মায়া মন্দির

০১.

কনকনে ঠাণ্ডা। নভেম্বর মাস।

চারদিকে ভেজা মখমল চাদরের মত ভারী, ধূসর কুয়াশা। আর্কটিক সাগরের বুক চিরে চলেছে পঞ্চাশ ফুটি রাশান ট্রলার যেযদা বা নক্ষত্র।

ওটার নাবিক ও যাত্রীরা ভাগ্যবান, উত্তর মেরু থেকে ধেয়ে আসছে না মৃত্যুশীতল হু-হু হাওয়া। বিপজ্জনক বেয়ারিং সি এখন শান্ত। তাপমাত্রা পনেরো ডিগ্রি ফারেনহাইট, অর্থাৎ -৯.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাপ আরও হ্রাস পেলে সাগর হবে জমাট বরফের সফেদ মাঠ। সেক্ষেত্রে আটকা পড়বে ট্রলার যেযদা।

ফলাফল: সবার নিশ্চিত মৃত্যু!

আবছা আঁধারে পাইলট হাউসে দাঁড়িয়ে আছে ক্যাপ্টেন সার্গেই দিমিতভ, দমে গেছে মন। রুক্ষ চেহারার বয়স্ক লোক সে। লালচে, বড় সাইজের বেলের মত ন্যাড়া মাথা। এ মুহূর্তে চোয়াল দৃঢ়বদ্ধ। ঝুঁকে পড়েছে ষাঁড়ের কাঁধের মত মস্ত দুই কাঁধ। ভীত ও চিন্তিত সে। ট্রলারের বো-র ওপর দিয়ে চেয়ে আছে দূরে। কান পেতে শুনছে, পুরনো লোহার খোলে ঠুং-ঠাং শব্দে টোকা দিচ্ছে ছোট-বড় মেরু বরফের চাই। ওই শব্দ ছাপিয়ে কানে আসছে ইঞ্জিনের চাপা ধুব-ধুব আওয়াজ।

এখানে-ওখানে ভাসছে সাদা, ছোট বরফের চাই। তারই মাঝ দিয়ে অর্ধেক গতি তুলে চলেছে দিমিতভের ট্রলার। 

বছরের এ সময়ে হঠাৎ করেই মারাত্মক প্লেগের মত বরফের মাঠ ছড়িয়ে পড়ে দক্ষিণ-সাগরে। অথচ মাত্র একঘণ্টা আগেও হয়তো ওখানে ছিল উন্মুক্ত টলটলে জল।

অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে সাগর পাড়ি দিচ্ছে দিমিতভ। ভাল করেই জানে, কত বড় ঝুঁকি নিয়েছে। উষ্ণ জলে ফিরতে না পারলে চারপাশ থেকে ট্রলারটাকে চেপে ধরবে কঠিন বরফ। শত মাইল বিস্তৃত হিম-প্রান্তরে এমন কেউ নেই যে সাহায্য করবে।

ওরা যা করেছে, তাতে ওদের বোধহয় প্রাপ্যই হয় এমনি শীতল, করুণ মৃত্যু!

ধু-ধুম! শব্দে বড় এক টুকরো হিমশিলা লাগতেই থরথর করে কাঁপল ট্রলার। বরফের টুকরো আকারে বাড়ছে, দিমিতভের পেছন থেকে বলল এক লোক। গতি বাড়িয়ে সরে যাওয়া উচিত আপনার।

পাইলট হাউসের যন্ত্রপাতির মৃদু আলোয় ঘুরে তাকাল দিমিতভ। ওকেই দেখছে ভারী গড়নের মাঝবয়সী দিমিত্রি নিকোলভ। মানব কার্গো গোপনে পৌঁছে দিতে ওর সঙ্গে চুক্তি করেছে এই লোকই। এখন তীব্র ঠাণ্ডার মাঝেও নাকের ডগা ও ঠোঁটের ওপরের অংশে জমছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। দিমিতভের আন্দাজ ভুল না হলে, লোভ ও ভয়ের বিপজ্জনক সুতোয় ঝুলছে নিকোলভ লোকটা। একবার ভাবছে, দশ মিলিয়ন ডলার পেলে বাকি জীবনে আর থাকবে না অর্থকষ্ট। আবার ভাবছে, ধরা পড়লে স্রেফ খুন হয়ে যাবে রাশান কর্তৃপক্ষের হাতে।

আসলে এত দুশ্চিন্তা কেন, নিকোলভ?

আমরা বোধহয় পথ হারিয়ে ফেলেছি, তাই না? দ্বিধা ঝেড়ে বলল নিকোলভ। একবার দেখল সার্কিট বোর্ড। ওখানেই ন্যাভিগেশন সিস্টেম।

আট ঘণ্টা আগে নষ্ট হয়েছে জিপিএস রিসিভার। দপ করে আলো ছিটিয়ে নিভে গেছে স্ক্রিন। আগুন ধরেছে কেসিং এ। ঝরঝর করে মেঝেতে পড়েছে একরাশ লাল ফুলকি। যন্ত্রটা পরীক্ষা করে বুঝেছে দিমিতভ, আর মেরামত হবে না ওই জিনিস। পরবর্তী একঘণ্টা চলেছে নক্ষত্র দেখে। কিন্তু এরপর ঘন হয়ে উঠল কুয়াশা, দেখা গেল না আকাশ। তখন বাধ্য হয়ে ব্যবহার করেছে ট্রলারের কমপাস। 

নেভিতে যোগ দেয়ার আগে জেলে ছিলাম, ছোটবেলায় বাবার কাছে শিখেছি কীভাবে ন্যাভিগেট করতে হয়, আশ্বাসের সুরে বলল দিমিতভ। ভাল করেই জানি, কী করতে হবে।

একফুট এগিয়ে এসে প্রায় ফিসফিস করল দিমিত্রি নিকোলভ, নাবিকরা কিন্তু চিন্তিত। ওরা বলছে, এই যাত্রা অশুভ।

অশুভ?

নয় তো কী? পিছু নিয়েছে এক ঝাঁক কিলার ওয়েইল, বলল দিমিত্রি। প্রতি সকালে দেখছি হাঙর। সংখ্যায় বাড়ছে। ক্রমে। আগে কখনও এত হাঙর-তিমি দেখিনি এই সাগরে।

ব্যাপারটা সত্যি অস্বাভাবিক, ভাবল, দিমিতভ। যাত্রার শুরু থেকেই ছায়ার মত পিছু নিয়েছে সাগরের নাছোড়বান্দা শিকারি কিলার ওয়েইল ও হাঙরের দল। কিন্তু ট্রলার ডুবে না গেলে তাদের পেটে যাবে না ওরা। এই যে অনুসরণ করছে, সেটা বোধহয় স্রেফ কাকতালীয় কোনও ঘটনা।

প্রায় ভোর হয়ে এল, প্রসঙ্গ পাল্টাল দিমিতভ, বড়জোর দুএক ঘণ্টা আলো থাকবে, তবে তা-ই যথেষ্ট। একবার কুয়াশার চাদর সরে গেলেই গতি বাড়াতে পারব।

নিকোলভকে ভরসা দিতে না দিতেই গা রি-রি করা কর্কশ শব্দে গুতো মারল বড় কোনও হিমশিলা, স্টারবোর্ডে কাত হলো ট্রলার। পরিষ্কার বুঝল দিমিতভ, সাগরের এদিকে প্রচুর খুনে বরফ।

কমিয়ে গতি পাঁচ নট করল সে। আপ্রাণ চেষ্টা করেছে এ ফাঁদ এড়াতে। নিকোলভকে বলেছে: বেশি হিমশিলা মানেই কমবে গতি, এদিকে সামনের সাগরে জমাট বাঁধবে বরফ।

সিলিঙের বাতি জ্বালতেই সে-আলো প্রতিফলিত হলো ধূসর কুয়াশায়। ধাধিয়ে গেল দিমিতভের চোখ। চট করে চোখ বন্ধ করে বলল, মাস্তুলে কাউকে তুলব। আগেই জানতে চাই কোথায় আছে হিমশিলা।

কাউকে ডাকার আগেই সামনে থেকে এল আরেক জোর ধাক্কা। হোঁচট খেয়ে ওপরে উঠল বো, থেমে গেছে নৌযান যেন গুতো দিয়েছে তীরে।

ইঞ্জিন বন্ধ করো! গলা ছাড়ল দিমিতভ।

 নিচে বন্ধ হয়ে গেল ইঞ্জিন।

কয়েক সেকেণ্ড পর নড়ে উঠে একফুট পিছিয়ে সাগরে নামল বো। স্বস্তির শ্বাস ফেলল দিমিতভ, সাহস নেই যে আবারও ইঞ্জিন চালু করতে বলবে।

এখানে থামা যাবে না, বলল দিমিত্রি নিকোলভ।

নিচের ডেক থেকে উঠে পাইলট হাউসে উঁকি দিল এক নাবিক। পানি ঢুকছে, ক্যাপ্টেন। স্টারবোর্ড। সামনের দিকে।

কতটা খারাপ? জানতে চাইল দিমিতভ।

মনে হয় ফাটল বুজিয়ে দিতে পারব, বলল নাবিক, কিন্তু আবারও অমন হলে, তখন…

অন্যদেরকে ঘুম থেকে তোলো, বলল দিমিতভ। সবাই যেন পরে নেয় সার্ভাইভাল সুট। তারপর কাজে নামবে।

এ কথা বলেছে সতর্ক করতে। আরেকটা উদ্দেশ্য: ভয় কমিয়ে দেয়া। বাস্তবে শীতল এই সাগরে সার্ভাইভাল সুট পরেও কোনও লাভ হবে না কারও। আধঘণ্টাও টিকতে পারবে না কেউ।

নিকোলভের দিকে ফিরল সার্গেই দিমিতভ। তোমার চাবিটা দাও। 

কেন? আপত্তির সুরে বলল আদম ব্যাপারী।

ওকে সরিয়ে নেয়া উচিত, বলল দিমিতভ। জাহাজ ছেড়ে যেতে হলে তখন বাড়তি সময় পাব না।

দ্বিধা করল নিকোলভ, তারপর সোয়েটারের তলা থেকে বের করল সুতলি বাঁধা চাবি।

ওটা নিয়ে আদম ব্যাপারীকে ঠেলে সরিয়ে ডেকে বেরিয়ে এল দিমিতভ। চারপাশে ভাসছে থোকা-থোকা ধূসর কুয়াশা। চরম ঠাণ্ডায় মনে হলো, ধারালো কাঁচ দিয়ে চির-চির করে কাটা হচ্ছে ওর মুখ। এক চিলতে বাতাস নেই। আগেই বন্ধ করা হয়েছে ট্রলারের ইঞ্জিন। চারদিক কবরের মত নিস্তব্ধ।

পুরু হয়ে বরফে ছেয়ে গেছে ডেক। ব্রিজ, মই ও রেইল থেকে ঝুলছে ছোরার মত ধারালো সব হিমখণ্ড। প্রায় মুড়ে গেছে গোটা ট্রলার। যেন পরিত্যক্ত কোনও জাহাজ!

একটু পর পাইলট হাউস থেকে বেরোল দিমিত্রি। নিকোলভ, শীতবস্ত্রের ওপরে পরেছে সার্ভাইভাল সুট।

তাকে বোকা বলে মনে হলো দিমিতভের।

আরে, শালা, ট্রলার ডুবলে একঘণ্টাও টিকবি! তো এত কষ্ট করে এসব পরে হবেটা কী?

থামলে কেন? জানতে চাইল দিমিত্রি।

 যাতে ডুবে না যায় জাহাজ।

কিন্তু এখানে রয়ে গেলে শীতে জমে মরব!

থামা অনুচিত, জানে দিমিতভ। তবে আঁধারে চললে নিশ্চিতভাবেই ডুববে ট্রলার। কুয়াশা এতই ঘন, দেখা যাচ্ছে না কিছুই। অধৈর্য হলে বিপদ বাড়বে, ফলে মরতে হবে। এখন পর্যন্ত ভাগ্য সাহায্য করেছে ওদেরকে। আস্তে আস্তে হালকা হচ্ছে কুয়াশার পর্দা। দেখা দিয়েছে আবছা আলো। পৃথিবীর এত উত্তর দিকে আকাশে না উঠে দিগন্তে ঝুলবে সূর্য। চারপাশে ছড়াবে ধূসর আলো, তাতেই এগোতে পারবে ওরা।

কিন্তু আজ চেনা এই সাগরকে অচেনা লাগছে দিমিতভের। পুবাকাশ কালো কেন? উল্টো হওয়ার কথা! কুয়াশার বিচিত্র কোনও খেলায় বোধহয় অনুপস্থিত সূর্যের রশি!

কিন্তু তা হলে ভুল দিকে উঠছে কেন সূর্য?

দিমিতভ কিছু বলার আগেই মাঝারি আওয়াজ তুলে ট্রলারে পুঁতো দিল কিছু! একদিকে সামান্য কাত হলো নৌযান!

কী হলো? চমকে গিয়ে জিজ্ঞেস করল দিমিত্রি নিকোলভ।

স্রোতে ভেসে আসা বরফখণ্ডের ধাক্কা এমনই হবে। ট্রলারের রেলিং থেকে সাগরে চোখ রাখল দিমিতভ। একেবারে নিথর পানি। নড়ছে না কোনও হিমশিলা।

দিমিতভ! ভয় পেয়ে বিড়বিড় করল নিকোলভ।

তাকে পাত্তা না দিয়ে বো-র দিকে পা বাড়াল ক্যাপ্টেন। অনেকটা হালকা হয়েছে কুয়াশা। কিন্তু তার ফলে যে দৃশ্য দেখল, নিজ চোখকে বিশ্বাস করতে পারল না। সেই দিগন্ত তক শুধু জমাট বরফের সাদা মাঠ!

হায়, ঈশ্বর! ফিসফিস করল দিমিতভ।

বরফের কঠিন প্রান্তর ভেদ করে চলা অসম্ভব।

কিন্তু কী করে এমন হলো?

 সাগরের এদিকে এমন হওয়ার কথা নয়!

কয়েক সেকেণ্ড পর সত্যিই দিগন্তের কোলে মুখ তুলল সূর্য।

কিন্তু সরাসরি সামনে নেই ওটা। অবাক কাণ্ড, লালচে গোলক ঝুলছে ডানদিকে, তাদের পেছনে!

এমন কী নিকোলভও বুঝল, কী সর্বনাশ হয়েছে। কর্কশ কণ্ঠে বলে উঠল সে, তুমি সারারাত উত্তর দিকে চলেছ!

ভাবতে গিয়ে মাথা ঘুরে উঠল দিমিতভের। বারবার দিক ঠিক করে নিয়েছে ম্যাগনেটিক কমপাস দেখে। মেরুর এত কাছে ওই জিনিস মাঝে মাঝে উল্টোপাল্টা রিডিং দেয়। কিন্তু তাতে কী, সে তো অপেশাদার নাবিক নয়! সাগরে এত হিমশিলা দেখেই বোঝা উচিত ছিল, সামনেই মস্ত বিপদ!

