল রানা। লিনোসা দ্বীপে একটা ইটালিয়ান কোস্টগার্ড স্টেশন আছে।

সে-চেষ্টাও হয়ে গেছে এরই মধ্যে, লাভ হয়নি। যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি ওখানকার স্থানীয় পুলিশ স্টেশনে, সাড়া দেয়নি কেউ।

লামিয়ার কথাগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে রানার মাথায়। বুলল, পালার্মোতে ইটালিয়ান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানিয়ে রাখ, কিছু একটা হয়েছে লিনোসা দ্বীপে, সাহায্যের আবেদন জানানো হয়েছে সেখান থেকে। কোনও খবর নেই বিসিআই-এর পাঁচজন এজেন্টের, নিজেদের গরজেই ওই দ্বীপে যেতে হবে আমাদেরকে। …উপরে আসছি আমি।

.

সি-হর্সে উঠে এসেছে রানা। ডেকের এককোনায় বসে ডাইভিং সরঞ্জাম খসাচ্ছে শরীর থেকে।  পাশে দাঁড়ানো সোহেল বলল, পালার্মো কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, প্রস্তুত অবস্থায় নেই ওদের কোনও হেলিকপ্টার। রিফুয়েলিং করিয়ে দুটোকে পাঠাচ্ছে ওরা, কিন্তু দুঘণ্টার আগে পৌঁছাতে পারবে না লিনোসায়। তাই ওরা আমাদেরকেই যেতে অনুরোধ করেছে লিনোসায়।

চল তা হলে, উঠে দাঁড়াল রানা।

সি-হর্স লিনোসার কাছাকাছি যাওয়ামাত্র সবার আগে দেখা গেল, কালো, ঘন, তেলতেলে ধোয়ার একটা আস্তরণ যেন স্থির হয়ে আছে দ্বীপটার উপরে। ২

চোখে বিনকিউলার লাগাল রানা। কোনও জাহাজ মনে হয় আটকা পড়েছে তীরের কাছাকাছি।

ট্যাঙ্কার?

বলতে পারছি না-এতদূর থেকে বোঝা যাচ্ছে না। তা ছাড়া ধোঁয়াও অনেক বেশি। জাহাজটা মনে হয় দুর্ঘটনায় পড়েছে। সি-হর্সের ক্যাপ্টেন রানার বন্ধু মানুষ, তার দিকে তাকাল রানা। কুপার, আরেকটু কাছে যাও। সামনে গিয়ে দেখি ঘটনা কী।

কোর্স বদল করা হলো সি-হর্সের। দুর্ঘটনাকবলিত জাহাজটার দিকে যত এগোচ্ছে ওরা, মাথার উপরে ধোয়ার আস্তরণ তত যন আর কালো হচ্ছে।

সাগরের বাতাস ওই জাহাজ থেকে বের-হওয়া সমস্ত ধোঁয়া সোজা নিয়ে যাচ্ছে লিনোসার দিকে, বলল সোহেল।

কী বইছিল জাহাজটা? আপন মনে বলল রানা। বিষ টিষ জাতীয় কিছু?

জবাব দিল না সোহেল, এ ব্যাপারে কিছুই জানা নেই ওর। বলল, মহিলা ডাক্তারটা বলল, ওরা আটকা পড়েছে, ওদের অক্সিজেন ফুরিয়ে আসছে। ওরা কি ওই ধোঁয়ার কবল থেকে বাঁচতে লুকিয়ে আছে কোথাও?

বিনকিউলারটা আবার চোখে লাগাল রানা। এবার আরও স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে আটকা-পড়া হাজটা। দেখে মনে হচ্ছে, কোনও দৈত্যের কবলে পড়েছিল ওটা, দৈত্যটা টেনে ছিঁড়ে ফেলেছে ওটার সামনের অংশ। মনে হচ্ছে, ওটার অর্ধেক আছে, বাকি অর্ধেক গায়েব। ওটার যতটুকু দেখা যাচ্ছে, তার পুরোটাই ঢাকা পড়ে গেছে ধোঁয়ার ঝুলকালি দিয়ে।

জাহাজটা ডুবে যাচ্ছে না কেন ভেবে আশ্চর্য লাগছে আমার, বলল রানা। ওটার কোথাও কোনও নামও দেখা যাচ্ছে না। কুপার, পালার্মোতে যোগাযোগ করতে বলল কাউকে, লিনোসা উপকূলে কী দেখছি আমরা তা জানিয়ে দেয়া দরকার। জাহাজের নাম জানতে পারলে ওটা কী বহন করছিল তা-ও জানা যাবে। নিচু করল বিনকিউলারটা। বাতাস যেদিকে বইছে, সেদিকে জাহাজ চালাও।

জাহাজের কোর্স ঠিক করে নিয়ে গতি কমাল কুপার। তারপর গিয়ে ঢুকল রেডিওরুমে-যোগাযোগ করতে হবে পালার্মোতে। ওর সঙ্গে গেল সোহেল।

দুর্ঘটনাকবলিত জাহাজ থেকে আর যখন পাঁচ শ গজ দূরে আছে সি-হর্স, ডেকের সামনের দিক থেকে হাঁক ছাড়ল একজন ক্রু, দেখুন! দেখুন!

থ্রটল নামিয়ে সি-হর্সকে আইডল পজিশনে নিয়ে গেল কুপার। হুইলহাউসে গিয়ে ঢুকেছিল রানা, বেরিয়ে এল ডেকে।

সাগরের পানিতে ভাসছে কতগুলো জিনিস, আঙুলের ইশারায় ওগুলো দেখাচ্ছে ওই ক্রু। এগিয়ে গিয়ে রেইলিং ঘেঁষে দাঁড়াল রানা। ছাইরঙা জিনিসগুলো দৈর্ঘ্যে পনেরো ফুটের কাছাকাছি, দেখতে অনেকটা টর্পেডোর মতো।

পাইলট ওয়েইল, বলল ওই ক্রু। চারটা পূর্ণবয়স্ক, দুটো বাচ্চা।

উল্টো হয়ে ভাসছে, বলল রানা। খেয়াল করল, সামুদ্রিক আগাছা এবং কতগুলো মরা মাছ ও ছোট সামুদ্রিক প্রাণীও ভাসছে ওয়েইলগুলোর আশপাশে। লিনোসা দ্বীপে যা-ই ঘটে থাকুক, সেটার প্রভাব পড়েছে সাগরের পানিতে।

এবং সেই প্রভাবের জন্য দুর্ঘটনাকবলিত জাহাজটাই দায়ী, বলল অন্য কেউ।

মাথা ঝাঁকাল রানা।

সি-হর্সের দিকে ভেসে আসছে আরও কতগুলো সামুদ্রিক জীব। রেডিওরুমে পালার্মো কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলছে। সোহেল, আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। রানা খেয়াল করল, ভেসে আসা জীবগুলোর সবই মৃত না। কোনও কোনওটা জড়াজড়ি করে আছে একটা আরেকটার সঙ্গে, বলা ভালো ছোট ছোট শুড় দিয়ে পেঁচিয়ে ধরার চেষ্টা করছে একটা আরেকটাকে।

আমাদের বোধহয় এখান থেকে কেটে পড়া উচিত, বলল রানার পাশে-দাঁড়ানো সি-হর্সের এক ক্রু, নিজের শার্টের কলার ধরে উঁচু করে ওটা দিয়ে নাকমুখ ঢাকল। ভাবখানা এমন, আশপাশের বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে প্রাণঘাতী কোনও বিষ, ওটার কবল থেকে বাঁচতে চাইছে।

কিন্তু রানা জানে এখন যেখানে আছে ওরা, নিরাপদে আছে। কারণ এখনও সিকি মাইল দূরে আছে দুর্ঘটনাকবলিত জাহাজটা, আশপাশের বাতাসে ধোঁয়ার কোনও গন্ধও নেই।

হুইলহাউসে গিয়ে ঢুকল ও কুপার, দ্বীপের দিকে এগোও। ধোয়ার ওই আস্তরণের দিকে নজর রেখো। যদি দিক বদল হয় বাতাসের, যদি আমাদের দিকে এগিয়ে আসে ওই ধোঁয়া, সঙ্গে সঙ্গে নাক ঘুরিয়ে নিতে হবে জাহাজের।

মাথা ঝাঁকাল কুপার, থ্রটলে টান দিয়ে হুইল ঘোরাল। আবার আগে বাড়ল সি-হর্স।

হুইলহাউসের দরজায় হাজির হলো সোহেল। কথা হয়েছে পালার্মোর সঙ্গে। গতরাতের এ.আই.এস, ডেটা চেক, করে ওরা বলল, দুর্ঘটনাকবলিত জাহাজটা এম.ভি. টায়ানা।

কী বহন করছিল ওটা? জিজ্ঞেস করল রানা।

ভিতরে ঢুকল সোহেল। মূলত মেশিন পার্টস আর কাপড়চোপড়…বিপজ্জনক কিছু না।

বিপজ্জনক কিছু যদি না থাকবে, সাহায্যের আবেদন কেন জানাল ডক্টর লামিয়া? কেন হুট করে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে বিসিআই-এর লজিসটিক্স সাপোর্ট টিমের সঙ্গে? কেন কেউ বলতে পারছে না কী ঘটেছে লিনোসা দ্বীপের অধিবাসীদের ভাগ্যে? মাথা নাড়ল রানা। নিজের চোখে দেখতে চাই আমি কী ঘটেছে।

সোহেল বুঝতে পারছে মানা করে কোনও লাভ হবে না। ঠিক আছে, আমিও যাব তোর সঙ্গে।

মুচকি হাসল রানা। বেঘোরে মরা উচিত হবে না বিসিআই-এর চীফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটরের।

তোকে চিরকাল বেঁচে থাকার গ্যারান্টি কে দিয়েছে? …ফুল ফেস হেলমেট আছে আমাদের সঙ্গে, আছে বিশুদ্ধ অক্সিজেনের প্রচুর সাপ্লাই। ওগুলো পরে নিলে কোনও সমস্যা হবে না আশা করি।

কোনও কোনও নার্ভ টক্সিন চামড়ার উপরও প্রতিক্রিয়া করে, বাছাধন, জ্ঞান দেয়ার ভঙ্গিতে বলল রানা।

তুই কি ভেবেছিস সেটা জানি না আমি? ড্রাই স্যুট পরে নেব আমরা…ওগুলো ওয়াটারপ্রুফ। গ্লাভস ব্যবহার করব, চামড়া একটুও যাতে দেখা না যায় সেজন্য শরীরের খোলা জায়গাগুলোয় পেঁচিয়ে নেব ডাক্ট টেপ।

গম্ভীর হয়ে গেছে কুপারের চেহারা। তোমাদের দুজনের ওই দ্বীপে যাওয়াটা শেষপর্যন্ত বিনা-কারণে প্রাণের ঝুঁকি নেয়া হতে পারে। যা-ই ঘটে থাকুক না কেন ওখানে, এতক্ষণে হয়তো বেঁচে নেই কেউই।

একমত হতে পারলাম না, বলল রানা। কারণ, এক, ডক্টর লামিয়ার সাহায্যের আবেদন। যা-ই ঘটে থাকুক না কেন, নিশ্চয়ই সেটার পরই আবেদন জানিয়েছে সে। বলেছে, আক্রান্ত হয়েছি আমরা, সাহায্য দরকার আমাদের। আমরা, আমাদের-বহুবচন। তারমানে মেসেজটা যখন শুনেছি, তখন পর্যন্ত ডক্টর লামিয়ার সঙ্গে আরও এক বা একাধিক লোক বেঁচে ছিল।

আর দুই?