বুঝলাম না, কী করে… শুরু করল দিমিতভ।

হাতের ঝাপটা মেরে তাকে থামিয়ে দিল দিমিত্রি নিকোলভ। আরে, গাধা, সবাইকে পৌঁছে দিয়েছ ভয়ঙ্কর নরকে!

এতই বিস্মিত, হাঁটুতে জোর পেল না দিমিতভ। মনটা চাইল ধপ করে বসতে। কিন্তু বিপদ বুঝে নিজেকে সামলে নিয়ে থামল স্টার্নে। পেছনে জমে যায়নি সাগর। কপাল ভাল হলে পিছিয়ে গিয়ে এখনও বাঁচতে পারবে।

প্রায় ঠেলে নিকোলভকে সরিয়ে পাইলট হাউসের দিকে ছুট দিল দিমিতভ। কিন্তু ওখানে যাওয়ার আগেই আবারও ধুম করে ধাক্কা দিল কিছু!

এবার অনেক জোরে!

কাত হয়ে কমপক্ষে দশ ডিগ্রি সরল ট্রলার!

চিৎকার করে ক্রুদের বলল দিমিতভ, রিভার্স! রিভার্স! পিছিয়ে যাও!

ডেকের তলায় গর্জন ছাড়ল ইঞ্জিন, পেছাতে লাগল যেযদা। কিন্তু ডান থেকে এল বো-তে গুতো। কাত হয়ে ভাসমান বরফখণ্ডের ওপর চেপে বসল ট্রলার।

হ্যাঁচকা টানে দরজা খুলে হুইলের সামনে থামল দিমিতভ। ঠেলে এক নাবিককে সরিয়ে খামচে ধরল থ্রটল। পিছাতে শুরু করে বাঁক নিল।

কী যেন ধাক্কা দিচ্ছে! আতঙ্কিত সুরে বলল নাবিক।

স্রোতে ভেসে এসে বরফের চাই লাগছে, বলল দিমিতভ। মনে মনে জানে, বলেছে ডাহা মিথ্যা।

ওই গুঁতো ইচ্ছাকৃত, আঘাত হানছে জেনে বুঝেই। কিলার ওয়েইল ও হাঙরের কথা মনে আছে দিমিতভের।

টলমল করতে করতে ব্রিজে ঢুকল নিকোলভ। ওটা সাবমেরিনও হতে পারে! এফএসবির কথা ভুললে চলবে না!

ওদের কার্গো ও গুরুত্বের কথা ভাবল দিমিতভ। পুরনো কেজিবি ভেঙে সৃষ্টি হয়েছে এফএসবি। কয়েক সপ্তাহ ধরে সাইবেরিয়াঁয় ধাওয়া করেছে তাদের এজেন্ট। নিশ্চয়ই এখনও খুঁজছে। অবশ্য তাই বলে সাবমেরিনে করে এসে তো দেবে ভাঙাচোরা ট্রলারে, এটা মেনে নেয়া কঠিন। হতে তো পারে বহু কিছুই, কিন্তু টর্পেডো মেরে বা পুঁতিয়ে ওদের মানব কার্গোসহ ট্রলার ডুবিয়ে দেয়ার কথা নয়।

বনবন করে হুইল ঘুরিয়ে ট্রলারের নাক সরাল দিমিতভ। পূর্ণ বেগ চাইল ইঞ্জিন থেকে। নব্বই ডিগ্রি বাঁক নিয়ে বাড়তে লাগল গতি। হিমশিলার মাঝ দিয়ে পথ করে নিচ্ছে ট্রলার।

দূরে দেখল দিমিতভ, কালো সাগরে বরফখণ্ড নেই। একবার ওখানে পৌঁছুতে পারলে লেজ তুলে পালাবে ওরা। ভাবল, ঈশ্বর! মাত্র পাঁচটা মিনিট পেলেই…।

একপাশ থেকে এল প্রচণ্ড গুঁতো। থরথর করে কাঁপতে শুরু করে ডানদিকে কাত হলো ট্রলার। উঠে এসেছে বো, কসেকেণ্ড পর ধড়াস্ করে নামল পানিতে। এ ধরনের হামলা হলে বেশিক্ষণ টিকবে না পুরনো, জং ধরা খোল।

পুরো থ্রটল খুলে দিল দিমিতভ। হিমখণ্ডে লেগে কর্কশ শব্দ তুলছে ধাতব খোল। যে-কোনও সময়ে খসে পড়বে প্রপেলার।

ক্যাপ্টেন, বাঁচতে হলে গতি কমাতে হবে, সতর্ক করল নাবিক।

আগে যাব অন্তত এক মাইল! ধমকের সুরে বলল দিমিতভ, তারপর কমিয়ে দেব গতি!

কথা শেষ হতে না হতেই ধাক্কা এল পোর্ট সাইডে। বাঁশ ফাটা আওয়াজে বেজে উঠল বেসুরো অ্যালার্ম। ট্রলারের ভেতর বন্যার পানির মত ঢুকছে সাগরের জল।

সবাইকে উঠে আসতে বলো! নির্দেশ দিল দিমিতভ।

পাল্টা চেঁচিয়ে কী যেন বলল নাবিক, কিন্তু অ্যালার্মের আর্তনাদে চাপা পড়ল তার কথা।

সাহায্য চেয়ে রেডিয়ো করো, বলল নিকোলভ।

কড়া চোখে ওকে দেখল ক্যাপ্টেন দিমিতভ। অনেক দেরি হয়ে গেছে।

ডেক থেকে চিৎকার করল কে যেন! আকুলা!

রাশান ভাষায় ওটার অর্থ: হাঙর!

জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল দিমিতভ। সাগরের কালো পানি চিরে আসছে আরও কালো কী যেন! লাগল ওঅটার লাইনের নিচে। প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়ে হুড়মুড় করে মেঝেতে পড়ল ক্যাপ্টেন।

পরক্ষণে এল আরেক ধাক্কা। আরও জোরে। ভারী কিছু গুতো দিয়েছে ট্রলারের খোলে। বার কয়েক আওয়াজ হলো ধু-ধুম!

যেন বন্ধ ধাতব দরজায় প্রাণপণে কিল বসাচ্ছে কেউ। জীবন্ত টর্পেডোর মত খোলের ওপর হামলে পড়ছে একের পর এক হাঙর। আহত হতেও দ্বিধা নেই।

এসব কী হচ্ছে, দিমিতভ! কাঁপা গলায় বলল নিকোলভ।

কিছুই স্পষ্ট নয় দিমিতভের কাছে। আগে কখনও দেখেনি এমন অবাক কাণ্ড!

কী কারণে যেন খেপে গেছে কিলার ওয়েইল আর হাঙররা!

স্টারবোর্ডের দিকে চেয়ে চমকে গেল দিমিতভ, যে কোনও সময়ে কাছের হিমখণ্ডের গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়বে ওরা!

সাবধান! শক্ত করে কিছু ধরো!

হিমখণ্ডের উঁচু একাংশে লেগে টলতে টলতে পিছিয়ে এল যেযদা। একবার দুলছে এদিকে, আবার ওদিকে। যখন-তখন কাত হয়ে তলিয়ে যাবে ট্রলার। ডেকে উঠে আসছে আস্ত সাগর!

লাইফবোট নামাও! আদেশ দিল দিমিতভ, জলদি!

বসে নেই নাবিকরা, পৌঁছে গেছে স্টার্নে। পাঁচজন মিলে সাগরে নামাল লাইফবোট। দিমিতভ বুঝল, রয়ে গেছে পাইলট হাউসের নাবিক, দিমিত্রি নিকোলভ, নিচে রাখা ওই মানব কার্গো আর নিজে সে। লাইফবোটে ওঠো! দেরি কোরো না!

নৌকায় নাবিকরা নামতেই নিচের ডেক লক্ষ্য করে ছুটল দিমিতভ। হ্যাঁচ খুলে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল। লোহার মেঝেতে ঘূর্ণি তৈরি করছে হাটু সমান পানি। এতই ঠাণ্ডা, অবশ হয়ে যেতে চাইল দুই পা। পানি ছিটিয়ে সবচেয়ে কাছের কেবিনের সামনে থামল সে। পকেট থেকে চাবি নিয়ে খুলে ফেলল তালা। জোরে ঠেলতেই আপত্তির শব্দ তুলে খুলে গেল দরজা। মেঝের ওপর ছল-ছলাৎ আওয়াজ করছে। সাগরের জল।

ধ্যানরত বুদ্ধের মত পা ভাঁজ করে সরু বাঙ্কে বসে আছে পাঁচ বছরের ছোট্ট এক ছেলে। চাঁদের মত গোল মুখ। মাথা ভরা কালো চুল। বোঝার উপায় নেই, সে ইউরোপিয়ান না এশিয়ান।

পাবলো! ডাক দিল দিমিতভ, এসো!

জবাব না দিয়ে সামনে-পিছে দুলে গুনগুন করে কী বলছে পিচ্চি ছেলেটা।

যে-কোনও সময়ে তলিয়ে যাবে ট্রলার। সামনে বেড়ে বাঙ্ক থেকে বাচ্চাটাকে কাঁধে তুলে নিল দিমিতভ। বেরোবে কেবিন ছেড়ে, কিন্তু তখনই আবারও কাঁপতে কাঁপতে একপাশে কাত হলো জাহাজ।

ধাতব শব্দে গুঙিয়ে উঠছে টইটম্বুর যেযদা। একপাশের দেয়াল ধরে তাল সামলে নিল দিমিতভ। বিশ ডিগ্রি কাত হলো কেবিন। তবে ভারসাম্য ফিরতেই উরু-সমান পানি ঠেলে করিডোরে বেরিয়ে এল সে।

গলা পেঁচিয়ে ধরে ঝুলছে পাবলো।

হুড়মুড় করে ট্রলারের খোলে ঢুকছে সাগরের জল। ওই স্রোত ঠেলে সিঁড়ির দিকে চলল ক্যাপ্টেন দিমিতভ। পণ করেছে, মরতে হলে মরবে, কিন্তু শেষ চেষ্টা করবে বাচ্চাটাকে বাঁচাতে। সিঁড়ি বেয়ে পৌঁছে গেল হ্যাঁচ কাভারের কাছে। লোহার ডালা খুলতেই ত্রিশ ডিগ্রি কাত হলো যেযদা, ডুবে যাবে যে-কোনও সময়ে!

পেছনের ডেক দেখল দিমিতভ। স্টার্ন থেকে তিরিশ গজ দূরে লাইফবোট। কিন্তু স্বস্তিতে নেই নাবিকরা। মনে হলো খুব ভীত সন্ত্রস্ত। বারবার আঙুল তুলে দেখাচ্ছে কী যেন, সাগরের পানিতে।

কয়েক সেকেণ্ড পর তাদের বোটের নিচে হাজির হলো কালো-সাদা প্রকাণ্ড এক অবয়ব। ওপরে উঠল ত্রিকোণ ডরসাল ফিন। পরক্ষণে দুটুকরো হলো লাইফবোট। বোটের এদিকে-ওদিকে ছিটকে পড়ল নাবিকরা। তাদের ওপর হামলা করল কালো লেজের কয়েকটা দানব। অসহায় মানুষের করুণ আর্তচিৎকার চিরে দিল নীরব পরিবেশ।

হতবাক দিমিতভ দেখল, কিলার ওয়েইলের পাল খুন করছে যেযদার নাবিকদেরকে!

আরও কাত হলো যেযদা। খোলা সব কেবিনেট থেকে সাগরে ভেসে গেল হালকা মালপত্র। হ্যাঁচ থেকে সরে গেল দিমিতভ। যে-কোনও সময়ে গড়ান দেবে ট্রলার। ওটার ভেতরের পানি ভেদ করে উঠে এল একরাশ বুদ্বুদ।

বাচ্চাকে কাঁধে রেখে রেলিং টপকে ঝাঁপ দিল দিমিতভ। পা পড়তেই পিছলে গেল জমাট বরফে। হাত থেকে ছুটে গেছে ছেলেটা। মুখ থুবড়ে পড়ে সরে যাচ্ছে দূরে।

প্রচণ্ড ও ভারী আওয়াজ শুনে ঘুরে তাকাল দিমিতভ। সাগর তলদেশ লক্ষ্য করে রওনা হয়েছে তার ট্রলার। যেযদার বুকভরা দীর্ঘশ্বাস মস্ত সব বুদ্বুদ হয়ে বিস্ফোরিত হলো সাগর সমতলে।

মাত্র কয়েক মুহূর্ত পর থমথম করতে লাগল চারপাশ।

টলমল করছে সাগরের কালো জল।

ভাসছে ভাঙাচোরা মালপত্র।

যেযদা ট্রলার যেখানে ছিল, ওখানে এখন ছোট বরফখণ্ড।

দক্ষিণে চোখ বোলাল দিমিতভ। ডুবে গেছে লাইফবোট। খুন হয়েছে নাবিকরা। ভেসে আছে ঘেঁড়া দুটো লাইফ জ্যাকেট। খাওয়ার মত কিছু পাবে ভেবে ওখানে এখনও ঘুরঘুর করছে দুটো হাঙর। নির্জন সাগরের বুকে হিমশিলায় রয়ে গেছে শুধু বাচ্চা ছেলেটা আর সে নিজে!

কপাল ভাল, সমতল জায়গায় পড়েছে, নইলে পিছলে গিয়ে বেঘোরে ডুবে মরত সাগরে। তিনফুট পুরু সিমেন্টের কঠিন চাপড়ার মতই এই হিমখণ্ড।

ঘুরে পাবলোর দিকে তাকাল দিমিতভ। কার্গো আসলে ওই বাচ্চা ছেলে। এক লোকের হাতে পৌঁছে দিলে মিলত দশ মিলিয়ন ডলার। কাজটা নিয়েছিল বলেই খুন হয়েছে যেযদার নাবিকরা। নেই ওর সাধের যেযদাও।

ছেলেটাকে কেন এত দরকার ওই লোকের?

জানা নেই দিমিতভের। এখন আর ভেবেই বা কী হবে?

ভীষণ কনকনে ঠাণ্ডায় জমে যেতে চাইছে শরীর। উঠে দাঁড়াল দিমিতভ। দূরে দিগন্তজোড়া সফেদ মাঠ! প্রতিফলিত উজ্জ্বল আলোয় ধাধিয়ে গেল চোখ।

লবণাক্ত সাগরে শত মাইল জুড়ে বরফ-প্রান্তরে আর কিছুই নেই! বলা হয় এটা মহাদেশ। কিন্তু এখানে, এই মহাদেশে এই মুহূর্তে আছে মাত্র দুজন মানুষ!

আরেকবার সূর্যোদয়ের আগেই হয়তো মারা পড়বে ওরা!

.

০২.

দুই চার হাত-পায়ে হাঁচড়েপাঁচড়ে মাউন্ট পুলিমাণ্ডোর চূড়ায় উঠছে মিতা দত্ত, মনে ভীষণ ভয়। পাহাড়ে প্রায় দৌড়ে উঠে হাঁফ লেগে গেছে। পরিশ্রমের কারণে পাথরের মত শক্ত হয়ে গেছে কাফ মাসল, আগুনের মত পুড়ছে ফুসফুস। কিন্তু গতি কমিয়ে দেবে, সে উপায় নেই!