একটু আগে দেখলাম, সি-হর্সের পাশ দিয়ে ভেসে যাচ্ছে কিছু সামুদ্রিক জীব; কোনও কোনওটা মরেনি।

মানে?

টায়ানা থেকে ধোঁয়ার সঙ্গে যা-ই বের হয়ে থাকুক, ওটা দুর্বল হয়ে পড়েছে এতক্ষণে। সুযোগটা নিতে চাইছি আমি। যদি এখন পর্যন্ত একজন মানুষও বেঁচে থাকে লিনোসায়, উদ্ধার করতে চাইছি তাকে।

কুপার বুঝে গেছে, তর্ক করে পারবে না রানার সঙ্গে। তোমরা দুজন যখন দ্বীপে যাবে, আমরা কী করব?

কান খোলা রাখবে-যে-কোনও সময় মেসেজ আসতে পারে রেডিওতে। চ্যানেল মার্কারে একটা বয়া ভাসছে, ওটার উপর বসে-থাকা পেলিক্যানগুলো যদি হুট করে মরে পড়ে যায় পানিতে, সঙ্গে সঙ্গে ঘুরিয়ে নেবে সি-হর্সের নাক, যত দ্রুত সম্ভব পালাবে। …লংবোট নামাতে বলো।

.

০৩.

 টায়ানার লংবোটে বিমর্ষ চেহারায় বসে আছে খালফানি।

জাহাজে বিস্ফোরণ ঘটার আগেই বোটটা চুরি করে পালাতে সক্ষম হয়েছে সে। টাইমারটা যখন বিস্ফোরিত হয়, ততক্ষণে জাহাজ থেকে এক শ ফুট দূরে চলে এসেছিল। ছিটকে ওঠা আগুনের আঁচে ঝলসে যাওয়ার কথা ছিল ওর, কিন্তু বিস্ফোরণটা জোরালো না হওয়ায় বেঁচে গেছে।

কোথাও কোনও গণ্ডগোল হয়েছে। এবং সেটা টের পাওয়ামাত্র বোট নিয়ে টায়ানার পিছু পিছু যাওয়ার ইচ্ছা হয়েছিল খালফানির। আবার ডেকে উঠে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে দিতে চাইছিল ওটাকে। কিন্তু তখনও চলছিল জাহাজটা, লংবোট একা চালিয়ে ওটাকে ধরা সম্ভব ছিল না খালফানির পক্ষে।

দূর থেকে তাকিয়ে তাকিয়ে অসহায়ের মতো দেখেছে, লিনোসার কাছে গিয়ে হঠাৎ নিশ্চল হলো টায়ানা, আবারও বিস্ফোরণ ঘটল সেটাতে। তাতে লাভের চেয়ে ক্ষতি হলো বেশি। ক্রায়োজেনেকালি কুল সিরাম, মানে খালফানির সেই রহস্যময় কার্গো, পরমাণুতে বিশ্লিষ্ট হয়ে পরিণত হলো প্রাণঘাতী কালো কুয়াশায়, কার্যকরী হয়ে উঠল যে-কোনও নার্ভ গ্যাসের মতো।

অসহায়ের মতো দেখেছে খালফানি, পশ্চিম থেকে আরও পশ্চিমে বিস্তৃত হলো সেই ধোয়া-যেন গ্রাস করে নিল লিনোসাকে। সে এবং ওর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ যা গোপন করতে চাইছিল সারা দুনিয়ার কাছ থেকে, তা ঢোল-পেটানোর-মতো জানাজানি হয়ে গেছে।

একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটেছে। পালানোর সময় টায়ানার রেডিওরুম থেকে একটা রেডিওসেট চুরি করেছিল খালফানি, ভেবেছিল পরে কাজে লাগাবে। কিছুক্ষণ আগে শুনল, লিনোসা থেকে সাহায্যের আবেদন জানানো হচ্ছে–আটকা পড়া এক মহিলা ডাক্তার মেসেজ পাঠাচ্ছে। সিগনাল পরিষ্কার ছিল; খালফানি শুনেছে, একটা হাসপাতালে কয়েকজন রোগীসহ আটকা পড়েছে ওই ডাক্তার। আরও শুনেছে, রহস্যময় একটা ধোঁয়ার কথা বলছিল মেয়েটা।

সুতরাং, বিমর্ষতা ঝেড়ে ফেলল খালফানি, সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় হয়েছে।

লিনোসায় যাবে সে। যেভাবেই হোক খতম করবে ওই ডাক্তারনীকে। যে বা যারা ইতোমধ্যে জেনে গেছে কালো কুয়াশার ব্যাপারটা, খতম করবে তাদেরকেও। একটু খুঁজে দেখতে হবে কালো কুয়াশার ব্যাপারে কোথাও কোনও নোট করেছে কি না ডাক্তারনীটা, যদি করে থাকে তা হলে নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে তা-ও।

পকেট থেকে একটা প্রিপ্যাকেজড হাইপোডার্মিক সিরিঞ্জ বের করল সে, দাঁতে কামড়ে ছিঁড়ল প্যাকেটের মুখ। দ্রুত কয়েকবার টোকা দিল সিরিঞ্জের গায়ে, নিশ্চিত হলো ভিতরে কোনও বুদ্বুদ নেই। তারপর একপায়ের মাংসপেশিতে ঢুকিয়ে দিল সুঁই, চাপ দিল পাঞ্জারে-কালো কুয়াশার অ্যান্টিডোট ওটা।

সারা শরীরে শীতল একটা শিহরণ অনুভব করছে খালফানি। অল্প কিছু মুহূর্তের জন্য টনটন করে উঠল ওর হাত-পায়ের তালু।

বৈঠা তুলে নিল সে, অনুমান করে নিল কোন্‌দিক দিয়ে গেলে সবচেয়ে তাড়াতাড়ি যাওয়া যাবে লিনোসায়। এগোতে শুরু করল সেদিকে। যত দ্রুত সম্ভব বৈঠা বাইছে, জানে ওর হাতে সময় কম। কারণ কাছেপিঠে থাকা অন্য কোনও জাহাজের ক্রুদের কানেও হয়তো গেছে ডাক্তার মেয়েটার সাহায্যের আবেদন।

লিনোসার নির্জন সৈকতে হাজির হতে বেশি সময় লাগল না।

পাথুরে ঢাল কেটে বানানো সিঁড়ি উঠে গেছে সৈকত ছাড়িয়ে উপরের একটা রাস্তার দিকে। ওদিকে পা বাড়াল খালফানি। এই দ্বীপ চেনে সে। হাসপাতালটা সৈকত থেকে দুই মাইল দূরে। সেটার আধ মাইলের মধ্যে আছে। এয়ারপোর্ট।

ডাক্তার মেয়েটা এবং ওর সঙ্গে অন্য যারা আছে তাদেরকে খুন করে এয়ারপোর্টে চলে যাবে খালফানি। না দেখেও সে জানে, দ্বীপে নিজের প্রভাব যদি ঠিকমতো বিস্তার করে থাকে কালো কুয়াশা, অ হয়ে এখন খাঁ-খাঁ করছে এয়ারপোর্ট। কাজেই ওখানে গিয়ে ছোট একটা প্লেন চুরি কল্পতে অসুবিধা হওয়ার কথা না ওর। প্লেনটা নিয়ে চলে যাবে তিউনিসিয়া, লিবিয়া বা মিশরের দিকে।

কাজটা যদি সফলভাবে করতে পারে, কেউ কোনওদিন জড়াতে পারবে না ওকে কালো কুয়াশার সঙ্গে।

.

ফুল ডাইভিং গিয়ারে আপাদমস্তক আবৃত করে নিয়েছে রানা আর সোহেল।

লংবোট এগিয়ে চলেছে লিনোসার দিকে। সময় যত মচ্ছে, মাথার উপর তত নির্দয় হচ্ছে সূর্য। থেকে থেকে মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। কিন্তু সে-শীতলতার স্পর্শ পাচ্ছে না দুজনের কেউই।

লিনোসার বন্দরে হাজির হয়ে গেল ওরা। জেটির সঙ্গে বাধা ডজনখানেক ছোট ছোট নৌকা দুলছে ঢেউয়ের তালে। যতদূর চোখ যায়, কোথাও কেউ নেই।

সোহেলের সঙ্গে মুখ চাওয়াচাওয়ি করল রানা।

বন্দর ছাড়িয়ে দূরের রাস্তা আর বিল্ডিংগুলোর দিকে তাকাল ও রাস্তাঘাট জনশূন্য। কোনও ট্রাফিক নেই। কোনও পথচারীও নেই।

লিনোসার জনসংখ্যা দেড় হাজারের মতো, কিন্তু রাত গম্ভীর হওয়ার আগপর্যন্ত সাত-আট শ লোক সবসময় থাকে জেটি ও সংলগ্ন এলাকায়। বিভিন্ন দিকে ছুটতে দেখা যায় স্কুটার, ডেলিভারি ট্রাক আর ছোট ছোট গাড়িকে।

এখন সব নিথর।

অদ্ভুত এক শিরশিরানি অনুভব করল রানা তলপেটে। সামনে একটা সেইলবোট দেখা যাচ্ছে। এদিকে গিয়ে ডানে মোড় নেব আমরা। লজিসটিক্স সাপোর্টের অপারেশন শ্যাকে যাওয়ার শর্টকাট রাস্তা আছে ওখান দিয়ে।

সেইলবোটটার কাছে যেতেই দেখা গেল, ওটার ভিতরে উপুড় হয়ে পড়ে আছে দুজন মানুষ। একজন পুরুষ, বেচারার একটা হাতের সঙ্গে পেঁচিয়ে আছে সেইল লাইন। অন্যজন একটা মহিলা।

একটা আঙুল তুলে ওদেরকে দেখাল সোহেল। আমরা কি…

মাথা নেড়ে মানা করে দিল রানা। ওদের জন্য কিছুই করার নেই আমাদের। যেদিকে এগোচ্ছিল সেদিকে এগোতে থাকল। কিছুক্ষণের মধ্যেই হাজির হলো ছোট একটাপিয়ারের কাছে। ভারী স্যুট পরে পিয়ারে উঠতে কষ্ট হলো ওদের। শর্টকাট ধরে হাজির হয়ে গেল রাস্তায়।

মাঝবয়সী এক দম্পতি পড়ে আছে এককোনায়, সঙ্গে একটা বাচ্চা আর চেইনে-বাধা কুকুর। কাছেই ছায়া দিচ্ছে একটা গাছ, ওটার নিচে পড়ে আছে কয়েকটা পাখি।

ওই দম্পতির কাছে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বয়ে পড়ল রানা। পড়ে গিয়ে আঘাত পেয়েছে ওরা, নাকে-মুখে ক্ষতচিহ্ন দেখা যাচ্ছে। কিন্তু রক্তপাত বা ট্রমার কোনও নমুনা নেই।

দেখে মনে হচ্ছে দাঁড়ানো অবস্থা থেকে পড়ে গেছে এরা, বলল রানা। এবং হঠাৎ করেই আক্রান্ত হয়েছে প্রাণঘাতী কোনও সমস্যায়।

যা-ই হামলা করে থাকুক না কেন এই লোকগুলোর উপর, বলল সোহেল, খুব দ্রুত করেছে।

আঙুলের ইশারায় পাশের রাস্তাটা দেখিয়ে দিল রানা। ওই দিকে।

লজিসটিক্স সাপোর্টের জন্য যে-শ্যাক ব্যবহার করছে বিসিআই, দুটো ব্লক পার হয়ে সেটার কাছে হাজির হলো রানা আর সোহেল। শ্যাকের সামনের অংশে ছোট একটা গ্যারেজ আছে, তবে আপাতত ব্যবহৃত হচ্ছে স্পেশালাইড ডাইভিং ইকুইপমেন্টের গুদাম হিসেবে। ওটার পেছনে চারটা ছোট ছোট ঘর-অফিস আর স্লিপিং কোয়ার্টার্স।

গ্যারেজের দরজার হাতল ধরে মোচড় দিল সোহেল। লক করা।

সরে দাঁড়া!

সোহেল একপাশে সরতে-না-সরতেই দরজার হাতলের নিচে প্রচণ্ড এক লাথি হাঁকাল রানা। ভেঙে গেল কাঠ, আলগা হয়ে গেল তালা। হাঁ হয়ে খুলে গেল পাল্লা।

বিসিআই-এর এজেন্টদের নাম ধরে চিৎকার করে ডাকছে রানা। ডাকছে সোহেলও। কিন্তু দুজনের কেউই নিশ্চিত না, ওদের হেলমেট ভেদ করে ঠিক কতখানি আওয়াজ বেরুচ্ছে বাইরে। ধাতব প্লেট মেঝেতে পড়ে গেলে যে-রকম ঝনঝন আওয়াজ হয়, ওদের চিৎকার ওদেরই কানে বাজছে সেভাবে।

গলা ফাটানো বন্ধ করল রানা, হাত তুলে থামার ইঙ্গিত দিল সোহেলকে। বলল, চল, পেছনের ঘরগুলো চেক করি।

প্রথম ঘরটাতে ঢুকল রানা। খালি ওটা।

অফিসরুমের দিকে এগিয়ে গেছে সোহেল, দরজা খুলেছে। হঠাৎ জরুরি গলায় পেঁচিয়ে উঠল, রানা, এদিকে!

ঘুরে ছুট লাগাল রানা, গিয়ে দাঁড়াল অফিসরুমের গোবরাটে।

ঘরের একমাত্র টেবিল ঘিরে বসে ছিল পাঁচ এজেন্টের চারজন, হেডডাউন করে রাখার ভঙ্গিতে টেবিলে মুখ থুবড়ে পড়েছে সবার। ওদের সামনে টেবিলের উপর বিছানো আছে একটা ম্যাপ। মনে হচ্ছে, ম্যাপটা দেখছিল ওরা, এমন সময় হামলা চালিয়েছে ওদের উপর। টেবিল থেকে কিছুটা দূরের একটা চেয়ারে বসে আছে পঞ্চম এজেন্ট, নিপ্রাণ খোলা-চোখে তাকিয়ে আছে টেবিলের দিকে।

সকালের মিটিং, বলল রানা।

প্রাণের কোনও স্পন্দন আছে কি না কারও শরীরে, এগিয়ে গিয়ে একে একে চেক করল সোহেল। পালস্ পাওয়া গেল না কারও। রানার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল ও। পালস্ নেই, নাকি মোটা গ্লাভসের কারণে টের পাচ্ছি না, বুঝতে পারছি না।

কোমরের খাপ থেকে ছুরি বের করল রানা, এগিয়ে গেল একজন এজেন্টের দিকে। ফলার চ্যাপ্টা প্রান্তটা ধরল ওই এজেন্টের নাকের নিচে জলীয় বাষ্পের কোনও দাগ বসছে না ফলায়।

দম নিচ্ছে না, বলল রানা। ছুরিটা ঢুকিয়ে রাখল জায়গামতো। টায়ানায় যা ছিল, তা এই দ্বীপের বারোটা বাজিয়ে দিয়ে গেছে। মিলিটারি গ্রেড নার্ভ এজেন্ট সম্ভবত।

ওটা এই দ্বীপে ব্যবহার করার দরকার পড়ল কেন? লিনোসা পুঁচকে একটা দ্বীপ। এখানকার বেশিরভাগ মানুষ হয় ছুটি কাটাতে এসেছে, নয়তো জেলে বা ডাইভার।

জানি না, বিসিআই-এর এজেন্টদের দিকে তাকাচ্ছে। রানা একে একে, একইসঙ্গে ক্ষোভ আর আত্মপ্রতিজ্ঞা টের পাচ্ছে নিজের ভিতরে। তবে যে বা যারাই ব্যবহার করে থাকুক ওই গ্যাস, তাদেরকে খুঁজে বের করব।

সি-হর্সের সঙ্গে যোগাযোগ করছি আমি, বলল রানা। লজিসটিক্স সেন্টারের খবর জানাচ্ছি।

মাথা ঝাঁকাল রানা। তারপর হাসপাতালে যাব।

.

গর্জন করে উঠে যেন প্রাণ পেল জিপের ইঞ্জিন, দ্বীপের সুনসান নীরবতায় স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি শোনাল আওয়াজটা। গিয়ার বদল করে জিপ ছেড়ে দিল রানা। ওর পাশের সিটে বসে ম্যাপ দেখছে সোহেল।

রাস্তায় দুর্ঘটনায় পড়েছে ডজনখানেক গাড়ি আর স্কুটার–চলন্ত অবস্থায় প্রাণ হারিয়েছে ওগুলোর ড্রাইভাররা। একটা আরেকটার সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে দুমড়েমুচড়ে গেছে, কোনও কোনওটার রেডিয়েটর থেকে ধোয়া বের হচ্ছে। হাসপাতালে যাওয়ার পথে যে-কটা তেরাস্তা-চৌরাস্তা পড়ল, সবগুলোতে প্রায় একই দৃশ্য দেখা গেল-ফুটপাতে মরে পড়ে আছে পথচারীরা।

মৃত্যুপুরী, মন্তব্য করল সোহেল।

 হাসপাতালের সামনে গাড়ি থামাল রানা।

দেখতে বেশ আধুনিক, আবারও বলল সোহেল, উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে জিপের জানালা দিয়ে।

উঁকি দিচ্ছে রানাও। লিবিয়া আর তিউনিসিয়া থেকে আসা শরণার্থীদের জন্য বড় করা হয়েছিল হাসপাতালটা, সুযোগসুবিধাও বাড়ানো হয়েছিল। ইঞ্জিন বন্ধ করে দিয়ে দরজা খুলল, বের হলো বাইরে। পা বাড়াতে যাচ্ছিল হাসপাতালের দিকে, কিছু একটা চোখে পড়ায় থমকে গেল।

কী? জিজ্ঞেস করল সোহেল।

যেদিক থেকে এসেছে ওরা সেদিকে তাকিয়ে আছে রানা। কী যেন নড়ে উঠল ওদিকে।

কী?

শিয়োর না। ওই যে… আঙুলের ইশারায় দুর্ঘটনা কবলিত কয়েকটা গাড়ি দেখাচ্ছে রানা, ওই দিকে। বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল একদৃষ্টিতে, কিন্তু নতুন কিছু চোখে পড়ল না।

চেক করে দেখবি?