দেখার মত সুন্দরী, সুশিক্ষিত, ছিপছিপে মেয়ে মিতা। সৌন্দর্য তার গায়ের রঙে নয়, চেহারায়। বয়স মাত্র পঁচিশ বছর। যে-কেউ ঘুরে তাকায় দ্বিতীয়বার। ওর মা আমেরিকান, তাঁর কাছ থেকেই পেয়েছে বেদানার দানার মত ত্বকের রঙ। অবশ্য কাজলকালো বাঙালী দুচোখ পেয়েছে বাবার কাছ থেকে। উনি ছিলেন বাঙালি ফিযিসিস্ট।

চট করে পেছনে তাকাল মিতা। পিছু পিছু আসছে বাদামি রঙা এক মেক্সিকান তরুণ। তার ত্রিশ ফুট নিচে কুচকুচে কালো, বিখ্যাত আর্কিওলজিস্ট প্রফেসর জর্জ হ্যারিসন। পাহাড় বেয়ে উঠতে গিয়ে স্টিম ইঞ্জিনের মত তাঁর নাক-মুখ দিয়ে বেরোচ্ছে ফোঁসফোঁস আওয়াজ।

আরও জলদি, স্যর। ভাবুন, কেউ আগুন দিয়েছে আপনার লেজে! তাড়া দিল মিতা।

আমার লেজ পেলে কই? ভুরু কুঁচকে গতি বাড়ালেন হ্যারিসন।

ওরা কিন্তু খুব কাছে চলে এসেছে!

করুণ চোখে মিতাকে দেখলেন ডক্টর হ্যারিসন। ভাবছেন, বয়সটা পঁয়ষট্টি হোক, হাড়ে হাড়ে টের পাবে তখন!

তরুণ গাইডের দিকে তাকাল মিতা। তার বয়স মাত্র বিশ। নাম পিকো। চিয়াপাস ইণ্ডিয়ান। আর কতটা দূরে?

আগে উঠতে হবে চূড়ায়, ইণ্ডিয়ান সুরে ইংরেজি বলল পিকো। ওপাশেই সেই মন্দির।

পরের দুমিনিটে মাউন্ট পুলিমাণ্ডোর চূড়ায় উঠল ওরা।

হাঁটুতে দুহাত রেখে কুঁজো হলেন প্রফেসর হ্যারিসন। এবার একটু বিশ্রাম না নিলেই নয়।

থমকে গিয়ে ব্যাগ থেকে বিনকিউলার নিয়ে চোখে তুলল মিতা। ওরা আছে প্রায়-সুপ্ত এক আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের কিনারায়। একহাজার ফুট নিচে পাহাড়ি লেক। সুনীল জলের মাঝে বর্শার ফলা আকৃতির দ্বীপ। মাঝের অংশ উঁচু, ঘন হয়ে জন্মেছে গাছপালা। মিতা পরিষ্কার বুঝল, ওই দ্বীপের জন্ম আগ্নেয়গিরির কল্যাণে। পাথুরে জমির ফাটল দিয়ে বেরোচ্ছে গন্ধকের ভারী, হলদে ধোঁয়া, প্রায় ঘিরে রেখেছে দ্বীপের চারপাশ।

ওই দ্বীপই তো? পিকোর দিকে তাকাল মিতা।

মাথা দোলাল ইণ্ডিয়ান তরুণ। আইলা কিউবিয়ার্তা।

লুক্কায়িত দ্বীপ বা গোপন দ্বীপ, মন্তব্য করলেন প্রফেসর হ্যারিসন।

মনোযোগ দিয়ে দ্বীপটাকে দেখছে মিতা।

বোধহয় ঠিক জায়গাতেই এনেছে পিকো। এখানে থাকার কথা ওই বিশেষ মায়ান সাইট। হাজারো বছর ধরে বলা হয়েছে: ওটা রহস্যময় এক আয়না। দ্বীপে ছিলেন মায়াদের আগুন-দেবতা তোহিল। কপালে অবসিডিয়ান আয়না। ওটাই বুঝিয়ে দিত, কত ক্ষমতাশালী দেবতা তিনি।

এবারের এই অভিযানে এসেছে ওরা ওই আয়না বা স্ফটিক খুঁজতে। ওকে বলা হয়েছে: আমেরিকান সরকারের শক্তিশালী সংগঠন এনআরআই থেকেই দেয়া হয়েছে সব খরচা। যা চাইছে তারা, ওটা পেলে উপকৃত হবে গোটা পৃথিবীর প্রতিটি দেশ।

তুমি ঠিক জানো তো, ওই দ্বীপই? আবারও জানতে চাইল মিতা।

সত্যিই মূর্তি আছে, জোর দিয়ে বলল পিকো। কয়েক বছর আগে আমাদের গ্রামের ওঝার সঙ্গে এসে দেখে গেছি। উনি বলেছিলেন, মায়া-দেবতার জন্যে একদম পাল্টে যাবে পৃথিবী।

ধোঁয়াটে দ্বীপ থেকে চোখ সরিয়ে জ্বালামুখের ভেতর দিকে তাকাল মিতা। বেশ খাড়াভাবে নেমেছে ঢালু জমি। আছে অসংখ্য ফস্কা ও পিচ্ছিল পাথর। সতর্ক না হলে সোজা গিয়ে পড়বে একহাজার ফুট নিচের নরকে। জ্বালামুখ বেয়ে নেমে যাওয়ার কাজটা পাহাড়ে ওঠার চেয়েও ঢের কঠিন।  

বিনকিউলার ব্যাগে রেখে কুচকুচে কালো চুল পনি টেইল করল মিতা। ঘর্মাক্ত ঘাড়ে শীতল হাওয়া পেয়ে খুশি। প্রফেসর হ্যারিসনের দিকে তাকাল। বসে পড়েছেন তিনি। এখনও বারবার ফুলে উঠছে বুক। লিনেনের খোলা শার্টের নিচে ভিজে চুপচুপ করছে টি-শার্ট। দরদর করে গাল বেয়ে নামছে ঘাম। কালো মুখে সরু কয়েকটা লোনা ঝর্না। পঁয়ষট্টি বছর বয়সের তুলনায় যথেষ্ট শক্তপোক্ত ডক্টর হ্যারিসন।

গত তিন দিন ধরে তাড়া খেয়ে পাগলের দশা হয়েছে ওদের। পালাবার সময় সঙ্গে নিতে পেরেছে মাত্র তিনটে ব্যাকপ্যাক। তাতে সামান্য রসদ ও খাবার।

প্রফেসর, আপনি রেডি তো? জানতে চাইল মিতা। ভারছে, গতবারের মত মায়াবী চোখের ওই বাঙালী যুবক পাশে থাকলে আজ আর এত দুশ্চিন্তা করতে হতো না। কিন্তু মাসুদ রানার সঙ্গে যোগাযোগই করা গেল না।

মুখ তুলে মিতাকে দেখলেন প্রফেসর। মোটেও প্রস্তুত নন।

এবার সাবধানে নেমে গেলেই হবে, আশ্বস্ত করল মিতা।

ছোটবেলায় ভাবতাম বড় হলেই সব সমস্যা শেষ, এখন বুড়ো হয়ে মনে হচ্ছে, তাড়া খেয়ে পালাচ্ছি সারাজীবন ধরে! দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাত নাড়লেন হ্যারিসন। রওনা হও, ডক্টর মিতা, দেখি পিছু নিতে পারি কি না।

মাত্র চব্বিশ বছর বয়সেই নিউ ইয়র্কের নামকরা এক ইউনিভার্সিটি থেকে পদার্থ বিজ্ঞানে ডক্টরেট করেছে মিতা। গত বছর অদ্ভুত এক ইলেকট্রোম্যাগনেটিক পাথর খুঁজতে গিয়ে ডক্টর হ্যারিসনের সঙ্গে ছুঁড়ে বেরিয়েছে আমাযনের জঙ্গল। পেয়েছে মাত্র একটি স্ফটিক, ওটা এখন আছে এনআরআই হেডকোয়ার্টার-এ। ওটা থেকে বেরোচ্ছে বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ। এ ব্যাপারে গবেষণা করছে মিতা, ঘন ঘন যাতায়াত করছে এনআরআই ল্যাবে।

আর্কিওলজিকাল সাইটের শিলালিপি থেকে জেনেছেন ডক্টর হ্যারিসন, আরও আছে অমন পাথর বা স্ফটিক। এনআরআইকে তা জানাবার পর সমস্ত খরচ ও নিরাপত্তা দিতে চাইলেন এনআরআই চিফ।

কিন্তু মানা করে দিলেন তিনি। তার সোজা কথা: একদল মার্সেনারি বা গার্ড নিয়ে ঘুরলে সবার চোখ পড়বে তাঁর ওপর। তাই চান পরিচিত মানুষ, যে বা যারা নিরাপত্তাও দেবে, আবার এনার্জি বিচ্ছুরণের ব্যাপারেও সাহায্য করবে তাকে।

এ পর্যায়ে প্রফেসরের কথায় মিতার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন এনআরআই চিফ জেম্স্ ব্রায়ান। আলাপের শুরুতেই বললেন, খুব অনুরোধ করেছেন প্রফেসর হ্যারিসন, যাতে ওই স্ফটিকের ব্যাপারে সাহায্য করার জন্যে তুমি যাও তাঁর সঙ্গে। কিন্তু আমি চাই না মেক্সিকোতে পা রাখো। নিরাপত্তার জন্যে মাসুদ রানাকেও পাশে চান ডক্টর। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নিজ দেশের রাষ্ট্রীয় কোনও জরুরি কাজে ব্যস্ত ওই যুবক।

যখন-তখন ভয়ানক সব বিপদের সম্ভাবনা, তবুও ইলেকট্রোম্যাগনেটিক স্ফটিক পেতে মুখিয়ে ছিল মিতা। এনআরআই চিফকে জোর দিয়ে বলল, ও প্রফেসরের সঙ্গে যেতে আগ্রহী।

মাসুদ রানাকে পাশে না পেয়ে একটু হতাশ হলেও হ্যারিসন ভেবেছেন, ওই যুবকের কাছ থেকেই বিপদ এড়াবার কঠিন ট্রেনিং নিয়েছে মিতা। তারপর নামী-দামি কারাতে জুডো প্রশিক্ষণ কেন্দ্রেও ক্লাস করেছে কিছুদিন। কাজেই মন্দ করবে না মেয়েটা।

সত্যিই গত কয়েক দিনে নিজ যোগ্যতা প্রমাণ করেছে মিতা, নইলে অনেক আগেই খুন হতেন তাঁরা।

মরে গেলেও আপনাকে বিপদে ফেলে যাব না, বলেছে মিতা, তা ছাড়া, স্যর, আর্কিওলজির ব্যাপারে আপনি এক্সপার্ট, আমি তো নই। বড়জোর দেখব ফিযিক্সের কিছু বিষয়।

কিন্তু ওরা যদি আমাদেরকে ধরে ফেলে, তখন?

ওদের চাই ওই মূর্তি। ধাওয়া করে আমাদেরকে ধরতে যাবে না। হাত বাড়িয়ে দিল মিতা।

চোখে সন্দেহ নিয়ে ওকে দেখলেন প্রফেসর, তারপর পেলব হাতটা ধরে উঠে দাঁড়ালেন। কিনারা থেকে সাবধানে নামতে লাগল ওরা। বারবার পিছলে যেতে চাইছে পা। কোনও কোনও জায়গায় নামছে হালকা দৌড়ের ভঙ্গিতে। বেশিক্ষণ লাগল না একহাজার ফুট নেমে আসতে। ওপরে শুনল চিৎকার। চূড়ায় উঠে পড়েছে শত্রুপক্ষের কয়েকজন!

জলদি চলুন, প্রফেসর, শেষ তিরিশ ফুট প্রায় দৌড়ে নামল মিতা। শক্ত জমি পেয়ে ছুটে গিয়ে থামল লেকের পারে। পরক্ষণে ঝাঁপিয়ে পড়ল পাহাড়ি, শীতল লেক-এ।

ওরা দ্বীপে যাওয়ার অর্ধেক পথ পাড়ি দিয়েছে, এমনসময় চূড়ার কাছ থেকে গর্জে উঠল আগ্নেয়াস্ত্র। ওদের চারপাশের পানিতে গাঁথল বুলেট। পিছলে গেল কয়েকটা। প্রাণের ভয়ে ডুব দিয়ে এগোল ওরা। কিন্তু একটু পর ভেসে উঠতে হলো দম নেয়ার জন্যে।

কটুগন্ধী গন্ধকের ধোঁয়ার মাঝে সবার আগে উঠেছে দক্ষ সাতারু মিতা। নাক কুঁচকে ফেলল। কয়েক সেকেণ্ড পর ওর পাশে পৌঁছুল পিকো ও কৃষ্ণকায় প্রফেসর।

এদিকে থেমে গেছে গুলি। শোনা গেল আরেকটা আওয়াজ। অন্য দুজন বোধহয় শুনতে পায়নি, কিন্তু বিপদ বুঝে গলা শুকিয়ে গেল মিতার।

তীব্রগতি পাখার চাপা ধুব-ধুব আওয়াজ!

 পুবের পাহাড়ের ওপর দিয়ে আসছে হেলিকপ্টার!

শত্রুদের পুঁজির ভেতর ছিল নতুন ওই কৌশল!

ওই মূর্তিটা কোথায়! জানতে চাইল মিতা।

আঙুল তুলে দ্বীপের পাহাড়ি অংশ দেখাল পিকো। চূড়ার ওদিকে। গাছপালার ভেতর। এদিক থেকে দেখা যায় না।

কয়েক সেকেণ্ড পর তীরে পৌঁছুল ওরা। ছোটবড় গাছের ডাল ও ঝোপঝাড় ধরে উঠছে পাহাড়ি জমিতে। চূড়ায় উঠে দেখল বৃত্তাকার, সমতল এক অংশের মাঝে সত্যিই রয়েছে ওই মূর্তি। তবে মূর্তি বলা যায় কি না, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। ওটা বিশাল এক চৌকো আকৃতির কালো পাথর। একদিকে খোদাই করা মায়ান কোনও রাজা। মাথায় বিচিত্র মুকুট। বুক-কোমরে নক্সা করা পোশাক। ডানহাতে জালের মত কিছু। ওখানে গোল চারটে পাথর। বামহাতে বিশাল ফুটবলের মত কী যেন। সেখানে লেখা হায়ারোগ্লিস্। নিচে মুচড়ে আছে বিশাল এক সাপ। এক গ্রাসে রাজাকে গপ করে খেয়ে নেবে বলে মস্ত হাঁ মেলেছে।

শিলালিপির শিরোনামের থ্রি পড়লেন প্রফেসর হ্যারিসন: আহাউ বালাম মায়া জাগুয়ার রাজা। তিনিই ছিলেন ভ্রাতৃসঙ্রে আত্মার পথনির্দেশক।

পিকোর পূর্বপুরুষ মায়াজাতির মানুষ, ভয় ও শ্রদ্ধা নিয়ে প্রাচীন রাজার মূর্তি দেখছে সে। একেবারে বিমোহিত হয়ে গেছেন পাড় আর্কিওলজিস্ট প্রফেসর হ্যারিসন। তবে এসব কিছুই স্পর্শ করল না মিতার মন। কীভাবে সামনের সমূহ বিপদ উৎরে উঠবে, তা নিয়ে চিন্তিত। আওয়াজ শুনে বুঝে গেছে, বড়জোর তিন মিনিট, তারপর হাজির হবে ওই হেলিকপ্টার। এদিকে জ্বালামুখ বেয়ে নামতেও বেশিক্ষণ লাগবে না শত্রুপক্ষের অন্যদের।

যা খুঁজছিলেন, সে-তথ্য পেলেন, প্রফেসর? জানতে চাইল মিতা।

পাথরে খোদাই করা লেখা মন দিয়ে পড়ছেন হ্যারিসন। স্পর্শ করে দেখলেন একটা গ্লিফ। তারপর দ্বিতীয়টা। মনে হলো পড়েছেন দ্বিধার মাঝে।

প্রফেসর?