মাথা নাড়ল রানা। বাদ দে। মনে হয় আমার হেলমেটের ফেইস-শিল্ডে আলো প্রতিফলিত হয়েছে।

এট্রেন্সের কাছে গিয়ে দাঁড়াল দুজনে। খুলে গেল অটোমেটিক দরজা। ভিতরে ঢুকল ওরা।

ওয়েইটিং রুমে চেয়ারে বসা অবস্থাতেই মারা গেছে দশজন লোক। ফ্রন্ট ডেস্কের পাশে চিৎ হয়ে পড়ে আছে এক নার্স।

আমাদের সাহায্যের আর ডক্টর লামিয়ার দরকার আছে কি না, সন্দেহ আছে, বলল সোহেল।

ফ্রন্ট ডেস্কে একটা ডিরেক্টরি পাওয়া গেল। ওটা খুলল রানা। নামগুলোর উপর দ্রুত নজর বোলাচ্ছে। একটা পাতা উল্টানোর পরই পাওয়া গেল লামিয়ার নাম। অন্য সব নাম টাইপ করা, শুধু লামিয়ার নামটাই হাতে লেখা।

মেয়েটা বোধহয় নতুন এসেছে, বলল রানা।

ওর পাশে দাঁড়িয়ে আছে সোহেল। নামের সঙ্গে কোনও অফিস নম্বর নেই, কোন্ ফ্লোরে বসে তা-ও লেখা নেই।

একটা মাইক্রোফোন তুলে নিল রানা, দেখে মনে হচ্ছে। ওটা কোনও পি.এ. সিস্টেমের সঙ্গে যুক্ত। আমরা যদি বলি সাহায্য এসে গেছে, বেঁচে থাকলে সাড়া দেয়ার চেষ্টা করবেই মেয়েটা।

মাইক্রোফোন সিস্টেম চালু করল ও, সারা হাসপাতালে যাতে শব্দ ছড়িয়ে যায়, সেজন্য অলক লেখা একটা সুইচ অন করল। হেলমেটের ফেইসপ্লেটের একেবারে কাছে নিল মাইক্রোফোন, চেঁচিয়ে বলল, ডক্টর লামিয়া, আমি মাসুদ রানা। তোমার সাহায্যের আবেদন শুনেছি, সাহায্য করতে এসেছি। যদি আমার কথা শুনে থাকো, ফ্রন্ট ডেস্কে যোগাযোগ করো।

পি.এ, সিস্টেমের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে রানার কণ্ঠ। একটু জড়ানো মনে হচ্ছে, কিন্তু প্রতিটা শব্দ বোঝা যাচ্ছে স্পষ্টভাবে। কথাগুলো আবার বলতে যাচ্ছিল ও, এমন সময় শব্দ করে খুলে গেল এস্ট্রেন্সের অটোমেটিক দরজা। একটু চমকে উঠে ঘুরে তাকাল রানা-সোহেল। কিন্তু ভারী স্যুটের কারণে কাজটা করতে সময় লাগল ওদের। যতক্ষণে ঘুরল, তখন বন্ধ হয়ে গেছে দরজাটা। কেউ নেই সেখানে।

গুঞ্জন করছে ফ্রন্ট ডেস্কের লাইন, প্যানেলের একটা সাদা আলো জ্বলতে-নিভতে শুরু করেছে। টের পাওয়ামাত্র আবার ঘুরল রানা, চেপে ধরল স্পিকারের বাটন।

হ্যালো? শোনা গেল একটা উদ্বিগ্ন নারীকণ্ঠ। কেউ আছ? ডক্টর লামিয়া বলছি।

স্পিকারের উপর ঝুঁকে পড়ল রানা। আপনার রেডিও কল শুনেছি আমরা। সাহায্য করতে এসেছি।

তোমার পরিচয়?

ডুবুরি বলতে পারো। লিনোসার কাছেই ছিলাম।

মনে হচ্ছে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হওনি তুমি। কীভাবে ঘটল ঘটনাটা? এই দ্বীপের যে-ই স্পর্শ পেয়েছে ওই বিষবাষ্পের, সে-ই মরেছে। নিজ চোখে দেখেছি।

বিষবাষ্পের উপস্থিতি আন্দাজ করে বিশেষ পোশাক পরে এসেছি।

চার তলায় আটকা পড়ে আছি আমরা। প্ল্যাস্টিকের শিট আর সার্জিকাল টেপ দিয়ে একটা অপারেটিং রুম ভালোমতো বন্ধ করে নিয়েছি। কিন্তু বেশিক্ষণ থাকতে পারব না এখানে। অক্সিজেন ফুরিয়ে যাচ্ছে, কার্বন ডাই অক্সাইড বাড়ছে।

ইটালিয়ান আর্মির একটা রেসপন্স টিম আসছে। তবে সময় লাগবে।

কতক্ষণ?

ঘন্টা দেড়েক।

অতক্ষণ টিকে থাকা সম্ভব না। আমরা উনিশজন আছি এখানে। তাজা বাতাসের জরুরি দরকার।

বাড়তি একজোড়া ডুবুরির পোশাক সঙ্গে করে এনেছি আমরা। হ্যাঁণ্ডহেল্ড ইমার্জেন্সি অক্সিজেন ট্যাঙ্কও আছে। …সারা শরীর ঢেকে রাখা যায়, এ-রকম কোনও স্যুট নেই হাসপাতালে?

নেই।

অক্সিজেন বটল নিশ্চয়ই আছে? প্রত্যেক হাসপাতালে থাকে ওই জিনিস।…তোমাদের সাপ্লাই রুম কত তলায়? যত বেশি সম্ভব অক্সিজেন বটল নিয়ে আসছি আমরা। ইটালিয়ান আর্মি আসার আগ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারবে তোমরা সবাই।

তৃতীয় তলায়।…প্লিয, জলদি করো।

লাইন কেটে দিল রানা, এগিয়ে যাচ্ছে এলিভেটরের দিকে। ওর আগেই সেদিকে হাঁটা ধরেছে সোহেল।

বাটনে চাপ দেয়ামাত্র খুলে গেল দরজা। এলিভেটরের এককোনায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে একজন ডাক্তার আর একজন নার্স।

ভিতরে ঢুকে তিন সংখ্যাটা লেখা বাটনে চাপ দিল রানা, আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে গেল দরজা। উপরে উঠছে এলিভেটর।

টুং করে আওয়াজ হলো, হলে বেরিয়ে এল রানা। ডাক্তারের লাশ টেনেহিঁচড়ে এলিভেটরের দরজার একটু বাইরে বের করে রাখল সোহেল, তৈরি হয়ে গেল একটা অটোমেটিক ডোরস্টপ।

সাপ্লাই রুমটা হলের শেষমাথায়, চাবি না থাকায় ভিতরে ঢুকতে হলো দরজা ভেঙে। মেডিকেল অক্সিজেন লেখা একটা কেইজ দেখা যাচ্ছে অনতিদূরে। কাছে গিয়ে ওটা খুলল রানা। ভিতরে অক্সিজেনের সবুজ বোতল দেখা যাচ্ছে আটটা।

ঠেলে একটা চাকাওয়ালা গার্নি নিয়ে এল সোহেল। এটাতে দে সবগুলো বোতল।

গার্নিতে বোতলগুলো তুলে সাপ্লাইরুমের বাইরে বেরিয়ে এল রানা আর সোহেল, ওটা ঠেলতে ঠেলতে এগিয়ে যাচ্ছে এলিভেটরের দিকে। টুং করে আওয়াজ হলো আবারও-অন্য একটা এলিভেটরের দরজা খুলে যাচ্ছে।

ওটা থেকে টলতে টলতে বেরিয়ে এল বাদামি চামড়ার এক লোক। পড়ে যাচ্ছিল, দেয়াল ধরে সামলে নিল কোনওরকমে। সাহায্য করুন আমাকে! বলল করুণ গলায়, প্লিয!

থমকে গেছে রানা, কিন্তু সামলে নিল। গার্নিটা সরিয়ে রাখল একপাশে, এগিয়ে গেল লোকটার দিকে।

আগম্ভকের চোখ দুটো বন্ধ ছিল প্রথমে, কিন্তু রানা কাছে যেতেই হঠাৎ তাকাল সে। মানসিক বিকার বা ভয়ের কোনও লক্ষণ নেই সে-চোখে, বরং প্রচণ্ড বিদ্বেষ আছে। তার উদ্দেশ্য বুঝিয়ে দেয়ার জন্য খাটো ব্যারেলের একটা পিস্তল বের করল ঝট করে।

ওটা রানার দিকে তাক করেই টান মারল ট্রিগারে।

.

০৪.

সরু হলওয়েতে বোমা বিস্ফোরণের মতো শোনল গুলির আওয়াজ।

মেঝেতে পড়ে গেছে রানা, কাত হয়ে আছে একদিকে। নড়ছে না।

চমকে গেছে সোহেল, কিন্তু রিফ্লেক্স হারায়নি। ওর দিকে পিস্তলওয়ালা ঘোরার আগেই যতদ্রুত-সম্ভব আগে বাড়ল, গ্লাভস-পরা হাত দিয়ে ঘুসি মারল লোকটার পিস্তল-ধরা হাতে। পর পর দুবার ট্রিগারে টান দিয়ে ফেলল আগন্তক, বুলেট দুটো গিয়ে বিধল দেয়ালে। সোহেলের হেলমেট খাঁটি ইস্পাতের ফুটবলে হেড করার কায়দায় ওটা দিয়ে আগন্তুকের মাথায় আঘাত করল ও। টলে উঠল লোকটা, বেসামাল হয়ে গেছে। ওই সুযোগে তার পিস্তলধরা হাতে আরেকবার ঘুসি হকাল সোহেল। অস্ত্রটা পড়ে গেল লোকটার হাত থেকে। ওটাকে লাথি মেরে হলওয়ের আরেকদিকে পাঠিয়ে দিল সোহেল।

নিজেকে সামলে নিয়েছে আগন্তুক, ছুট লাগিয়েছে পিস্তলের উদ্দেশে। লোকটাকে ল্যাং মারল সোহেল। হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল সে, কিন্তু উঠে দাঁড়াল। একটা লাথি হাঁকাল সোহেলের উদ্দেশে, জুতসই হলো না সেটা।

ভারী ড্রাই স্যুটের কারণে আনআর্মড কমব্যাটের কৌশল কাজে লাগাতে পারছে না সোহেল। খানিকটা এগিয়ে গিয়ে আগন্তুককে জাপ্টে ধরল সে। ধস্তাধস্তি শুরু হয়ে গেল দুজনের মধ্যে। একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে আছড়ে পড়ল একটা দরজার উপর। ওটার গায়ে লেখা আছে: সাবধান! এম.আর.আই.। একঝটকায় খুলে গেল দরজাটা, হুড়মুড় করে ভিতরে ঢুকে পড়ল দুজনে।

এবার ল্যাং মারল আগন্তুক, পড়ে গেল সোহেল। কিন্তু পড়ার আগমুহূর্ত পর্যন্ত ছাড়েনি লোকটাকে, তাই সোহেলের সঙ্গে আছড়ে পড়ল সে-ও।

মেঝের সঙ্গে ভারী স্যুট, বিশেষ করে হেলমেটের সংঘর্ষটা কাঁপিয়ে দিল সোহেলকে, মাথা ঘুরে উঠল ওর। দৃষ্টি কয়েক মুহূর্তের জন্য ঝাপসা হয়ে এল ওর, দেখতে পাচ্ছে না হামলাকারী লোকটা কোথায়। চোখের সামনে সবকিছু পরিষ্কার হওয়ামাত্র উঠে দাঁড়াল।

মেঝেতে পড়ে আছে হামলাকারী লোকটা। মনে হচ্ছে অজ্ঞান হয়ে গেছে।

ঘুরল সোহেল, এক পা আগে বাড়ল দরজার দিকে। সঙ্গে সঙ্গে চক্কর দিয়ে উঠল ওর মাথা। ওর মনে হচ্ছে, কেউ অথবা কিছু একটা যেন পেছন থেকে টেনে ধরে রাখার চেষ্টা করছে। ওকে। চেষ্টা করল আরেক পা আগে বাড়ার, সঙ্গে সঙ্গে টলে উঠল আবারও।

ব্যাপার কী, ভাবছে সোহেল। ড্রাই স্যুট অথবা ডাক্ট টেপের ব্যাণ্ডেজের কোনও জায়গা ছিঁড়ে গেছে? বিষবাষ্প ঢুকছে ওখান দিয়ে, আর সে-কারণেই এ-রকম লাগছে ওর? কিন্তু বিষবাষ্প কেন পেছন থেকে টেনে ধরে রাখার চেষ্টা করবে ওকে?