ঠিক বুঝছি না, মাথা নাড়লেন হ্যারিসন।

কাছে পৌঁছে গেছে হেলিকপ্টার। ইঞ্জিনের গর্জন বাড়ল। একটু পর কানফাটা শব্দে হাজির হবে মাথার ওপরের আকাশে।

বড়জোর দুমিনিট পাবেন, প্রফেসর, বলল মিতা, আগেও পৌঁছে যেতে পারে।

অবিশ্বাস নিয়ে মাথা নাড়লেন হ্যারিসন। এখানে তো কোনও গল্পই নেই! কোনও ব্যাখ্যাও দেয়নি। হাজারখানেক সংখ্যা দিয়ে কী বুঝব?

কোনও তারিখ-টারিখ?

না, খালি অজস্র সংখ্যা!

প্রফেসরের কথা শুনে অবাক হয়েছে মিতা। মোটেও এমনটা হওয়ার কথা নয়!

আসলে হয়েছে কী, এখন যদি… শুরু করছিলেন প্রফেসর।

কিন্তু তাঁকে থামিয়ে দিল মিতা: এখন গবেষণার সময় নয়, স্যর। ব্যাগ থেকে ক্যামেরা নিয়ে স্ক্রিনের দৃশ্য দেখল ও। ছবি তুলল কয়েকটা। হাজার হাজার বছরের প্রাকৃতিক অত্যাচারে ক্ষয়ে যাওয়া পাথর। ঝাপসা হয়ে প্রায় মুছে গেছে বহু অক্ষর। আরেক অ্যাঙ্গেল থেকে ছবি নিল মিতা। বিশেষ সুবিধা হলো না। পাওয়া গেল না ছবির যথেষ্ট ডেফিনেশন।

কাছে পৌঁছে গেছে হেলিকপ্টার। তবে ওটার ইঞ্জিনের বিকট আওয়াজের ওপর দিয়েও শোনা গেল হৈ-চৈ। জ্বালামুখ বেয়ে নেমে আসছে তারা।

অস্পষ্ট সব ছবি, মন্তব্য করল মিতা।

ড্যাবড্যাব করে কসেকেণ্ড ওকে দেখলেন প্রফেসর, তারপর চট করে খুলে ফেললেন লিনেনের শার্ট। মূর্তির সামনে বসে মায়ান হায়ারোগ্লিসের ওপর ডানহাতে রাখলেন ভেজা শার্ট। বামহাতে পাথুরে মেঝে থেকে নিলেন মুঠোভরা আগ্নেয়, ঝুরঝুরে মাটি। শার্টের পিঠে চেপে ধরছেন।

তার কাজে সাহায্য করল পিকো।

বিকট আওয়াজে মাথার ওপর দিয়ে গেল হেলিকপ্টার। একটু দূরে থেমে ঘুরে গিয়ে খুঁজতে লাগল নামার জায়গা।

ওদিকে চেয়ে স্রষ্টাকে ধন্যবাদ দিল মিতা।

ছোট্ট এই দ্বীপে অবতরণের সুযোগ নেই।

সাহায্য করতে প্রফেসরের পাশে বসল মিতা। ভেজা শার্টের পিঠে ফুটিয়ে তুলছে চারকোল ড্রয়িঙের মতই ঝাপসা মায়ান অক্ষরের ছাপ। আপাতত এরচেয়ে বেশি কিছু করার নেই।

নিজেদের কাজে ব্যস্ত ওরা। কিন্তু মাথার ওপর ধীরে ধীরে ঘুরছে যান্ত্রিক ঘাসফড়িং। বিশালাকার ঘুরন্ত পাখার হাওয়ায় তৈরি হয়েছে তুমুল ঝড় নানা দিকে উড়ছে শুকনো পাতা, ভাঙা ডালপালা, পাইনের কাটা, শুকনো ফল, তুষ, বালি ও মাটি।

ব্যস, হাতে আর সময় নেই, গলা ফাটিয়ে জানাল মিতা।

শিলালিপি থেকে শার্ট গুটিয়ে নিয়ে ব্যাকপ্যাকে রাখলেন প্রফেসর। এদিকে দশইঞ্চি হঁটের সমান এক পাথর নিয়েছে মিতা, বারবার ওটা নামল মূর্তির গোলকের অক্ষরের ওপর। ছুরি-কাঁচি ধার করার মেশিনের মত কাজ করছে চোখা পাথর। কমলা ফুলকি তুলে ছিটকে পড়ছে অমূল্য আর্টিফ্যাক্টের টুকরো!

কিন্তু হঠাৎ করেই ডালপালার মাঝ দিয়ে সাপের মত কিলবিল করে নামল ভারী ওজন নেয়া কয়েকটি দড়ি।

এবার পালাতে হবে! চেঁচিয়ে উঠল মিতা।

 উঠে দাঁড়িয়ে ঝেড়ে দৌড় দিল পিকো ও হ্যারিসন।

কপ্টারের দড়ি থেকে ঝুলছে নীল পোশাক পরা কয়েকজন, হাতে আগ্নেয়াস্ত্র। সরসর করে নেমে আসছে, গাছের মাঝ দিয়ে।

ঘুরেই ব্যাগ থেকে নাইন এমএম গ্লক পিস্তল নিল মিতা। কিন্তু গুলি শুরু করার আগেই ওর শার্ট ভেদ করে ত্বকে গাঁথল ধাতব দুটো দাঁড়া। ব্যথা এতই তীব্র, ভীষণ চমকে হুমড়ি খেয়ে মাটিতে পড়ল মিতা। তাতেই থামল না যন্ত্রণা। দমকা হাওয়ায় পড়া বাঁশ পাতার মত ওকে থরথর করে কাঁপিয়ে দিল টেইযারের হাইভোল্ট বিদ্যুৎ।

কাত হয়ে পড়ে আছে মিতা। ঝাপসা চোখে দেখল, চূড়ার ওপাশ দিয়ে দুদ্দাড় করে নেমে যাচ্ছে পিকো, পেছনে প্রৌঢ় হ্যারিসন। প্রফেসরকে গেঁথে নিতে পেছনে যাচ্ছে। টেইরের দাঁড়া। দৌড়ের ওপরেই বেসবলের পাকা খেলোয়াড়ের মত ডজ মেরে সরে গেলেন তিনি। কিন্তু তাতে রক্ষা নেই, ওপর থেকে এল সাবমেশিন গানের গুলি। হঠাৎ হোঁচট খেয়ে সামনে বাড়লেন প্রফেসর। ছিটকে উঠেছে রক্ত। প্রায় খাড়া ঢাল বেয়ে গড়িয়ে অনেকটা নিচে গিয়ে পড়লেন তিনি।

আবারও বৈদ্যুতিক শক খেল মিতা। প্রচণ্ড ব্যথায় আরও ঝাপসা হলো দৃষ্টি। তারই মাঝে টের পেল, ওকে ঘিরে ফেলেছে কজন সশস্ত্র লোক। হাতদুটো পিছনে নিয়ে আটকে দেয়া হলো হ্যাণ্ডকাফে। হেলিকপ্টারের পাখার হাওয়ায় চারপাশে শুরু হয়েছে প্রচণ্ড ঝঞ্ঝা। সেই সঙ্গে বিকট আওয়াজ।

আকাশের দিকে তাকাল অসহায় মিতা। ঘন জঙ্গলের ওপরে ভাসছে কালচে দানবীয় উড়োজাহাজ- সিকোরস্কি স্কাইক্রেন। দেখতে অনেকটা বাঘের থাবার মত। পেটের ভেতর রাখতে পারে অত্যন্ত ভারী মালপত্র। কেবল দিয়ে বেঁধে নিলে ছোট ট্যাঙ্ক বহন করাও কঠিন নয় ওটার জন্য। মায়ান রাজার মূর্তি নিয়ে যেতেই আনা হয়েছে ওটাকে!

প্রকাণ্ড কপ্টার থেকে মোটা চেইন ফেলতেই, মাত্র কয়েক সেকেণ্ডে বেঁধে নেয়া হলো ওজনদার মায়ান পাথর। টানটান হলো শেকল। হ্যাঁচকা টান খেয়ে আকাশে উঠল রাজার মূর্তি।

মিতার পাশে এক লোক কোমর থেকে রেডিয়ো নিয়ে বলল, একটাকে ধরেছি! চূড়ার কিনারার দিকে তাকাল সে। পিকো ও হ্যারিসন ওদিকে কোথাও নেই। পালিয়ে গেছে ওই স্থানীয় ছোকরা। কিন্তু বুড়ো হাবড়াটা মরে ভূত!

মন খারাপ হয়ে গেল মিতার। এত চেষ্টা করেও বাঁচাতে পারল না মানুষটাকে!

ধোঁয়া থেকে মেয়েটাকে বের করো, বলল আরেক লোক। ওরা হেলিকপ্টার থেকে বাস্কেট নামাবে।

টান দিয়ে দাঁড় করানো হলো মিতাকে, পরক্ষণে দুজন লোক টেনে হিঁচড়ে নিয়ে চলল ওকে।

চূড়ার যেদিক থেকে পড়েছেন প্রফেসর হ্যারিসন, সেদিকে চোখ গেল মিতার। তিরিশ ফুট নিচে মোটা এক গাছের কাণ্ডে লেগে কাত হয়ে থেমেছেন প্রফেসর। অত্যন্ত বেকায়দা ভঙ্গি। লাশের ডান চোখ খোলা, নেই প্রাণের একবিন্দু ছোঁয়া। টকটকে লাল রক্তে ভিজে গেছে টি-শার্ট।

মিতার মন চাইল, হাঁটু ভেঙে বসে বুক চাপড়ে কাঁদবে।

সত্যি, খুব অনুচিত হয়েছে নিরীহ মানুষটাকে এ দেশে আনা। অন্তত বাধা তো দিতে পারত! প্রফেসর খুব ভরসা করেছিলেন ওর ওপর। তার ধারণা ছিল, মাসুদ রানার কাছ থেকে সবই শিখে নিয়েছে ও। এখন নিজেই বুঝতে পারছে, বাস্তবে শিখতে পারেনি কিছুই!

পেছন থেকে ঠেলা দিতেই আবারও সামনে বাড়ল মিতা।

পাঁচ মিনিট পর ওকে তুলে নেয়া হলো প্রকাণ্ড হেলিকপ্টারে।

হতাশ চোখে মিতা দেখল, একটু দূরেই বে-তে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে মায়ান রাজার মূর্তি। একবার দুলে উঠে রওনা হলো সিকোরস্কি স্কাইক্রেন। বুকে হাহাকার জাগল ওর। পেছনে পড়ে রইল ধূম্রাচ্ছন্ন দ্বীপে তরুণ পিকো আর মৃত প্রফেসর জর্জ হ্যারিসন!

.

কালো আগ্নেয় মাটিতে নিথর পড়ে আছেন প্রফেসর হ্যারিসন। নিষ্পলক একটি চোখ দেখছে ঢালু জমিন। প্রায় খাড়া জমিতে গড়াতে শুরু করেই নিচের এই জঙ্গলের গাছে লেগে থেমেছেন। তাতে পিঠে লেগেছে বেদম ব্যথা। হাত থেকে ছিটকে গিয়েছিল ব্যাকপ্যাক। ওটা হারিয়ে গেছে আরও নিচে কুয়াশার মত ধোঁয়ার ভেতর। সেই তখন থেকে অপলক দেখছেন ঢালু জমি। নড়বেন, সে সাধ্য নেই। সবই দেখেছেন, তার সাধের মূর্তি ও স্নেহের পাত্রী মিতাকে হেলিকপ্টারে তুলে নিয়ে গেছে কারা যেন!

প্রফেসর বুঝতে পারছেন, অবশ হয়ে গেছে দেহের নিচের অংশ। শীত লাগছে বড়। তবে আপাতত প্রাণ আছে, শ্বাসও নিতে পারছেন, তাতেই তিনি খুশি।

গলা দিয়ে চিচি করেও আওয়াজ বেরোচ্ছে না, দূরে থাক সাহায্যের আশায় চিৎকার। বড় একা লাগছে। তাঁকে চেপে ধরছে নিদারুণ ভয়। সত্যি শরীর অবশ হলে, সরে যেতে পারবেন না! সেক্ষেত্রে জ্বালামুখের এদিকটায় এসে তাকে পাওয়ামাত্র হাসতে হাসতে খুন করবে লোকগুলো!

নিজ চোখে দেখেছেন গুলি লেগেছে পায়ে। কত রক্ত যে বেরোল! এখন অবশ্য প্রায় শুকিয়ে এসেছে ওই স্রোত। কোমর থেকে নিচের অংশে কোনও অনুভূতি নেই। পাদুটো আছে ওপরের জমিতে, তাই উরু বেয়ে পেট ও শার্ট ভিজিয়ে দিয়েছে রক্ত।

বারবার পা নাড়াতে চাইছেন প্রফেসর, কিন্তু বিন্দুমাত্র সাড়া নেই। নিজের অসহায়ত্ব বুঝে রাগ ও দুঃখে কেমন পাগল পাগল লাগছে তার।

চুপ করে পড়ে রইলেন। একটু পর ভাবলেন, মিতা ও তার ভেতর কে আসলে বড় বিপদে আছে। আরও কিছুক্ষণ পর মন বলল, তার তো মরে যাওয়ার কথা, তা হলে স্বাভাবিক হয়ে উঠছে কেন শ্বাস! শুধু তাই নয়, চাপা একটা ব্যথাও শুরু হয়েছে দুপা জুড়ে! ঠিক ব্যথাও নয়, ঝিনঝিনে অনুভূতি। যেন হালকাভাবে খুঁচিয়ে দেয়া হচ্ছে পিন বা কাঁটা দিয়ে। কিন্তু কেউ নেই যে তাকে বকবেন!

বাড়ছে অস্বস্তিকর ব্যথা। কষ্ট ও বিরক্তি বাড়তেই মন বলল, ওরে, নড়েচড়ে দে তো, উঠে দাঁড়াতে পারিস কি না!

নাড়তে গিয়ে বুঝলেন, সামান্য অনুভূতি ফিরেছে দুহাতের বুড়ো আঙুলে। শরীর মুচড়ে কাত হলেন বামদিকে।

সামান্য বিশ্রাম নিয়ে নতুন উদ্যমে নামলেন কাজে। একটু পর মুক্ত হলেন ঝোপ ও ডালপালার জটলা থেকে। প্যারালাইয হয়ে যে যাননি, তা ভেবে খুশি। একটু কষ্টও পেলেন মনে। বেড়ে গেছে গুলির ক্ষতের ব্যথা। আড়ষ্ট লাগছে শরীর। তার ওপর দুর্বলতার শেষ নেই! তবুও হামাগুড়ি দিয়ে কয়েক ফুট গিয়ে ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়লেন। গালে লাগছে ধুলোভরা ঢালু মাটি।

একটু বিশ্রাম নিয়ে মাথা তুলে আবছাভাবে দেখলেন চূড়ার দিকে কে যেন!

সে পুরুষমানুষ নয়, রুপালি পোশাকের ভদ্রমহিলা!

চোখ পিটপিট করলেন হ্যারিসন। তখনই হাওয়ায় মিলিয়ে গেল ছায়ামূর্তি।

আহত ও জ্বরাক্রান্ত হ্যারিসন ভাবলেন: কে ওই মহিলা? একটু আগেও ছিল ওদিকে!

জেদ ধরে দুহাতের ভর দিয়ে উঠে বসলেন হ্যারিসন। হামাগুড়ি দিয়ে উঠতে লাগলেন ঢালু জমিতে। টলমল করে উঠে দাঁড়িয়ে কয়েক পা হেঁটে হাল ছেড়ে দিলেন। এই শরীরে খাড়া জমি বেয়ে ওঠা সাধ্যের বাইরে। হেঁচড়ে এগোলেন। হাতের তালুর নিচে কুড়মুড় শব্দে গুড়ো হচ্ছে আগ্নেয়মাটি। হঠাৎ হড়কে গিয়ে ফিরলেন আগের জায়গায়। তারপর সেখানেও রয়ে যেতে পারলেন না, পিছলে পৌঁছে গেলেন কুয়াশার মত ধোঁয়ার ভেতর। থামল না তাঁর পতন, শেষে স্থির হলেন লেকের কিনারায় নরম মাটিতে। পাশেই পেলেন আধঘণ্টা আগে খুইয়ে বসা ব্যাকপ্যাক।

লোভীর মত ওটা দেখলেন প্রফেসর হ্যারিসন। কাছে টেনে খুলতে চাইলেন যিপার। মনে হলো কাজটা খুবই কঠিন। আঙুল দিয়ে ছিঁড়তে চাইলেন যিপার। সফল হওয়ার আগেই শুনলেন লেকের পানিতে ছপছপ শব্দ। ঘুরে তাকালেন তিনি।

অগভীর পানি ভেঙে তীরে উঠে আসছে পিকো। করুণ কণ্ঠে বলল তরুণ, হেলিকপ্টারে করে তুলে নিয়ে গেছে মূর্তি, নিজের চোখে দেখেছি!

জানি, মাথা দোলালেন প্রফেসর। কিছুই করার ছিল না। রক্তাক্ত পা দেখালেন, আমাকে সরাতে চাইলে লোক ডাকতে হবে।

লোক পাব কই? বলল পিকো। আমরা গ্রাম থেকে অনেক দূরে।

ওর সাহায্য নিয়ে ক্ষতটা ড্রেস করলেন হ্যারিসন। কাজটা শেষ হওয়ায় ওঅটারপ্রুফ কন্টেইনার থেকে স্যাটেলাইট ফোন বের করল পিকো। যন্ত্রটা ঠিক আছে কি না, তা নিয়ে দুশ্চিন্তা ছিল, কিন্তু চালু হতে দেখা গেল জ্বলে উঠেছে সবুজ স্ক্রিন। ঠিকই ধরছে সিগনাল।

হাতে মোবাইল ফোন দেয়ায় ইনিশিয়েট বাটন টিপলেন প্রফেসর। কয়েক সেকেণ্ড পর লিঙ্কআপ হলো স্যাটেলাইটের সঙ্গে। ওয়াশিংটন ডি.সি.-র সিকিয়োর এক কমিউনিকেশন রুম থেকে কর্কশ কণ্ঠে কথা বলে উঠল এক লোক।

কিন্তু তাকে দিয়ে চলবে না প্রফেসর হ্যারিসনের। তিনি চান কর্তৃপক্ষের উঁচু পর্যায়ের কাউকে। তাই বললেন, প্রফেসর জর্জ হ্যারিসন বলছি। আমি প্রজেক্ট মিররের সঙ্গে জড়িত। আমার কোড: সেভেন সেভেন সেভেন ওয়ান সিক্স। হামলা হয়েছিল আমাদের ওপর। সর্বনাশ হয়েছে মিশনের। তাই এনআরআই চিফ জেমস ব্রায়ানের সঙ্গে আলাপ করতে চাই।

.

০৩.

প্রফেসর জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে এনআরআই চিফ জেমস ব্রায়ানের আলাপের পর পেরিয়ে গেছে পুরো চব্বিশটি ঘণ্টা।  এ মুহূর্তে হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে প্রেসিডেন্টের সামনে বসে আছেন ব্রায়ান। একবার হাত বুলিয়ে ঠিক করতে চাইলেন অবাধ্য ধূসর চুল। প্রেসিডেন্ট তার পুরনো বন্ধু হলেও অস্বস্তির ভেতর রয়েছেন তিনি।

বিশাল ডেস্কের ওদিকে রাজকীয় চেয়ারে বসে অবহেলার সঙ্গে কিছু ডকুমেন্টে সই করছেন প্রেসিডেন্ট। কাজটা শেষ করে নিখুঁতভাবে গুছিয়ে নিলেন কাগজ, তারপর রেখে দিলেন পাশে। নিজে তিনি বয়সে বড় হলেও জুনিয়র বন্ধু এনআরআই চিফকে যথেষ্ট শ্রদ্ধার চোখে দেখেন। সরাসরি জানতে চাইলেন, নিশ্চয়ই কোনও দুঃসংবাদ? আজকাল তোমার অফিস থেকে ফোন এলে ভয় লাগে! তো বলে ফেলো কী হয়েছে!

ভাঁজ করা কাগজটা প্রেসিডেন্টের দিকে ঠেলে দিলেন ব্রায়ান। আমি অবসর নিতে চাইছি।

পদত্যাগের চিঠিটা দেখলেন প্রেসিডেন্ট, হাতে নিলেন না। তুমি তো গলফ খেলো না। সিনেমাও দেখো না। কোনও নেশা নেই। শখ বলতেও লবডঙ্কা। রিটায়ারমেন্টের পর কী করবে?

চুপ করে বসে থাকব বাড়িতে।

তোমার মত যোগ্য এবং দক্ষ কাউকে এনআরআই চিফ হিসেবে পাওয়া খুব কঠিন হবে আমেরিকান সরকারের জন্যে। খুলে বলো তো কী হয়েছে, জেমস?

মৃদু হাসি প্রেসিডেন্টের ঠোঁটে। ওটা দিয়েই মাত করেছিলেন কোটি ভোটারকে। ওই হাসি যেন বলে: সমস্যা? ভেবো না, সব কিছুরই সমাধান থাকে!

মস্ত ঝামেলায় পড়েছি। তা-ও একটা নয়, দুটো। এসব সলভ করা আমার পক্ষে অসম্ভব। তাই ভাবছি অপমানিত হয়ে বিদায় নেয়ার আগে পদত্যাগ করাই ভাল।

ডেস্ক থেকে রেযিগনেশন লেটারটা তুলে ফড়াৎ করে ছিঁড়ে ফেললেন প্রেসিডেন্ট, কাগজের টুকরো ট্র্যাশ-ক্যানে ফেলে বললেন, আমার সাধ্যমত করব, জেমস। তোমাকে পাশে চাই। খুলে বলো কী ধরনের সমস্যা। একটু ঝুঁকে বসলেন। আলাপ করলে হয়তো বেরিয়ে আসবে সহজ কোনও পথ।

এক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন ব্রায়ান, তারপর কোলে ব্রিফকেস তুলে ওটা থেকে নিলেন দুটো কাগজ। রাখলেন প্রেসিডেনশিয়াল ডেস্কের ওপর।

প্রথম কাগজটা তুলে নিয়ে দেখলেন প্রেসিডেন্ট।

ওটা স্যাটেলাইট ছবি।

প্রশান্ত মহাসাগর চিরে আলাস্কার দিকে চলেছে রাশান নেভির একটি ফ্লিট।

দ্বিতীয় কাগজে ছোট কয়েকটি ছবি, সঙ্গে কিছু তথ্য।

রওনা হয়েছে চাইনিজ নেভির একটি নৌবহর। তাদের সঙ্গে জুটে গেছে কয়েকটা বাণিজ্য তরীও।

আগেও দেখেছি এসব, বললেন প্রেসিডেন্ট, সকালে কথাও হয়েছে রন ল্যাডলওর সঙ্গে। ল্যাডলও নেভির চিফ অভ স্টাফ। এতে দুশ্চিন্তার কিছু দেখছি না। কয়েকটা ক্রুযার, আধডজন ডেস্ট্রয়ার, কয়েকটা রেকোন্যাসেন্স এয়ারক্রাফট। কিন্তু এসব দিয়ে আর যাই হোক, আলাস্কা দখল করতে পারবে না ওরা। ওই একই কথা খাটে চাইনিজদের ব্যাপারেও।

তা জানি, মাথা দোলালেন ব্রায়ান। ওরা হামলাকারী দল নয়। তবে মনোযোগ দিলে বুঝবেন, বেছে নিয়েছে সেরা দ্রুতগামী জাহাজ। ছড়িয়ে পড়ে এগোচ্ছে। এই যে… বেয়ারিং সি-র ইন্টারন্যাশনাল ডেট লাইনের কাছে ম্যাপের নির্দিষ্ট জায়গায় আঙুল রাখলেন এনআরআই চিফ।  

ল্যাডলও বলেছে, ওরা সার্চ পার্টি, বললেন প্রেসিডেন্ট।

আমিও একমত, সায় দিলেন ব্রায়ান, কিন্তু সার্চ করার মত কী আছে ওদিকে? এত ব্যস্ত কেন তারা? এর কোনও কারণ বের করতে পেরেছে আমাদের নেভি?

আরেকবার স্যাটেলাইট ছবি দেখলেন প্রেসিডেন্ট। চুপ করে আছেন।

নতুন তথ্য পাওয়ার জন্যে বললেন এনআরআই চিফ, মিস্টার প্রেসিডেন্ট, আমি খোঁজ নিয়েছি। বেয়ারিং সি-র ওদিকে আকাশ থেকে কিছুই পড়েনি। সব চ্যানেল মনিটর করেও পাওয়া যায়নি, কোনও ডিসট্রেস কল। স্যাটেলাইট ছবিতেও নেই অয়েল স্লিক বা কোনও ডেব্রি। ইনফ্রারেড স্ক্যান থেকেও জানা গেছে, কোনও বিস্ফোরণ হয়নি যে হিট স্পাইক হবে। আসলে এমন কিছুই নেই, যা থেকে ধরে নেব, আকাশ থেকে পড়েছে এয়ারক্রাফট, বা তলিয়ে গেছে কোনও ভেসেল। অথচ, প্রায় একইসময়ে সার্চের জন্যে রওনা হয়েছে দুদেশের নেভি ও কয়েকটি বাণিজ্য জাহাজ। সেক্ষেত্রে কেন অন্যদেরকে দৌড়ে হারিয়ে ওখানে পৌঁছুতে চাইছে?

মৃদু হাসলেন প্রেসিডেন্ট, বলো তো, আসলে কী জানতে চাও, জেমস?

ওদিকের সাগরে কী আমাদের সাবমেরিন আছে? সোনার থেকে কিছু জানা গেছে, যেটা থেকে বুঝব, একইসময়ে ওদিকে ছিল রাশান বা চাইনিজ সাবমেরিন?

দুঃখজনক, তবে ওদিকে আমাদের নৌযান ছিল না, বললেন প্রেসিডেন্ট। তীক্ষ্ণ চোখে দেখলেন জুনিয়র বন্ধুকে। ওখানে ওরা কী খুঁজবে বলে ভাবছ?

আমরা এখনও আছি অন্ধকারে, বললেন ব্রায়ান।

কিন্তু কিছু আঁচ করছ। নইলে আমার অফিসে আসতে।

আমেরিকান ইন্টেলিজেন্স সংস্থাগুলোর চিফরা কোনও বিষয়ে জানতে চাইলে তোলপাড় করেন গোটা দুনিয়া। এরপরও দরকারী তথ্য না পেলে চুপ থাকেন। কিন্তু ওই বিষয়ে হঠাৎ প্রেসিডেন্ট বা তাঁর স্টাফদের কাছ থেকে তলব এলে, তখন সত্যিকারের বিপদে পড়েন তাঁরা।

বাধ্য হয়েই মুখ খুললেন ব্রায়ান, রওনা হয়েছে রাশান ফ্লিট, কিন্তু তার কয়েক ঘন্টা আগে বেয়ারিং সি-র এক জায়গা থেকে এসেছে গামা রে। বড় বিস্ফোরণ নয়। কিন্তু ওই ধরনের এনার্জি ওখানে খুবই অস্বাভাবিক।

গামা রে? নড়েচড়ে বসলেন প্রেসিডেন্ট। তুমি তো জানো, ভাল লাগত না সায়েন্স। তাই পড়েছি আইন। একটু খুলে বলল কী হয়েছে।

গামা রে আসলে হাই-এনার্জি ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ, বললেন ব্রায়ান, হাইপার-পাওয়ারফুল এক্স-রে বা নিউক্লিয়ার সার্জারির মত কাজে ব্যবহার করা হয়। অস্ত্র হিসেবেও ব্যবহার করতে গবেষণা চলছে। ভবিষ্যতে হয়তো আকাশ থেকে ফেলে দেয়া যাবে মিসাইল। অথরা, খতম হবে হাজার হাজার সৈনিক।

ভুরু কুঁচকে ফেললেন প্রেসিডেন্ট। তা হলে এ কথা আমাকে বলেনি কেন ল্যাডলও?

উনি বোধহয় জানেন না, বললেন এনআরআই চিফ। তার স্যাটেলাইটগুলো এ ধরনের জিনিস স্ক্যান করে না। আপনাকে এখন যে তথ্য দিচ্ছি, তা এসেছে গতবছর লঞ্চ করা এনআরআই স্যাটেলাইট থেকে।

চুপ করে অপেক্ষা করছেন প্রেসিডেন্ট।

আবারও মুখ খুললেন ব্রায়ান, একইসময়ে মহাশূন্যে আর্কটিক সার্কেলের ওপরে ছিল আমাদের চারটে জিপিএস স্যাটেলাইট, সবই জিয়োসিনক্রোনাস অরবিটে ঘুরছে সুমেরু সার্কেলে। গামা রে বিচ্ছুরণ হওয়ায় কয়েক সেকেণ্ডের জন্য অন্ধকার হয়ে যায় প্রতিটি। তারপর চালু হয় নতুন করে। তবে ওরা প্রত্যেকেই রেকর্ড করেছে ওই বিচ্ছুরণ।

প্রেসিডেন্টের হাতে আরেকটা প্রিন্টআউট দিলেন ব্রায়ান। আপনি জানেন, এসব জিপিএস স্যাটেলাইটে রয়েছে অ্যাটমিক ক্লক, প্রতি সেকেণ্ডের লক্ষভাগ সময় হিসাব কষতে পারে ওগুলো। সঠিকভাবে বুঝতে পারে টার্গেটের দূরত্ব। কিন্তু লগ অনুযায়ী এক সেকেণ্ডে এক বিলিয়নভাগের একভাগ সময়ে বন্ধ হয়েছিল চারটে জিপিএস স্যাটেলাইট। গ্রাউণ্ড বেড় কোনও সিস্টেম নেই যেটা চার জায়গা থেকে অত নিখুঁতভাবে নির্ধারণ করবে সময়।

এসব থেকে কী বুঝব?