আরেক পা আগে বাড়তে গিয়ে সোহেল বুঝল, যা ঘটছে তা বাস্তব। কেউ যেন ওর শোল্ডার ব্লেডে দড়ি বেঁধে রেখেছে, ও এগোনোর চেষ্টা করলেই টেনে ধরছে পেছন থেকে।

ব্যাপার কী বোঝার চেষ্টা করল সোহেল। ধস্তাধস্তি করতে করতে হাসপাতালের এম.আর.আই. ল্যাবের দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়েছে হামলাকারী লোকটাকে নিয়ে। ফুট দশেক দূরে দাঁড়িয়ে আছে ছোটখাট গাড়ির সমান একটা মেশিন। ওটার ভিতরে আছে প্রচণ্ড শক্তিশালী চুম্বক, এবং যে কোনও কারণেই হোক চালু অবস্থায় আছে ওটা। লোহা বা লোহাজাতীয় কোনওকিছু নাগালে পাওয়ামাত্র টেনে ধরবে মেশিনটা। সোহেলের পিঠে ঝুলছে স্টিলের একটা ট্যাঙ্ক, মাথায় আছে ইস্পাতের হেলমেট।

ঘুরল ও, চৌম্বকীয় শক্তির বিরুদ্ধে যুঝছে। শক্তিটা বার বার বেসামাল করে দেয়ার চেষ্টা করছে ওকে। সোজাসুজি না এগিয়ে আড়াআড়িভাবে এগোনোর চেষ্টা করছে। তেমন। একটা সফল হতে পারছে না, এগোনোর গতি খুব ধীর। মাথাটা ঘুরাতে শুরু করেছে আবার। নিজেও বলতে পারবে না কখন আছড়ে পড়ল মেঝেতে, বলতে পারবে না কখন উড়াল দিল ওর শরীরটা মেশিনের দিকে। ওর পিঠ, দুই পা আর বাঁ হাতটা আটকে গেছে মেশিনের গায়ে, শুধু ডান হাতটা নাড়াতে পারছে। মাকড়সার জালে ধরা পড়লে পোকার যে অবস্থা হয়, ওর হয়েছে তা-ই।

জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল হামলাকারী লোকটা, নড়াচড়া করছে এখন। উঠে দাঁড়াল আস্তে আস্তে, সোহেলের অবস্থা দেখে দাঁত কেলিয়ে হাসছে। পিস্তলটা খুঁজে বের করে হাতে নিল, কিন্তু ওটা সোহেলের দিকে তাক করামাত্র তার হাত থেকে ছুটে গেল ওটা, উড়ে গিয়ে ঠং শব্দে আটকে গেল মেশিনের গায়ে-সোহেলের পাশে।

শরীর বার বার মোচড়াচ্ছে সোহেল, পিস্তলটার নাগাল পাওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু ধরতে পারল না ওটা।

আশ্চর্য হয়েছে হামলাকারী লোকটা, কিন্তু সামলে নিল। একটা খঞ্জর বের করল এবার, ওটা শক্ত করে ধরে এগিয়ে আসছে সোহেলের দিকে। নিজের সাফল্যের ব্যাপারে শত ভাগ নিশ্চিত।

বাঁচার তাগিদে সর্বশক্তিতে আরেকবার শরীর মোচড়াল সোহেল, মুক্ত করতে সক্ষম হলো একটা পা। হামলাকারী লোকটা ততক্ষণে পৌঁছে গেছে ওর কাছে, খঞ্জর তুলেছে। ওর নাকেমুখে জুতসই একটা লাথি বসিয়ে দিল সোহেল। তেলে গেল লোকটার ঠোঁট, রক্ত বেরিয়ে এসেছে, আপনাআপনি নেমে গেছে খঞ্জরধরা হাত। দাঁতে দাঁত পিষল সে, বিষদৃষ্টিতে তাকাল সোহেলের দিকে, আবার খঞ্জর তুলছে।

দরজার গোবরাটে এমন সময় উদয় ঘটল রানার। ওর হাতে আইভি স্ট্যাণ্ডের ধাতব একটা রড। মুহূর্তেই বুঝে নিল ঘরের পরিস্থিতি। হামলাকারী লোকটাকে নিশানা করে জ্যাভেলিন থ্রোর মতো ছুঁড়ে মারল রডটা। ওটা চুম্বকের টানে লোকটার পিঠে বিধল বর্শার মতোই, বুক ফুঁড়ে বেরিয়ে গিয়ে আটকে গেল মেশিনের সঙ্গে। খঞ্জরধরা হাত স্থির হয়ে গেল লোকটার, আঙুলগুলো শিথিল হয়ে যেতেই অস্ত্রটা নিজেকে যেন সঁপে দিল মেশিনের কাছে।

সোহেলের দিকে তাকিয়ে আছে রানা। সোহেলের অ্যাক্রিলিক ফেইস-শিল্ডের একদিকে চিড় ধরেছে, কপালের একটা পাশ কেটে গেছে, রক্ত দেখা যাচ্ছে চেহারায়।

আগে বাড়বি না! রানাকে সতর্ক করল সোহেল। নইলে আমার মতো অবস্থা হবে তোরও।

ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে রানা, শক্ত করে চেপে ধরে আছে দরজার হাতল যাতে চুম্বক টেনে নিতে না পারে ওকে। এদিকওদিক তাকাচ্ছে। হাতের বাঁয়ে, প্লেক্সিগ্লাসের আড়ালে দেখা যাচ্ছে এম.আর.আই. কন্ট্রোল রুম। ভিতরে কেউ নেই।

মেশিনটা বন্ধ করা যায় কীভাবে, বল তো?

নিয়মকানুন জানা না থাকলে পারবি না, বরং উল্টো বিপদ বাড়তে পারে। তুই বরং যত জলদি সম্ভব খুঁজে বের করার চেষ্টা ক লামিয়াকে, ওকে নিয়ে এখানে আয়।

ইঙ্গিতে হামলাকারী লোকটাকে দেখাল রানা। ওই ব্যাটার সমস্যা কী?

ওর বুক ছেঁদা করে বেরিয়ে এসেছে তোর জ্যাভেলিন, এ ছাড়া আর কোনও সমস্যা নেই।

না থাকলে আমাদেরকে পরপারে পাঠানোর চেষ্টা করছিল কেন?

অনেক চেষ্টা করেও পরপারে যেতে পারছিল না, শেষে আমাদেরকে উছিলা বানিয়েছে।

মাথা নাড়ল রানা, এত সহজে মেনে নিতে পারছে না সোহেলের কথা। ওই ব্যাটা সাধারণ কাপড় পরে ঘুরছিল, চেহারায় মাস্কও নেই।

তারমানে বাতাস হয়তো পরিষ্কার হয়ে গেছে এতক্ষণে। তারমানে,..

না! চেঁচিয়ে উঠল রানা, কোনও ঝুঁকি নিবি না! বাতাস আসলেই পরিষ্কার হয়েছে কি না তা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত স্যুট পরে থাক্। লামিয়াকে খুঁজতে যাচ্ছি আমি।

তোকে পাহারা দিতে পারলে ভালো হতো-বলা যায় না, মেয়েটা সুন্দরী হতে পারে!

ভাগ্যদেবী চায় না তুই আমাকে ডিসটার্ব করিস, সোহেলের বর্তমান অবস্থায় হাসি পেল রানার। মেয়েমানুষের বাহুডোর যখন কপালে জুটল না এ-জীবনে, এম.আর.আই. মেশিনের প্রেমেই আটকে থাক্‌ কিছুক্ষণ।

শালা…

আর কিছু শোনার প্রয়োজন মনে করল না রানা, পা বাড়াল হলের দিকে।

.