ওই চার স্যাটেলাইট বন্ধ হয় বিশেষ কোনও দুর্যোগের কারণে।

কাগজটা কয়েক সেকেণ্ড দেখে নিয়ে এনআরআই চিফের দিকে তাকালেন প্রেসিডেন্ট। তো তুমি বলতে চাও, ওটা কোনও অস্ত্র, যেটা ছিল কোনও সাবমেরিনের ভেতর? ত্রুটির কারণে ওভারলোড় হওয়ায় ধ্বংস হয়েছে ওটার প্ল্যাটফর্ম। তাই ওটার ধ্বংসস্তূপ উদ্ধার করতে রওনা হয়েছে চিনা ও রাশান সার্চ পার্টি? দুদলেরই চাই ওই জিনিস। আর আমরা এ ব্যাপারে পিছিয়ে পড়েছি?

হতে পারে, বললেন ব্রায়ান, তবে আমরা অন্য একটা সম্ভাবনা নিয়ে ভাবছি। আমাদের মতই প্রায় একইসময় থেকে এনার্জি ওয়েপন্সের ওপর গবেষণা করছে রাশা ও চিন। হয়তো অস্ত্র পরীক্ষা করেছে সাগরের ওদিকে।

কাগজগুলো এনআরআই চিফের দিকে ঠেললেন প্রেসিডেন্ট। বুঝলাম। তো এ ব্যাপারে কাজে নামলে কী ধরনের সহায়তা বা ইকুইপমেন্ট লাগবে তোমার?

প্রথমত, চাই যথেষ্ট সময় ও এনএসএর ভল্টের ডেটা। তাতেই হবে না, কাজে লাগাতে হবে প্রশান্ত মহাসাগরে আমাদের প্রতিটি সোনার। চাইব না এনএসএ, সিআইএ বা অন্য কোনও সংস্থা আমাদের সংগৃহীত ডেটা জেনে নাক গলাবে, বা প্রশ্ন তুলবে। তাই ওই বিষয়ে দিতে হবে পুরো ব্লকেড।

এনআরআই চিফের কথা শুনে মনে মনে হোঁচট খেয়েছেন প্রেসিডেন্ট। লালচে হয়ে গেল চেহারা। জেম্স, পাগল হলে? কেন ভাবছ, ওরা এ ধরনের আবদার মানবে?

টুঁ শব্দ করলেন না ব্রায়ান। অন্য ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির থেকে নানা দিক দিয়েই আলাদা এনআরআই, তা ভাল করেই জানেন প্রেসিডেন্ট। এ কারণেই সবসময় এ সংস্থার চিফের পাশে থেকেছেন তিনি। এবারও তার ব্যত্যয় হবে না ভাবছেন ব্রায়ান।

প্রায় সব সুযোগ সুবিধা পাবে, কিন্তু সোনার লাইন দেয়া অসম্ভব, বললেন প্রেসিডেন্ট। খুবই কাছে পৌঁছে গেছে রাশান ফ্লিট, এই অবস্থায় ল্যাডলওকে সোনার ব্লক করলে, স্রেফ উন্মাদ হবে সে। তবে অন্য ব্যবস্থা হতে পারে। তোমার কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত সোনারের সব তথ্য নিয়মিত দেবে নেভি। তোমাকে পুরো আটচল্লিশ ঘণ্টা সময় দিলাম। পরে জরুরি প্রয়োজন পড়লে কমিয়েও দিতে পারি সময়টা বা বাতিলও করতে পারি আদেশ।

মৃদু মাথা দোলালেন ব্রায়ান। ভাবছেন, যাক, আদায় করা গেছে অনুমতি!

এবার আসি আমার দ্বিতীয় সমস্যার বিষয়ে, ব্রিফকেসে নোটগুলো রাখলেন। কখনও কোনও অনুরোধ করিনি, মিস্টার প্রেসিডেন্ট। কিন্তু আজ একটা সাহায্য চাইব আপনার কাছে।

ব্যক্তিগত অনুরোধ?

ধরুন, তা-ই। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকলেন ব্রায়ান, তারপর বললেন, কিডন্যাপ হয়েছে আমার প্রিয় একজন। তথ্য পেয়েছিঃ যারা ওকে তুলে নিয়ে গেছে, তারা কাজ করে চাইনিজ বিলিয়নেয়ার হুয়াং লি ল্যাং-এর হয়ে। আমি চাই ওই লোকের কজা থেকে মেয়েটিকে ছিনিয়ে আনতে।

আরও গম্ভীর হয়ে গেলেন প্রেসিডেন্ট। কী করে? ভাল করেই জানো দুনিয়া জুড়ে কী চলছে! আমাদের কোনও ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির কেউ মহাচিনে ধরা পড়লে মুখ থাকবে না আমেরিকার।

জানি, মিস্টার প্রেসিডেন্ট।

 তা হলে কেন?

হঠাৎ এ প্রশ্নে বিস্মিত হয়েছেন ব্রায়ান। ঠিক কী জানতে চাইছেন, মিস্টার প্রেসিডেন্ট?

ওই মেয়ের কাছে জরুরি কোনও তথ্য আছে, যেটা আমাদের বিপক্ষে যাবে? জিজ্ঞেস করলেন প্রেসিডেন্ট।

না, তা নেই, বললেন ব্রায়ান, কিন্তু আমরা সাহায্য না করলে দুনিয়া থেকে হারিয়ে যাবে মেয়েটি। প্রয়োজন মিটে গেলে অত্যাচার করে ওকে মেরে ফেলবে হুয়াং লি ল্যাং।

থমথম করছে প্রেসিডেন্টের মুখ। তুমি বা আমি আমেরিকান সরকারের হয়ে কাজ করেছি এবং করছি। এই ঝুঁকি নিতে হবে, সেটা জানত না ওই মেয়ে?

ওই মেয়ে এনআরআই-এর এজেন্ট নয়, সামান্য দ্বিধা নিয়ে বললেন ব্রায়ান। অনুরোধ করে ওকে কাজে নিয়েছিলাম।

কার কথা বলছ? জানতে চাইলেন প্রেসিডেন্ট।

মিতা দত্ত, নিচু স্বরে বললেন ব্রায়ান।

 সামান্য কুঁচকে গেল তার সিনিয়র বন্ধুর চোখ।

মিতার বিষয়ে প্রায় সবই জানেন প্রেসিডেন্ট।

নিউমোনিয়ায় প্রিয় স্ত্রীর মৃত্যু হলে দ্বিতীয়বার বিয়ে করেননি ব্রায়ান। নিঃসন্তান মানুষ, নিজের মেয়ের মতই ভালবাসেন মিতাকে। আর তা করবেনই বা না কেন?

ঘনিষ্ঠ বন্ধুর একমাত্র মেয়ে। কিন্তু একবছর আগে সত্যি ওকে চিনলেন তিনি। হার্ট অ্যাটাক হওয়ায় ভর্তি ছিলেন হাসপাতালে। দুএক দিন দেখতে গেল অফিসের অনেকে, তারপর সবাই যেন ভুলে গেল তার কথা।

কিন্তু ওই একটি মেয়ে প্রতিদিন যেত গোলাপ ও চকোলেট হাতে। গল্প করত মাথার পাশে বসে। জুগিয়ে দিত সাহস। তাঁর মনে হতো, তাই তো, দুবার হার্ট অ্যাটাক হলেও আসলে কিছুই হয়নি!

সুস্থ হওয়ার পর নতুন উদ্যমে কাজে নেমে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন।

বিপদে পাশে থাকার অদ্ভুত গুণ মিতা পেয়েছে ওর বাবা বিনয় দত্তের কাছ থেকেই।

তাঁর মতই দক্ষ ফিযিসিস্ট মিতা। আরও কত গুণ যে আছে, অন্য কেউ না জানলেও ব্রায়ান জানেন। যেমন ওর সাহস, তেমনি ন্যায়নীতি বোধ।

হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে অবাক হন তিনি। সবই ছিমছাম। ধুলো বলতে কিছুই নেই। গুছিয়ে রাখা হয়েছে প্রতিটি আসবাবপত্র। বিছানায় পরিষ্কার চাদর। বেড-টেবিলে তার প্রতিটি প্রয়োজনীয় ওষুধ।

পুরো সুস্থ হওয়া তক তার পছন্দের পদ জেনে নিয়ে তা বেঁধে পাশে বসে পরিবেশন করেছে মিতা।

আপন মেয়ে থাকলে যা করত, তাই করেছে মেয়েটি।

এই মুহূর্তে আশা ও চরম উৎকণ্ঠায় দুলছে ব্রায়ানের মন। চুপচাপ চেয়ে আছেন প্রেসিডেন্টের দিকে।

মৃদু মাথা নাড়লেন প্রেসিডেন্ট। তুমি জানো এই খেলার নিয়ম। কয়েক বছর ধরেই চিনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আড়ষ্ট। তার ওপর সামনে নির্বাচন। ফুরিয়ে আসছে আমার টার্ম। এখন হুয়াং লি ল্যাং-এর ব্যাপারে ভুল পদক্ষেপ নিলে সর্বনাশ হবে। সমস্ত দায় পড়বে পার্টি এবং আমার ওপর। সরি, জেমস, পানি আরও ঘোলা করার সময় এখন নয়।

হুয়াং লি ল্যাং কিন্তু চিন সরকারের কেউ নয়, বললেন ব্রায়ান, এমন এক চিনা নাগরিক, যে কি না কিডন্যাপ করেছে এ দেশের এক নাগরিককে।

ল্যাং সাধারণ কেউ নয়, চিনের সবচেয়ে বড় বিলিয়নেয়ার। আরেকবার মাথা নাড়লেন প্রেসিডেন্ট।

হাল ছাড়লেন না এনআরআই চিফ। গোপনে কাজে নামতে পারি আমরা।

চোখ থেকে চোখ সরিয়ে দরজা দেখলেন প্রেসিডেন্ট। এ ব্যাপারে আমার আর কিছু বলার নেই, জেমস।

বড় করে দম দিলেন এনআরআই চিফ। অনুরোধ করে লাভ হবে না। দ্বিতীয়বার এই বিষয়ে ভাববেন না প্রেসিডেন্ট।

পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ব আমরা, নরম সুরে বললেন পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাশালী মানুষটা। তবে সময় লাগবে কাজ হতে।

মাথা দোলালেন ব্রায়ান। উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ওই গামা রে-র ব্যাপারে নতুন তথ্য পেলে দেরি না করে তা জানিয়ে দেব। 

ঘুরে দরজার দিকে চললেন তিনি।

সামনের ডকুমেন্টে চোখ রাখলেন প্রেসিডেন্ট, তবে দুসেকেণ্ড পর জানতে চাইলেন, তোমার ওই দুই সমস্যার ভেতর কোনও সম্পর্ক আছে?

বহু বছর হলো সরকারী চাকরি করছেন ব্রায়ান। ভাল করেই জানেন, কখন উচিত তথ্য চেপে রাখতে হয়। ঘুরে তাকালেন তিনি।

চেয়ে আছেন প্রেসিডেন্ট। পূর্ণগতি তুলে বেয়ারিং সি-তে হাজির হয়েছে চাইনিজ ফ্লিট। এদিকে মেক্সিকো থেকে মিতা দত্তকে কিডন্যাপ করেছে চাইনিজ বিলিয়নেয়ার। এ-দুটো ঘটনার ভেতর কোনও সংযোগ নেই তো?

তেমন কিছু আমাদের জানা নেই।

ভুরু কুঁচকে ব্রায়ানকে দেখলেন প্রেসিডেন্ট। বলল তো, জেমস, মিতা আসলে কী করছিল মেক্সিকোতে?

অত্যন্ত গম্ভীর ব্রায়ান বললেন: ওর কাজ ছিল একটা স্ফটিক খুঁজে বের করে ওটা এ দেশে নিয়ে আসা। জটিল ফিযিক্সের সঙ্গে তা জড়িত। আমরা নিশ্চিত নই, তবে পৃথিবী রক্ষা বা ধ্বংসের সঙ্গে এটা ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত।

ঠিক আছে, এ ব্যাপারে নতুন কোনও ডেটা পেলে জানাবে। আবারও কাগজে নাক খুঁজলেন প্রেসিডেন্ট।

ওভাল অফিস থেকে বেরিয়ে এলেন বিমর্ষ ব্রায়ান, হোয়াইট হাউসের পার্কিং লটের দিকে পা বাড়িয়ে ভাবলেন: মিতাকে সাহায্য করতে পারল না আমেরিকা। ক্ষুধার্ত বাঘের মত হিংস্র হুয়াং লি ল্যাং-এর বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারবেন না তিনি।

তা হলে? কেউ কি নেই যে সাহায্য করতে পারবে?

অসহায় মানুষকে বাঁচাতে নিজ জীবন বাজি ধরতেও রাজি, এমন একজনের কথা মনে পড়ল এমআরআই চিফের।

হাঁটতে হাঁটতে বিড়বিড় করলেন, আছে এখন নিউ ইয়র্কে, কিন্তু সে কী রাজি হবে সাহায্য করতে?

তাঁর মন বলল: কেউ যদি পারে মিতাকে উদ্ধার করতে, সে ওই বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স বা বিসিআই-এর উজ্জ্বলতম তারকা, দুর্ধর্ষ, দুঃসাহসী এজেন্ট এমআরনাইন! 

হ্যাঁ, জগতে অমন আর কেউ নেই! মাসুদ রানার দুয়ার থেকে খালি হাতে ফেরে না বিপদগ্রস্ত মানুষ।

চট করে হাতঘড়ি দেখলেন তিনি, তারপর পকেট থেকে আইফোন নিয়ে কল দিলেন নিউ ইয়র্কে রানা এজেন্সির অফিসে।

.

০৪.