অপারেটিং রুমের একদিকের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে মেঝেতে বসে আছে লামিয়া, অপেক্ষা করছে অসহায়ের মতো। কখনও কল্পনাও করেনি এ-রকম কোনও পরিস্থিতিতে পড়তে হবে।

পনি টেইল চুলে আঙুল চালাল সে। আস্তে আস্তে ফুরিয়ে আসছে বদ্ধ ঘরের বাতাস, টের পাচ্ছে সেটা। করার মতো কিছুই নেই, কারণ কিছু করতে গেলেই বাড়তি অক্সিজেনের দাবি জানাবে ফুসফুস। ল্যাব কোটের একটা কোন ধরে কিছুক্ষণ মোচড়াল সে, কোনটা কুঁচকে যেতেই আবার সোজা করার চেষ্টা করল। ইচ্ছা করেই তাকাচ্ছে না ঘড়ির দিকে। কারণ আগে যতবার করেছিল কাজটা, দরজার সিল ছিঁড়ে ফেলার ইচ্ছা হয়েছিল ততবার। ইচ্ছা করছিল, দম আটকে রেখে একছুটে বন্দরে গিয়ে হাজির হতে, তারপর কোনও একটা স্পিডবোট বা নৌকায় চেপে…

কিন্তু লামিয়া জানে, দম আটকে রেখে দৌড়াতে দৌড়াতে বন্দরে হাজির হওয়া সম্ভব না ওর পক্ষে।

বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ যখন কমে আসে, তখন দপদপ করতে থাকে মাথা, ব্যথা ওঠে শরীরের জায়গায় জায়গায়, দুর্বল লাগতে থাকে। লামিয়ারও হচ্ছে ওসব। তারপরও ও জানে, শেষপর্যন্ত ঘরের ভিতরেই থাকতে হবে ওকে। কারণ ঘরের বাতাস দূষিত, আর বাইরের বাতাস প্রাণঘাতী, বিষাক্ত। ঘরের ভিতরে টিকে থাকা যাবে হয়তো আরও পাঁচ-সাত মিনিট; বাইরে বের হলে দশ সেকেণ্ডও বেঁচে থাকা যাবে না।

লামিয়া তাই অপেক্ষা করছে। টের পাচ্ছে, একটু একটু করে কাছিয়ে আসছে মৃত্যু। কিছুই করার নেই বলে ভাবছে অতীত নিয়ে।

ইটালির মিলানে জন্ম ওর, বড় হয়েছে দেশটার বিভিন্ন জায়গায়। ক্যারাবিনারি, মানে ইটালির মিলিটারি পুলিশে চাকরি করতেন ওর বাবা; পোস্টিং ছিল আজ এখানে তো কাল ওখানে। পাঁচ বছর বয়সে একটা দুর্ঘটনায় মাকে হারায় সে। তখন ইটালিতে অপরাধ প্রবণতা বেড়ে গিয়েছিল অনেক। স্ত্রীর মৃত্যু মেনে নিতে পারেননি ওর বাবা, অপরাধের বিরুদ্ধে অঘোষিত ক্রুসেডের প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করেন তিনি। মেয়েকে গড়ে তুলতে শুরু করেন নিজের হাতে, আর সেই সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যান অপরাধ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে।

বাবার সাহস, সহিষ্ণুতা আর দৃঢ়সঙ্কল্পের কিছুটা হলেও পেয়েছে লামিয়া। মার কাছ থেকে পেয়েছে রূপ ও ধীশক্তি। স্কলারশিপ নিয়ে পড়েছে মেডিকেল স্কুলে, শিক্ষাজীবনের সব পরীক্ষাতেই প্রথম হয়েছে। নিজের হাতখরচ নিজেই জোগানোর জন্য মডেলিং করেছে। কিন্তু জানত, ক্যারিয়ার হিসেবে গ্রহণ করতে পারবে না ওই পেশা, কারণ জীবন্ত ক্লথ হ্যাঁঙার হিসেবে ওর পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি উচ্চতার শরীরটা পাত্তাই পাবে না ইউরোপিয়ান মডেল-জগতে।

মেডিকেল স্কুলের গণ্ডি পেরুনোর পরই চাকরি পেয়ে যাওয়ায় হাতখরচ কেন, অন্যান্য অনেক খরচ নিয়েও আর চিন্তা করতে হয়নি ওকে। এখন ঊনত্রিশ বছর বয়সে ওকে দেখায় তরুণী সোফিয়া লোরেনের মতো। মাঝেমধ্যে যখন টের পায় ওর পুরুষ কলিগরা একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে ওর দিকে, তখন আত্মতৃপ্তি আর লজ্জা একইসঙ্গে ছুঁয়ে যায় ওকে।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল লামিয়া। যে-মিশনে ওকে পাঠানো হয়েছে লিনোসায়, শেষপর্যন্ত সফল হতে পারবে কি না, ভাবছে। বদ্ধ বাতাসে বুক ভরে দম নেয়ার চেষ্টা করল আরেকবার, এবং আবারও ব্যর্থ হলো–কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ আরও বেড়েছে। তাকাবে কি তাকাবে না ভাবতে ভাবতে হাতঘড়ির দিকে তাকিয়েই ফেলল।

মিনিট দশেক আগে কথা হয়েছে মাসুদ রানার সঙ্গে।

ফ্রন্ট ডেস্ক থেকে এখানে আসতে এত সময় লাগছে কেন লোকটার? জিজ্ঞেস করল ওর পাশে বসে থাকা এক ল্যাব টেকনিশিয়ান।

এলিভেটর কাজ করছে না মনে হয়, ঠাট্টা করার চেষ্টা করল লামিয়া, কিন্তু প্রাণহীন শোনাল ওর কণ্ঠ। উঠে দাঁড়াল ক্লান্ত ভঙ্গিতে, দেয়ালে ভর দিয়ে তাকাল অন্যদের দিকে।

যে-কজনকে বাঁচাতে পেরেছে সে, তাদের সবাই আছে ঘরের ভিতরে। ল্যাব টেকনিশিয়ান ছাড়াও আছে একজন নার্স, চারটে বাচ্চা এবং বারোজন পূর্ণবয়স্ক রোগী–একেকজন একেক অসুখে ভুগছে।

ওই বারোজনের মধ্যে তিনজন তিউনিসিয়ার অভিবাসী, একটা রৌ-বোটে করে পালিয়ে এসেছে। সামুদ্রিক খররোদ ফোস্কা ফেলে দিয়েছে ওদের চামড়ায়, তারপর একটা আকস্মিক ঝড় গায়েব করে দিয়েছে ওদের অনেক সহযাত্রীকে। বেঁচে-থাকা কয়েকজন যখন বোট থেকে পড়ে গিয়ে সাঁতার কাটছিল লিনোসা উপকূল অভিমুখে, তখন পিছু ধাওয়া করে এসে ছজনকে খেয়েছে হাঙরের দল। শেষপর্যন্ত বাঁচতে পেরেছিল ওরা তিনজন, এখন আবার মরতে বসেছে।

ঘরের ভিতরে আর একটা মাত্র পোর্টেবল অক্সিজেন বটল আছে, বাকিগুলো খালি হয়ে গেছে। ভালভ খুলে দিল লামিয়া। হিসহিস শব্দে গ্যাস বেরিয়ে আসার কথা, কিন্তু ঘটল না ঘটনাটা। তারমানে এই বোতলও খালি।

হাত থেকে বোতলটা ছেড়ে দিল লামিয়া, টলমল পায়ে এগোতে শুরু করেছে দরজার দিকে। মাথার ভিতরটা আরও ফাঁকা লাগছে ওর। যত এগোচ্ছে, টলমল ভাব তত বাড়ছে।

দরজার পাল্লার সঙ্গে লাগানো আছে পুরু কাঁচ, ওপাশে এসে দাঁড়িয়েছে একটা লোক।

লোক? সে যদি সাধারণ কোনও মানুষ হবে তা হলে নভোচারীদের মতো পোশাক পরে আছে কেন? নাকি ভিনগ্রহের কোনও আগন্তুক? এসব কি ভাবছে লামিয়া? হ্যাঁলুসিনেশন হচ্ছে না তো ওর?

উবু হলো সে, একটানে ছিঁড়ে ফেলতে চায় পাল্লা আর মেঝের মাঝখানের শূন্যস্থান আটকে-রাখা টেপ।

না! চেঁচিয়ে উঠল কে যেন।

আরও ফাঁকা হয়ে গেল লামিয়ার মাথার ভিতরটা, হাঁটুতে ভর দিয়ে মেঝেতে পড়ে গেল সে। ওই অবস্থায় টলে উঠল আবার, এবার পড়ল একদিকে কাত হয়ে। দেখল, টেপের বাধা ডিঙিয়ে ভিতরে ঢুকছে পাতলা একটা টিউব। সাপের মতো হিসহিস শব্দ করছে ওটা। কোনও সাপই ঢুকে পড়ছে। কি না কে জানে!

একটু একটু করে পরিষ্কার হচ্ছে লামিয়ার মাথা, স্বাভাবিক হয়ে আসছে চিন্তাশক্তি। টিউবের মাধ্যমে আসলে অক্সিজেন ঢোকানো হচ্ছে ঘরের ভিতরে। বিশুদ্ধ অক্সিজেন।

বুক ভরে দম নেয়ার চেষ্টা করল লামিয়া। হ্যাঁ, এবার পারছে। কাঁপছে ওর শরীরটা-একটানা দৌড়ানোর পর কোনও অ্যাথলেটের শরীর যেভাবে কাপে সেইভাবে।

আরেকটা টিউব আসছে দরজার নিচ দিয়ে, হিসহিসানি দ্বিগুণ হয়েছে। ঘরের বাকিরা যাতে অক্সিজেন পায় সেজন্য গড়িয়ে দরজার কাছ থেকে সরে গেল লামিয়া। শরীরে জোর পাচ্ছে এখন, উঠে দাঁড়াল। নভোচারী লোকটাকে আবার দেখা যাচ্ছে কাঁচের ওপাশে। লামিয়াকে উঠে দাঁড়াতে দেখে দরজার কাছ থেকে সরে গেল লোকটা, ইন্টারকম টেলিফোনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। অপারেটিং রুমের সেটটা বেজে উঠল কিছুক্ষণের মধ্যেই।

সবাই ঠিক আছে? লামিয়া কলটা রিসিভ করামাত্র জানতে চাইল রানা, কণ্ঠে উদ্বেগ।

মনে হয়, বলল লামিয়া। তোমার মাথায় কী হয়েছে? রক্ত পড়ছে দেখলাম। মনে পড়ে গেল, একটু আগে গুলির শব্দ শুনেছে। গোলাগুলি হয়েছে নাকি হাসপাতালের ভিতরে? কেউ হামলা চালিয়েছে তোমার উপর?

আপনার শেষ দুটো প্রশ্নের জবাব হ্যাঁ, গম্ভীর গলায় বলল রানা।

লোকটা দেখতে কেমন? একা ছিল?

বলছি। তবে তার আগে বলো তো, তুমি বা তোমরা কি ও-রকম কোনও ঘটনার আশঙ্কা করছিলে?

ইতস্তত করছে লামিয়া। বলতে গিয়ে বেশি বলে ফেলছে না তো? কাঁচের ওপাশের লোকটাও যে শত্রুপক্ষের কেউ না, নিশ্চিত হওয়ার উপায় কী? কিন্তু…শত্রুপক্ষের কেউ হলে বাঁচানোর চেষ্টা করছে কেন লামিয়াদেরকে?

কাঁচ ভেদ করে লোকটার দিকে তাকিয়ে আছে লামিয়া। লোকটাও একদৃষ্টিতে দেখছে মেয়েটাকে। হেলমেটের কারণে চেহারা ঠিকমতো ঠাহর করা যায় না ওই লোকের, কিন্তু অন্তর্ভেদী দৃষ্টি চেনা যায়।

মাসুদ রানার সঙ্গে কথা বলার সিদ্ধান্ত নিল লামিয়া, তবে এখনই না।

.

চুরুটে আগুন ধরিয়ে সুইভেল চেয়ারে হেলান দিলেন মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) রাহাত খান, তাকিয়ে আছেন মুখোমুখি-বসা সোহানার দিকে। বুক ভরে টেনে নিলেন কটুগন্ধী ধোঁয়া। ভূমধ্যসাগরে ঘটেছে ঘটনাটা?

জী, স্যর। ল্যাপটপের স্ক্রিনে চোখ বুলিয়ে নিল সোহানা। লিনোসা উপকূল থেকে কয়েক মাইল দূরে অবস্থান করছিল এম.ভি. টায়ানা। আশঙ্কা করা হচ্ছে সন্ত্রাসীরা হামলা করেছে জাহাজটাতে এবং একইসঙ্গে ওই দ্বীপে। বাতিল করা হয়েছে লিনোসার সব ফ্লাইট।

আর?

কী জানতে চাইছেন মেজর জেনারেল, বুঝতে পারল সোহানা। লিনোসা উপকূলে নুমার ব্যানারে বিসিআই-এর যে-এক্সপেডিশন কোর্স পরিচালিত হচ্ছিল, তা পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়নি। তবে…

সি-হর্সে যোগাযোগ করে রানা আর সোহেলকে পাওয়া যায়নি, তা-ই তো?

জী, স্যর। ক্যাপ্টেন বলছে, প্রাণঘাতী একটা কালো কুয়াশার বিস্তার ঘটেছে ওই এলাকার অনেকখানি জুড়ে। সাহায্যের আবেদন জানানো হয়েছে লিনোসা থেকে। নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে সেখানে গেছে রানা আর সোহেল।

ওই দ্বীপে আমাদের একটা লজিসটিক্স সাপোর্ট টিম আছে। ওদের খবর কী?

খবর নেই, স্যর। যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে না ওদের সঙ্গেও।

পিঠ খাড়া করলেন রাহাত খান, চুরুটের কোনও স্বাদ পাচ্ছেন না। ওটা সরালেন মুখ থেকে। রানা-সোহেল ঠিক কাজ করেছে।

.

০৫.

 রানা, সোহেল এবং লিনোসা-থেকে-উদ্ধারকৃত অন্যরা বসে আছে একটা ইটালিয়ান সাপ্লাই শিপের ডেকে, মুক্ত বাতাসে। জাহাজটার ফানেলে বড় একটা রেড ক্রস দেখা যাচ্ছে।

রাসায়নিক দূষণ বা বিষক্রিয়া ঠেকাতে সক্ষম এমন পোশাকে নিজেদেরকে আপাদমস্তক আবৃত করে ইটালিয়ান আর্মির একদল সৈন্য গিয়েছিল ওই দ্বীপে, যারা বেঁচে আছে তাদেরকে উদ্ধার করেছে, তারপর হেলিকপ্টারে করে নিয়ে এসেছে নিরাপদ দূরত্বে।

ডিকন্টামিনেশন শাওয়ার নিতে হয়েছে ওদের সবাইকে, করতে হয়েছে একগাদা মেডিকেল টেস্ট। পোশাক হিসেবে পরতে দেয়া হয়েছে বাড়তি মিলিটারি ইউনিফর্ম। গলা ভেজানোর জন্য প্রত্যেকের হাতে ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। এসপ্রেসোর ধোঁয়াওঠা কফির মগ। এত ভালো কফি শেষ কবে খেয়েছে, মনে করতে পারছে না রানা। দ্বিতীয় মগ কফি গিলে সোহেলকে বলল, লামিয়াকে দেখতে পাচ্ছি না কোথাও।

ওর যেখানে মন চায় সেখানে গেছে, তোর কী?

কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করার ছিল মেয়েটাকে।

 কী কথা?

আমাদেরকে খুন করতে চাইছিল যে-লোক, মনে হচ্ছে। তার ব্যাপারে এমনকিছু জানে মেয়েটা, যা আমরা জানি না।

একটা দুর্ঘটনার সঙ্গে খুন করার উদ্দেশ্যে চালানো হামলার সম্পর্ক কী?

জানি না, কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল রানা। তারপর বলল, আমাদের পাঁচ এজেন্টের মৃত্যু মেনে নিতে পারছি না।

কালো কুয়াশার বিস্তার ঘটল লিনোসার আকাশে, মরতে শুরু করল ওখানকার লোকজন, যে-কজনকে পারল সঙ্গে নিয়ে অপারেটিং রুমে ঢুকল ডক্টর লামিয়া, সিল করে দিল রুমটা যাতে বাইরের বাতাস ঢুকতে না পারে সেখানে। যে রেসপন্স দেখিয়েছে সে, একজন ডাক্তারের জন্য বেশি হয়ে যাচ্ছে না সেটা?

ঝামেলা আশা করছিল এ-রকম কারও জন্য রেসপন্সটা স্বাভাবিক, এদিকওদিক তাকাচ্ছে রানা।

উদ্ধারকৃত সবার ওপর নজর রাখছে তিনজন ইটালিয়ান সৈন্য। তবে যেহেতু উদ্ধার করা হয়েছে রানাদেরকে, গ্রেপ্তার করা হয়নি, সেহেতু পাহারা দেয়ায় ঢিলেমি দেখা যাচ্ছে ওই তিন সৈন্যের মধ্যে। দূরের রেইলে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দুজন, নিচু গলায় কথা বলছে। তৃতীয়জন নিঃসঙ্গ, প্রথম দুজনের চেয়ে একটু কাছে আছে রানা-সোহেলের, ছোট একটা মেকানিকাল ক্রেইনের আড়ালে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে।

ইশারায় ওই তিনজনকে দেখাল রানা। ওদের মনোযোগ সরিয়ে দিতে পারবি অন্য কোথাও?

একচুমুকে মগের বাকি কফি শেষ করল সোহেল। পারব।

উঠে দাঁড়াল ওঁ, অলস পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে তিন নম্বর সৈনিকের দিকে। কাছে গিয়ে খেজুরে আলাপ জুড়ে দিল লোকটার সঙ্গে, কথাবার্তার ফাঁকে ফাঁকে হাত নাড়ছে, চেষ্টা করছে যাতে রানার উপর থেকে মনোযোগ সরে যায় লোকটার।

মাথা নিচু করে ছুট লাগাল রানা। বন্ধু একটা হ্যাঁচওয়ের সঙ্গে গাঢ় ছায়া আছে, সেখানে পৌঁছে সোজা হলো, বাল্কহেডে ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্রেইনের ঝুলন্ত বিশাল হুকটা দেখিয়ে কী যেন বলছে সোহেল, মুখ তুলে সেদিকে তাকাল সৈন্যটা। সঙ্গে সঙ্গে হ্যাঁচ খুলে ফেলল রানা, ঢুকে পড়ল ভিতরে। একটুও দেরি না করে লাগিয়ে দিল ওটা।

হ্যাচের ভিতরে প্যাসেজওয়ে আছে, এই মুহূর্তে নির্জন। আশ্চর্য হলো না রানা। সাপ্লাই শিপটা বেশ বড়, দৈর্ঘ্যে ছশ ফুটের মতো। শ দেড়েক লোক আছে জাহাজে, তাই এখানে ভরা জায়গার চেয়ে খালি জায়গাই বেশি। লিনোসা থেকে নিয়ে-আসা লাশগুলো যেখানে রাখা হয়েছে, রানা আশা করছে সেখানে পাওয়া যাবে লামিয়াকে।

হলের দিকে এগোতে শুরু করল ও। টের পেল, জাহাজের অগ্রভাগের দিকে যাচ্ছে। ডিকন্টামিনেশন শাওয়ার আর মেডিকেল টেস্ট ওখানেই হয়েছিল। তারমানে সিক বে-টা কাছাকাছি কোথাও। ওটা খুঁজে পেলে কী করবে, ভাবছে রানা। ঠিক করল, বন্ধ দরজায় নক করার পর গলা বা পেট ব্যথা বলে চেষ্টা করবে ভিতরে ঢুকে পড়ার। মেশিন রুমের বাইরে পড়ে-থাকা একটা ছোট বাক্স তুলে নিল হাতে। ভাবখানা এমন, ওটা যত-জলদি-সম্ভব যথাযথ কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে না দিলেই নয়।

দেখা হয়ে গেল একদল নাবিকের সঙ্গে, জাদুর মতো কাজ করল রানার কৌশল। ওর দিকে একবার তাকিয়েই আগ্রহ হারাল লোকগুলো, যে যার মতো চলে যাচ্ছে। হাঁটার গতি একটু কমাল রানা, ব্যস্ত ভঙ্গিতে এদিকওদিক তাকাচ্ছে-যেন দ্রুত চিনে নেয়ার চেষ্টা করছে সঠিক রাস্তা। অনতিদূরে লোহার-সিঁড়ি নেমে গেছে নিচে, ওটা বেয়ে এক লেভেল নেমে এসে আবার হাঁটতে লাগল।

কিছুক্ষণ পরই বুঝল, হারিয়ে গেছে ও। সিক বে-টা খুঁজে পাওয়ার বদলে কয়েকটা স্টোররুম আর তালাবদ্ধ কমপার্টমেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে আছে এখন। কোনদিকে যাওয়া যায় ভাবছে, এমন সময় সাদা ল্যাব কোট পরা একজন পুরুষ আর একজন মহিলা নেমে এল সিঁড়ি বেয়ে। নিজেদের মধ্যে নিচু গলায় কথা বলছে ওরা।

বাক্সটা নামিয়ে রাখল রানা, পকেট হাতড়াচ্ছে–যেন চাবি খুঁজছে মুখোমুখি দরজাগুলোর কোনও একটার। ওকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল ওই পুরুষ আর মহিলা। ওদেরকে একটু দূরে যেতে দিল রানা, তারপর ফলো করতে শুরু করল। আরও দুটো সিঁড়ি বেয়ে একটা গ্যাংওয়েতে হাজির হলো ওই দুজন, তারপর একটা হচের ভিতরে ঢুকে ভিতর থেকে বন্ধ করে দিল ওটার দরজা।

হ্যাচটার পাশে গিয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে দাঁড়াল, রানা। হাতল ঘুরিয়ে খুলল ওটা। তাকাল ভিতরে।