 নিউ ইয়র্কে বিকেলের আকাশ কালচে। আবহাওয়া দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে: যে-কোনও সময়ে শুরু হবে মাঝারি থেকে ভারী তুষারপাত এবং সেইসঙ্গে দমকা হাওয়া।

কাজ গুছিয়ে নিয়ে যে যার বাড়ির পথে ছুটছে মানুষ। আগামী একঘণ্টার ভেতর ফাঁকা হয়ে যাবে শহরের রাস্তাঘাট।

রানা এজেন্সিতে নিজের অফিসে বসে আছে মাসুদ রানা, চোখ বোলাচ্ছে ফাইলে। ওটা দেখা শেষ হলেই ছুটি, আগামীকাল থেকে কোনও কাজ নেই ওর। ভেবে বের করতে হবে কীভাবে কাটাবে সময়।

আজকের মত কাজ শেষ করে বিদায় নিয়েছে প্রায় সবাই। অবশ্য রয়ে গেছে রিসেপশনিস্ট সৈকত। গত একবছর হলো ওপরতলায় রানার ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টের গেস্টরুমে আস্তানা গেড়েছে ও। শেষপর্যন্ত জমাতে পেরেছে যথেষ্ট টাকা। কদিন পর ফিরছে দেশে। বিয়ে করবে স্বপ্নের রানি, দূরসম্পর্কের খালাতো বোন তৃষ্ণাকে। জানেও না, ওদের বিয়েতে উপহার হিসেবে মোটা অঙ্কের তহবিল গড়েছে রানা এজেন্সির নিউ ইয়র্ক শাখার সবাই মিলে। দেশে যাওয়ার সময় তুলে দেয়া হবে সৈকতের হাতে।

রিপোর্ট দেখা শেষ করে মন্তব্য লিখে সই করবে রানা, এমনসময় বেজে উঠল ইন্টারকম।

রিসিভার তুলে বলল রানা, ইয়েস, প্লিয?

ওদিক থেকে বলল সৈকত, মাসুদ ভাই, এনআরআই চিফ। নিয়ে আসব?

নিয়ে এসো। ইন্টারকম রেখে সামনে থেকে ফাইল সরাল রানা, চিন্তিত। মাঝসকালে ফোনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছেন জেমস ব্রায়ান। নিউ ইয়র্কে এসে দেখা করবেন। কিন্তু কেন তখনই আলাপ করলেন না, ব্যাপারটা কৌতূহল উদ্রেক করছে ওর।

এনআরআই চিফ জেমস ব্রায়ানকে চেনে রানা,, তবে ঘনিষ্ঠতা নেই। আগেও বিসিআই-এর এক মিশনে তাঁর সংগঠনের সঙ্গে কাজ করেছে ও।

সৈকত দরজা খুলে হাতের ইশারা করতেই রানার কামরায় ঢুকলেন ব্রায়ান। পেছন থেকে আকাশে দুটো আঙুল তুলল সৈকত। মৃদু মাথা দোলাল রানা। এনআরআই চিফের পেছনে বন্ধ হয়ে গেল দরজা।

রানা চেয়ার ছেড়ে হাত বাড়াতেই করমর্দন করলেন জেমস ব্রায়ান।

বসুন, আরামদায়ক চেয়ার দেখাল রানা।

ধপ করে চেয়ারে বসলেন ব্রায়ান। কৌতূহলী চোখে তাঁকে দেখছে রানা। ভদ্রলোকের চোখে-মুখে চরম দ্বিধা ও অস্বস্তি।

বলুন? স্বাভাবিক সুরে বলল রানা।

কিছুক্ষণ কী যেন ভেবে তারপর বললেন এনআরআই চিফ, বিপদে পড়ে সাহায্য চাইছি। বিষয়টি ব্যক্তিগত। চুপ হয়ে গেলেন তিনি।

মৃদু হাসল রানা। আপনিঃ এনআরআই চিফ, বিপদে পড়ে এসেছেন দরিদ্র একটি দেশের সামান্য এক গুপ্তচরের কাছে?

ওকে দেখছেন জেমস ব্রায়ান, মুখে রা নেই।

চোখে চোখ রেখে অপেক্ষা করছে রানা।

ওয়াশিংটন ডিসি থেকে ছুটে এসেছি, কারণ মনে হয়েছে সাহায্য পাব আপনার কাছে, বললেন ব্রায়ান।

চাইলেই তো মাঠে নামাতে পারেন আপনার শতখানেক এজেন্ট, বলল রানা।

নীতির কারণে তা পারি না। যেহেতু ব্যাপারটা ব্যক্তিগত। প্রেসিডেন্টের সঙ্গেও আলাপ করেছি। বলেছেন, কোনও সাহায্য করতে পারবেন না তিনি।

কী বিষয়ে সাহায্য চাইছেন?

 আপনার কি মনে আছে মিতা দত্তের কথা?

 হ্যাঁ।

বিপদটা আসলে ওর।

গতবছর এনআরআই-এর জটিল এক মিশনে যান ডক্টর জর্জ হ্যারিসন নামে কৃষ্ণ বর্ণের এক আর্কিওলজিস্ট। তাঁর সঙ্গে ছিল মাথা ঘুরিয়ে দেয়ার মত অপূর্ব সুন্দরী, চব্বিশ বছর বয়সী ফিযিসিস্ট মিতা দত্ত। ওদের নিরাপত্তার জন্যে এনআরআই থেকে কয়েকজন মার্সেনারিকে ভাড়া করা হয়, কিন্তু সবাই নৃশংসভাবে খুন হয়েছিল শত্রুপক্ষের হাতে। তখন বাংলাদেশ সচিবালয়ের ডেপুটি সেক্রেটারি, ফুপাতো ভাই অপরেশ ব্যানার্জির কাছে ফোন দেয় অসহায় মিতা।

ভদ্রলোক যোগাযোগ করেন বিসিআই-এ।

ছুটিতে ব্রাযিলে ঘনিষ্ঠ বন্ধু রাফায়ালের কফি প্ল্যান্টেশনে ছিল রানা। ওরা ঠিক করে, রাফায়ালের সদ্য কেনা ভাঙাচোরা দুটো হেলিকপ্টার মেরামত হলে, ওগুলো বিক্রির টাকা সমানভাগে ভাগ করে নেবে দুজন। পরে ও-দুটো কিনে নেয় শ্রীলঙ্কান আর্মি। নিজের ভাগের টাকা দাঁতব্য একটি সংগঠনে দান করেছিল রানা।

একটা হেলিকপ্টার প্রায় মেরামত করেছে, এমনসময় সন্ধ্যায় ফোন দিলেন বিসিআই থেকে মেজর জেনারেল (অব.) রাহাত খান। দুচার কথার পর ওকে বললেন, ছুটির এ সময়ে মিতা দত্তকে সাহায্য করলে তিনি খুশি হবেন। ভাইয়ের সঙ্গে কথা হয়েছে মেয়েটার, এ অভিযানে বাংলাদেশের জন্যে প্রয়োজনীয় কিছু পাওয়া গেলে তা বিসিআই-এর হাতে তুলে দিতে দ্বিধা করবে না ও।

রানাও ভেবেছে, ওর উচিত মেয়েটার পাশে থাকা।

পরদিন দুপুরে প্ল্যান্টেশনে এসে দেখা করল মিতা। সরাসরি বলল, আমার ভাই ফোন করে বলেছেন, আপনি হয়তো আমাকে সাহায্য করবেন। তাই চলেই এলাম।

রানার মনে হলো, অদ্ভুত রূপসী মেয়েটির আচরণ খুব সাবলীল ও সহজ। অভিযানে কোথায় যেতে হবে জানার পর অল্প কথায় রানা জানাল, যেতে আপত্তি নেই। কিন্তু আমাযনে ঢোকার পর থেকে আমার নির্দেশের বাইরে যাওয়া। চলবে না।

তাই হবে, খুশি মনে রাজি হয়েছিল মিতা।

এরপর জড়িয়ে গেল ওরা আমাযনের জঙ্গলে বিপজ্জনক এক মায়ান অভিযানে। নানান দিক থেকে এল হামলা। এক জার্মান বিলিয়নেয়ারের ব্যক্তিগত আর্মির বিরুদ্ধে লড়ল রানা। মায়ান মন্দিরে ওদের ওপর হামলে পড়ল অদ্ভুত কিছু মিউটেড জন্তু, প্রায় মরতে মরতে রক্ষা পেল ওরা। আরও বহু ঝামেলা পোহাবার পর মিলল মাত্র একটি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী স্ফটিক।

ওটার বিষয়ে বিসিআই চিফকে রানা ফোন দিলে, তিনি জানান, আপাতত অমন গবেষণার জন্যে, তৈরি নন বাঙালী ফিযিসিস্টরা। কাজেই ওই স্ফটিক যেন দেয়া হয় এনআরআই-কে। তাদের গবেষণা সফল হলে উপকৃত হবে গোটা পৃথিবীর মানুষ।

রানার মনে আছে, আগে থেকেই মিতা জানত আত্মরক্ষার জন্য আনআমড় কমব্যাট। চোখ ধাঁধিয়ে দেয়া মেয়েটির খুব আগ্রহ দেখে কুংফুর নতুন কিছু কৌশল ও নানান আগ্নেয়াস্ত্রের ওপর সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ দিয়েছিল ও।

এনআরআই চিফের কাছে জানতে চাইল রানা, কী ধরনের বিপদে পড়েছে মিতা?

খুট করে খুলে গেল অফিসের দরজা। উদয় হলো সৈকত। দুহাতে সুন্দর এক ট্রের ওপর রাখা চমৎকার ডিযাইনের দুটো মগ ও এক প্লেট অলিম্পিক নোনতা বিস্কিট।

রানা ও মিস্টার ব্রায়ানের সামনে কফির মগ ও বিস্কিটের প্লেট রেখে বিদায় নিল সৈকত।

হাতের ইশারায় কফি ও বিস্কিট দেখাল রানা।

মাথা দোলালেন ব্রায়ান। হাতে নিলেন না কফির মগ। ওই বিপদের নাম হুয়াং লি ল্যাং। মিতাকে মেক্সিকো থেকে তুলে নিয়ে গেছে ওই চাইনিজ বিলিয়নেয়ার। প্রয়োজন মিটে গেলেই খুন করবে। এদিকে হাত-পা বাঁধা আমার। কিছুই করতে পারব না। তাই এসেছি আপনার কাছে সহায়তা পাওয়ার আশায়।

মিতা এখন কোথায়? কড়া কফির মগ ঠোঁটে তুলে মৃদু চুমুক দিল রানা।

খোঁজ নিয়ে জেনেছি, ওকে আটকে রেখেছে হংকং-এ নিজের দুর্গের মত প্রকাণ্ড অফিস দালানে।

চুপ করে আছে রানা। কিছুক্ষণ পর বলল, মিতাকে চাইনিজ বিলিয়নেয়ারের খপ্পর থেকে ছুটিয়ে আনতে হলে, চাই যথেষ্ট প্রস্তুতি। লাগবে প্রয়োজনীয় টাকা, সেটা কি দেবে আমেরিকান সরকার?

মৃদু মাথা নাড়লেন জেমস ব্রায়ান। না, তা দেবে না।

তা হলে?

টাকা যা লাগে, সেটা,আমিই দেব।

কেন দেবেন?

কারণ মিতাকে নিজের মেয়ের মতই মনে করি আমি। ওর বাবা ছিলেন আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তা ছাড়া, মিতার কাছে আমি ঋণী। নিজের জীবন দিতেও দ্বিধা করব না।

কিছুক্ষণ ভেবে তারপর বলল রানা, এ ধরনের মিশনে গেলে খরচ হতে পারে লাখ লাখ ডলার।

জানি। সেজন্যে এরই ভেতর অফিসের ফাণ্ড থেকে আমার প্রাপ্য সমস্ত টাকা তুলে নিয়েছি। আপনি রাজি হলেই আপনার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে সব টাকা ট্রান্সফার করে দেব।

নীরবে বসে আছে রানা।

 মিস্টার রানা, বন্দি এক মেয়ের অসহায় বাবার অনুরোধ: দয়া করে মিতাকে ফিরিয়ে আনুন, মাথা নিচু করে নিজের দুহাত দেখছেন এনআরআই চিফ।

সিআইএ বা এনএসএর মতই শক্তিশালী সংস্থা এনআরআই, সেই সংগঠনের বড়কর্তা কাতর হয়ে সাহায্য চাইছেন, যেন চাইনিজ এক দানবের হাত থেকে রক্ষা করা হয় তার মেয়েকে।

নরম সুরে বলল রানা, আপনার এই কাজটা হাতে নেব কি না, তা আগামীকাল সকালে ফোনে জানিয়ে দেব।

অন্তত জানব, সাধ্যমত করেছি, চেয়ার ছাড়লেন জেমস ব্রায়ান। এতই চিন্তিত, ভুলে গেছেন কফি বা বিস্কিটের কথা।

ভদ্রতা করে চেয়ার ছাড়ল রানা। গুড বাই, স্যর।

একবার মৃদু মাথা দুলিয়ে অফিস ছেড়ে চলে গেলেন মিস্টার ব্রায়ান।

কয়েক সেকেণ্ড, পর এনক্রিপ্টেড ফোনের দিকে হাত বাড়াল রানা। জরুরি আলাপ করবে বিসিআই চিফ মেজর জেনারেল (অব.) রাহাত খানের সঙ্গে। বিড়বিড় করল রানা, খুকখুক করে কেশে নিয়ে ঠিক এই ভঙ্গিতে বলবে কট্টর বুড়ো: জরুরি কোনও কাজ নেই, ইচ্ছে করলে তুমি যেতে পারো। পরে আমাদের দেশের কাজে আসবে ওঁর মত দক্ষ একজন নিউক্লিয়ার ফিযিসিস্ট।

কানে রিসিভার ঠেকিয়ে ডায়াল করল রানা। বুকের মাঝে ধুপ-ধাপ লাফ দিচ্ছে অস্থির হৃৎপিণ্ড। আজও কেন যেন ভয় লাগে ওই কট্টর বুড়োর সঙ্গে কথা বলতে।

.

০৫.

 ঘুটঘুটে আঁধার চিরে আসছে চিৎকার: তুমি কী দেখছ?

ব্যথা! বিশ্রী দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে গেছে মিতা। চোখ মেলতে চাইল। থরথর করে কাঁপছে শরীর। খুব ঠাণ্ডা! পরক্ষণে নরকের মত গরম! শিরার মাঝ দিয়ে বইছে বিষের মত কিছু!

তীব্র আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে গেল ওর।

তুমি কী দেখছ? আবারও কর্কশ কণ্ঠে জানতে চাইল কেউ।

বনবন করে ঘুরছে মাথা, হাজার ফুট ওপর থেকে ভয়ানক কোনও নরকে পড়ছে মিতা! পতন ঠেকাতে হাত পেছনে নিয়ে ধরতে চাইল কিছু। কিন্তু কোনও হাতল বা পিঠ নেই এই চেয়ারে। আছে শুধু টেবিলের কিনারার মত কিছু।

সূর্যের মত আলো নিভে জ্বলে উঠল নরম বাতি। মিতার মুখের খুব কাছে এল একটা মুখ। ওই চেহারা চৈনিক। এত কাছে, তার দুই চোখ স্পষ্ট দেখল ও। দুহাতে ওকে ধরল লোকটা। কাঁপা, শীতল দুটো হাত। চোখ রাখল চোখে। যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে ওর আত্মা।

দুশ্চিন্তা কোরো না, হাসিমুখে বলল লোকটা, আমরা জানি, ব্রাযিলে যে আর্টিফ্যাক্ট খুঁজতে গিয়েছিলে, ওই একই জিনিস চাই তোমার। খেক-শেয়ালের মত কর্কশ হেসে পিছিয়ে গেল সে।

চলছে একটানা বিশ্রী হাসি। ভয় পেয়ে পিছু হটতেই টেবিল থেকে মেঝেতে পিছলে পড়ল মিতা। তাতে কয়েক মুহূর্তের জন্যে পরিষ্কার হলো মগজ। চোখ তুলে দেখল, ভীষণ কুশ্রী, বয়স্ক এক লোক মোটরাইড় এক হুইলচেয়ারে বসা। দৈহিক কোনও অদ্ভুত কম্পনের জন্যে মুচড়ে আছে। শরীর।

এত কষ্টের মাঝেও তার জন্যে মনে করুণা এল মিতার।

ওর ভাবনা বুঝে প্রচণ্ড রাগে বিকৃত হলো লোকটার মুখ। চিৎকার করে উঠল সে, ওকে নিয়ে যাও! এতবড় দুঃসাহস…আমাকে করুণা করে!