গুহার মতো একটা ঘর যেন বিস্তৃত হয়েছে সামনে। ছাদ থেকে ঝুলছে অনেকগুলো জ্বলন্ত উজ্জ্বল সাদা বাতি। কার্গো বের মতোই দেখাচ্ছে ঘরটাকে, কিন্তু ভিতরেছফুট বাই তিন ফুটের শত শত ম্যাট্রেসে শুয়ে আছে শত শত মরদেহ। পর্যাপ্ত ম্যাট্রেস না-থাকায় স্টিলের মেঝেতে শুইয়ে রাখা হয়েছে অনেক লাশ। কোনওটার পরনে বেদিংস্যুট-খুব সম্ভব সৈকত থেকে তোলা হয়েছে মৃতদেহগুলো। বাকিদের বেশিরভাগের পরনে শর্টস আর টি-শার্ট। অফিশিয়াল ড্রেসও দেখা যাচ্ছে কারও কারও গায়ে। লিনোসার হাসপাতালে কোনও কোনও স্টাফের গায়ে যে-রকম ধূসর জামা দেখেছিল রানা, কয়েকজন পরে আছে সে-রকম কাপড়।

ঘরের ভিতরে পা রাখল রানা, সারি সারি ম্যাট্রেসের মাঝখান দিয়ে এগোচ্ছে। কালো কুয়াশার কারণে মারা-যাওয়া লাশগুলো দেখে আশ্চর্য হচ্ছে না। কাউকে-না-কাউকে সরাতেই হতো ওগুলো, বার বার হেলিকপ্টারে ঢুকিয়ে বহন করে আনতে হতো এই জাহাজে। ইটালিয়ান মিলিটারির যে ইউনিট উদ্ধার করেছে রানাদেরকে, ওরাই করেছে লাশ উদ্ধারের কাজ। রানা বরং আশ্চর্য হচ্ছে অন্য একটা ব্যাপার খেয়াল করে।

ইলেকট্রোড, মনিটর আর অন্যান্য যন্ত্র জুড়ে দেয়া হয়েছে। কোনও কোনও লাশের সঙ্গে। কোনও কোনও মরদেহের সঙ্গে ঝুলছে আই.ভি.। মেডিকেল স্টাফরা হাতে চোখামতো কী যেন নিয়ে একটু পর পর খোঁচাচ্ছে কোনও কোনও মৃতদেহকে। একজনের শরীরে ইলেকট্রিসিটির তার স্পর্শ করানোমাত্র খিচুনি শুরু হলো, বিদ্যুৎপ্রবাহ বন্ধ করে দিতেই আবার নিথর হয়ে গেল সে।

রানার দিকে খেয়াল নেই মেডিকেল স্টাফদের কারও–যার যার কাজে ব্যস্ত সবাই। এদিকওদিক তাকাতে তাকাতে এগোচ্ছে রানা, বিসিআই-এর এক এজেন্টকে চিনতে পেরে থমকে গেল। যখন দেখল, এজেন্টের মাথা থেকে ইলেকট্রোড খুলে নিয়ে চোখা জিনিসটা হাতে নিচ্ছে, এক স্টাফ, কঠোর কণ্ঠে বলল, কী হচ্ছে এখানে?

কম করে হলেও এক ডজন লোক ঘুরে তাকাল ওর দিকে। হঠাৎ করেই বুঝতে পারছে ওরা, রানা এখানকার কেউ ।

কে তুমি? জিজ্ঞেস করল ওদের একজন, প্রশ্নটা করেছে। হুমকি দেয়ার ভঙ্গিতে।

তোমরা কারা? জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল রানা। মাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি তোমাদের? মরা মানুষগুলোকে নিয়ে এসব কী করছ?

ওর উঁচু কণ্ঠ গমগম করছে বদ্ধ ঘরে। কেউ কেউ মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে, কেউ আবার তাকিয়ে আছে রানার দিকে।

ওর উদ্দেশে কী যেন বলল একজন, ভাষাটা জার্মান বলে মনে হলো ওর কাছে।

আরেকজন চেঁচিয়ে উঠল, সিকিউরিটি! সিকিউরিটি!

হাজির হয়ে গেল ইটালিয়ান মিলিটারি পুলিশের কয়েকজন সদস্য। দুই সারি ম্যাট্রেসের দুদিক দিয়ে তেড়ে আসছে রানার দিকে।

আপনি যে-ই হোন না কেন, রানাকে ইংরেজিতে বলল মেডিকেল স্টাফদের একজন, এখানে ঢুকে পড়ে ঠিক কাজ করেননি।

লোকটার উচ্চারণে ফরাসি টান আছে।

এখান থেকে নিয়ে যান এই লোককে, আমেরিকান ইংরেজিতে মিলিটারি পুলিশদের উদ্দেশে চেঁচাল আরেক স্টাফ।

যার যেভাবে খুশি ঢুকে পড়তে পারছে, অন্য এক স্টাফের কণ্ঠে হতাশা, এভাবে কাজ করা সম্ভব নাকি? নিরাপত্তা বলে কিছু নেই এই জাহাজে।

রানার কাছাকাছি চলে এসেছে মিলিটারি পুলিশরা, এখন হাতে ব্যাটন নিয়ে সতর্ক ভঙ্গিতে এগোচ্ছে রানার দিকে। ঘিরে ধরার চেষ্টা করছে ওকে। ঢিলেঢালা ভাব বজায় রাখার চেষ্টা করছে রানা, কিন্তু প্রস্তুত হয়ে আছে যে-কোনও জরুরি মুহূর্তের জন্য। রেগে গেছে-বিসিআই-এর এজেন্টরা কারও হাতের গিনিপিগ না, সে-লোক যত শক্তিশালীই হোক না কেন।

উনিশজন মানুষের জান বাঁচিয়েছে যে-লোক, শোনা গেল ইটালিয়ান ইংরেজিতে সুললিত একটা নারীকণ্ঠ, তাকে এভাবে অপদস্থ করার মানে কী?

লামিয়া।

 রানা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে কিছুটা উপরে একটা ক্যাটওয়াকে দাঁড়িয়ে আছে। ব্যালে নর্তকীর মতো মোহনীয় ভঙ্গিতে একটা মই বেয়ে নেমে এল। রানা তো বটেই, মেডিকেল স্টাফসহ মিলিটারি পুলিশদের সবাই তাকিয়ে আছে ওর দিকে।

কিন্তু, ডক্টর লামিয়া… বিদেশি এক স্টাফের গলায় প্রতিবাদের সুর।

কিন্তু কিছু না, লোকটাকে থামিয়ে দিল লামিয়া। শুধু উনিশজন মানুষের জীবনই বাঁচায়নি সে, লিনোসায় কী হয়েছে সে-ব্যাপারে সবার আগে কু-ও দিয়েছে। অস্বীকার করতে পারবেন, আমাদের হাতে ওই কু ছিল বলেই এত জলদি ইনভেস্টিগেশন শুরু করতে পেরেছি?

তাই বলে লোকটা নিশ্চয়ই ঢুকে পড়তে পারে না এখানে?

তা হয়তো পারে না, রানার দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকাল লামিয়া। স্বীকার করছি আমিও।

মেয়েটাকে দেখছে রানাও। মেডিকেল স্টাফদের মধ্যে সবচেয়ে খাটো সে, কিন্তু সন্দেহ নেই সে-ই এই আজব ল্যাবরেটরির ইনচার্জ। অদ্ভুত এক দৃষ্টি খেলা করছে মেয়েটার চোখে-যেন রানার সঙ্গে অনেকদিনের পরিচয় ওর, দেখা হয়েছে বহুকাল পর। একটুখানি হাসি দেখা যাচ্ছে ওর ঠোঁটের কোনায়, কিন্তু তা রানার রাগ কমানোর জন্য যথেষ্ট না।

কী হচ্ছে এখানে? লামিয়াকে জিজ্ঞেস করল রানা। একান্তে কথা বলতে পারি? লামিয়ার কণ্ঠে যতটা না অনুমতি প্রার্থনা, তারচেয়ে বেশি তাগাদা।

চলো, বলল রানা।

ল্যাবরেটরি থেকে বের হলো লামিয়া, লাগোয়া ঘোট একটা অফিসরুমে ঢুকল রানাকে নিয়ে। দরজা লাগিয়ে দিল।

এদিকওদিক তাকাচ্ছে রানা। দেখে মনে হয়, জাহাজের কোয়ার্টারমাস্টারের জন্য বরাদ্দ ছিল এই ঘর, মেডিকেল স্টাফরা যাতে ব্যবহার করতে পারে সেজন্য ছেড়ে দেয়া হয়েছে। ওই উদ্দেশ্যে টুকটাক সাজিয়েও নেয়া হয়েছে ঘরটা।

একদিকে ছোট একটা ডেস্ক, ওটার কোনা ঘুরে চেয়ারে বসে পড়ল লামিয়া। মুখোমুখি আরেকটা চেয়ারে বসার ইঙ্গিত করল রানাকে। প্রথমেই আমার জীবন বাঁচানোর জন্য ধন্যবাদ। তোমার সঙ্গে কথা বলতে পারতাম আগেই, কিন্তু…

সময়-সুযোগের অভাবে বলতে পারোনি, বুঝতে পারছি। তোমাকেও ধন্যবাদ। আরেকটু হলে আমাকে গ্রেপ্তার করছিল মিলিটারি পুলিশ।

কপালের উপর নেমে-আসা চুল সরিয়ে কানের পেছনে গুঁজে দিল লামিয়া। অত রেগে গিয়েছিলে কেন?

লাশগুলো নিয়ে কী করছিল মেডিকেল স্টাফরা?

গবেষণা–কোন জাতের বিষের কারণে তথাকথিত লাশ হয়েছে লিনোসার অধিবাসীরা। রক্তপরীক্ষা, টিস্যুর স্যাম্পল কালেকশনসহ ডাক্তারি অনেক ব্যাপার আছে যা বিস্তারিত বলতে গেলে সময় নষ্ট হবে।

চোখা জিনিস দিয়ে লাশের গায়ে বার বার খোঁচা মারা কোন জাতের গবেষণা?

রানাকে চমকে দিল,মেয়েটির উত্তর।

আমরা আসলে বাঁচিয়ে তোলার চেষ্টা করছি ওই লোকগুলোকে।

<

Super User