বিশালদেহী দুই চাইনিজ খপ করে ধরল মিতাকে, তুলে ধুপ করে ফেলল এগযামিনেশন টেবিলের ওপর। এল তৃতীয়জন, হাতে হাইপোডারমিক সিরিঞ্জ। সুই থেকে টপটপ করে পড়ছে সোনালি তরল!

না চেঁচিয়ে উঠল মিতা, ছুটে যেতে চাইল লোকদুজনের হাত থেকে। কিন্তু তাদের শক্তি অনেক বেশি, ঠেসে ধরে রাখল টেবিলের ওপর।

আবারও চোখ ঝলসে দিয়ে জ্বলে উঠল অত্যুজ্জ্বল আলো।

তখনই মিতার কাঁধের মাংসে বিঁধল সুঁই। এক সেকেণ্ড পর আঁধার হয়ে গেল চারপাশ।

.

ঘুম ভাঙতেই মিতা বুঝল, পড়ে আছে মেঝেতে। হৃৎপিণ্ড দাপিয়ে চলেছে ছুটন্ত ঘোড়ার মত। আগে দুঃস্বপ্ন দেখে জ্ঞান ফিরলে, আবারও ঘুম পাড়িয়ে দেয়া হয়েছে চেতনানাশক ওষুধ ব্যবহার করে। ওর জানা নেই, এভাবে কতবার অজ্ঞান হয়েছে। এখন ঝুলছে বাস্তব আর অবাস্তবের মাঝে। কোটা যে সত্যি, আর কোন্‌টা মিথ্যা, বোঝা দায়।

কিছুক্ষণ পর ধীরে ধীরে উঠে বসল মিতা।

চারদিকে সাদা দেয়াল। হালকা বাদামি রঙা আসবাবপত্র। একপাশে দামি ডেস্ক ও কয়েকটি আরামদায়ক চেয়ার। এ ঘর জানালাহীন। ঘড়ি, রেডিয়ো, টিভি বা কমপিউটার নেই। ওর মনে পড়ল, মস্ত এক হেলিকপ্টারে তুলেছিল ওকে। তখন অচেতন করে দেয় লোকগুলো। তারপর আর কিছুই মনে নেই।

এখন বুঝতে পারছে, ও কারও বন্দি।

ওই যে কুৎসিত লোকটা?

 সেই ওকে আটকে রেখেছে।

কেন, তা ওর জানা নেই।

 কত দিন আগে কিডন্যাপ করেছে ওকে?

হয়তো এক সপ্তাহ, বা এক মাস- কে জানে!

এরই মধ্যে হয়তো পেট থেকে বের করে নিয়েছে সব কথা!

মিতার মনে পড়ল মেক্সিকোর কথা। ঢালু জমিতে মোটা এক গাছের কাণ্ডে বাড়ি খেয়ে আটকে গিয়েছিল জর্জ হ্যারিসন।

আহা, বেচারা প্রফেসর!

তার কথা ভেবে খুব দমে গেল মিতার মন।

 বুড়ো মানুষটা চোখের সামনে মারা গেল।

ও কিছুই করতে পারল না!

ব্রাযিলের মায়ান সাইটের ওই স্কটিকটা থেকে আসে ঠাণ্ডা বিদ্যুৎ। আর্কিওলজিস্ট জর্জ হ্যারিসন মায়া আর্টিফ্যাক্ট থেকেই জেনেছিলেন, আরও আছে ওই জিনিস। এনআরআই বিজ্ঞানীরাও চেয়েছিলেন ওই বিষয় নিয়ে আরও গবেষণা করতে।

আর্কিওলজিস্ট জর্জ হ্যারিসন অনুরোধ করেন, তাই গুরুত্বপূর্ণ ওই মিশনের ব্যবস্থা করে দেন জেমস ব্রায়ান। চাইলে মানা করতে পারত ও। কিন্তু মন বলল, বিপদ এলেও সময়টা কাটবে দারুণ। তা ছাড়া, ভেবেছিল পাশে পাবে মাসুদ রানাকে। সেক্ষেত্রে আর কী চাই! মানুষটার সঙ্গ সত্যি খুব লোভনীয়!

কিন্তু প্রথমেই পড়ল বাধা।

এ অভিযানে পাওয়া গেল না ব্যস্ত রানাকে।

অমন স্ফটিক আরও খুঁজতে গিয়ে মস্ত ঝুঁকি নিল মিতা। এখন নিজেই হয়তো চিরকালের জন্যে হারিয়ে গেছে সভ্যজগৎ থেকে!

আনমনে বিড়বিড় করল মিতা, হায়, ঈশ্বর, কীভাবে এত বড় ভুল করলাম?

অসুস্থ লাগছে। মন চাইল আবারও শুয়ে পড়তে।

আহ্, কী ভালই না হতো চুপচাপ মৃত্যু এলে!

পরক্ষণে বিদ্রোহ করল ওর অন্তর- এত সহজেই হেরে যাবি?

বাবার কথা মনে পড়ল ওর। ক্যান্সারে চরমভাবে অসুস্থ মানুষ, কিন্তু কখনও হাল ছাড়েননি। ওই একই কথা খাটে আঙ্কেল ব্রায়ানের ক্ষেত্রে। তাঁদের বা মাসুদ রানার জীবন থেকে বহু কিছুই শেখার আছে ওর!

বিশেষ করে মনে পড়ছে মাসুদ রানার কথা। ব্রাযিলে মানুষটা ছিল বিশাল এক বটবৃক্ষের মত, আগলে রেখেছিল সব ঝড়-বৃষ্টি-ঝঞ্ঝা থেকে। সত্যিই যখন বিদায় নিয়ে চলে গেল, কেমন ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল ওর জীবন।

মিতা ভাবল: আজ যদি মানুষটা জানত, ও পড়ে আছে। এই নরকে, ঠিকই উদ্ধার করে নিয়ে যেত।

এসব ভাবতে গিয়ে একটু শান্ত হলো ওর মন। বুঝল, প্রথম কাজ এই বন্দিশালা থেকে মুক্ত হওয়া।

স্রেফ মনের জোরে দুর্বলতা কাটিয়ে উঠে দাঁড়াল মিতা।

পায়ের নিচে নরম কার্পেট। চলে গেল ও ঘরের আরেক পাশে। সতর্ক হাতে স্পর্শ করল দরজা। যা ভেবেছে, ওটা লক করা। এদিকে ইলেকট্রনিক কি-প্যাড। ওদিকে থাকবে কার্ড রিডার। ফিরে এসে একে একে ঘেঁটে দেখল ডেস্কের ড্রয়ার।

সব ফাঁকা।

শেষ ড্রয়ার ধুপ করে বন্ধ করে মেঝেতে বসল মিতা। নতুন করে বাড়ছে মাথা-ব্যথা। ছাতের ওই সাদা বাতি অতিরিক্ত উজ্জ্বল, অথবা সমস্যা হয়েছে ওর চোখে। ফোলা লাগছে নয়নতারা। বোধহয় ওকে দেয়া হয়েছে কড়া কোনও ড্রাগ। এ কারণেই দেখেছে ভয়ানক সব দুঃস্বপ্ন।

চোখ তুলে ডানবাহু দেখল মিতা। ওখানে সুইয়ের কমপক্ষে ছয়টা দাগ। ব্যথা হয়ে আছে জায়গাগুলোয়।

সোডিয়াম পেন্টোথাল বা স্কোপোলামিন, ভাবল মিতা।

 বারবিচুরেট ব্যবহার করে তৈরি হয় ওই দুই ওষুধ। অনেকে ভাবে, এসব সত্যিকারের টুথ সিরাম। সম্পূর্ণ ভুল চিন্তা। কাউকে ইঞ্জেক্ট করলে, তার মন চাইবে বকবক করতে। হয়তো মুখ ফস্কে বলবে বহু কথা। কিন্তু মনের কথা আদায় করতে হলে চাই হাই-ডোয, যেটা অত্যন্ত বিপজ্জনক। সেক্ষেত্রে সম্ভাবনা খুবই বেশি, চিরকালের জন্যে ঘুমিয়ে পড়বে মানুষটা।

ওই ওষুধই দিয়েছে, নইলে এত শুকনো লাম্বত না গলা, ফুলেও উঠত না চোখের তারা।

এবার কী করবে, ভাবছে মিতা। এমনসময় খুট করে খুলে গেল দরজা। ঘরে ঢুকল দুজন চাইনিজ লোক। শক্তপোক্ত দেহ, গায়ে ইস্ত্রি করা শার্ট, গলায় সিল্কের টাই, পরনে দামি সুট।

তাদের একজনকে নেতা বলে মনে হলো মিতার।

এগিয়ে এল সে, ডেস্কের ওপর ওর বুট রেখে বলল, পরে নাও। লোকটার ডান চোখের নিচে শুকনো ছোট ক্ষত।

ভাবতে গিয়ে মিতার মনে পড়ল, প্রথমবার অচেতন হওয়ার আগে ও-ই তৈরি করেছিল ওই ক্ষত।

বুট তুলে নিল মিতা। কোথায় যেতে হবে?

তোমাকে যেখানে নেব, সেখানে লাগবে বুট।

বক্তব্যটা সুবিধার ঠেকল না মিতার। তবে পরল ডান পায়ের বুট। ফিতা বাঁধতে বাঁধতে ভাবল, দ্বিতীয় পাটি ব্যবহার করবে অস্ত্র হিসেবে। পরক্ষণে বুঝল, এরা ঘায়েল হলেও এখান থেকে বেরিয়ে ও যাবে কোথায়? আসলে আছে ও কোন্ নরকে?

সুযোগ পাবে বড়জোর একবার!

হয়তো এ ঘর থেকে বেরোলেই সামনে পড়বে বিশ ফুট দূরে আরেকটা দরজা। কাজেই এখন উচিত হবে না কিছু করা।

দুপায়ে বুট পরতেই ঘর থেকে ওকে বের করল লোক দুজন। থামল একটা এলিভেটরের সামনে। বাটন টিপতেই খুলে গেল কবাট। ভেতরে ঢুকল ওরা। পকেট থেকে নিয়ে অন্যসব বাটনের নিচে অ্যাকসেস প্যানেলে চাবি ভরল দলনেতা। প্যানেলের সবচেয়ে নিচের বাটন টিপল। জ্বলে উঠল ইনডিকেটর বাতি। বন্ধ হলো এলিভেটরের দরজা। নামতে লাগল স্টিলের বাক্স।

চট করে মিতা দেখল, বাটন কতগুলো। নিচের তিন সারিতে সব মিলে বিশটা করে।

দ্রুত চলছে এলিভেটর। কানে ধাঁধা লাগতেই মিতা বুঝল, এটা এক্সপ্রেস লিটু। অর্থাৎ, ষাটতলার চেয়েও উঁচু এই ভবন। সব বাটন হিসেবে নিলে এই দালান হবে প্রায় এক শ তলা।

মহাচিনে কতগুলো বাড়ি এত উঁচু? ভাবল মিতা।

সংখ্যায় সেগুলো খুব বেশি নয়।

বিশেষ একটি বহুতল ভবনের কথা মনে পড়ল ওর।

 টাওয়ার ল্যাং।

ওটার মালিক হুয়াং লি ল্যাং। হংকঙের অত্যন্ত দামি ওই জায়গাটা ভিক্টোরিয়া হার্বারের মুখে।

ও, তা হলে আমি হংকঙে? ভাবল মিতা। কয়েক সেকেণ্ড পর বলল, আমেরিকান কনসুলেটের সঙ্গে কথা বলতে চাই।

চোখের তলের শুকনো ক্ষত বিরস সুরে বলল, এরই ভেতর অনেক বকবক করেছ, আর না।

গতি কমিয়ে থামল এলিভেটর। খুলে গেল দরজা।

সামনে যেমন দৃশ্য দেখবে ভেবেছে, তেমন কিছুই দেখতে পেল না মিতা। নেই, চওড়া প্যাসেজ। লোহার বাক্স নেমেছে প্রাচীন আমলের কালো পাথরের ছোট এক বদ্ধ করিডোরে। চারপাশে পচা আবর্জনা ও প্রস্রাবের বোটকা গন্ধ।

কোন্ নরকে এনেছেন? জানতে চাইল মিতা।

এলিভেটর থেকে নেমে পড়ল চোখের নিচে ক্ষতওয়ালা। এক হাতে তৈরি টেইযার। তীব্র বিদ্যুৎ প্রবাহের কারণে কাঁকড়াবিছের লেজের মত নড়ছে দুই দাঁড়া।

অনিচ্ছাসত্ত্বেও করিডোরে বেরোল মিতা।

প্রাকৃতিকভাবেই তৈরি পাথরের এই করিডোর। পরে ব্যবহার করেছে চুন-সুরকি। অনেকটা মেডেইভেল আমলের দুর্গের আঁধার ডানজনের মত ভেজা, স্যাঁতস্যাঁতে। ডানদিকে ভারী কাঠের দরজা। বহু বছর পানি লেগে পচে গেছে কজার কাছে। ছাত থেকে সরু কেবল-এ ঝুলছে স্বল্প ওয়াটের ন্যাংটো বালব। ওই দুর্বল আলোয় চারপাশ দেখা প্রায় অসম্ভব।

লোহার পুরু শিক দিয়ে তৈরি এক দরজার সামনে থামল ওরা। পরক্ষণে কিছু বোঝার আগেই কবাট খুলে পেছন থেকে ঠেলে দেয়া হলো মিতাকে। সামান্য উঁচু চৌকাঠে পা বেধে হুড়মুড় করে মেঝেতে পড়ল ও। রুক্ষ পাথরে লেগে ছড়ে গেল দুহাত।

ব্যথা অগ্রাহ্য করে মেঝে ছেড়ে উঠেই দরজার কাছে ফিরল মিতা। কিন্তু ওর মুখের ওপর ধুম্ করে বন্ধ হলো লোহার কবাট।

আপনারা কেন এসব করছেন? অসহায় সুরে জানতে চাইল মিতা। কী চান আপনারা আমার কাছে?

কিছুই না, বলল শুকনো ক্ষত।

চারপাশের আঁধারে চোখ বোলাল মিতা। শুনল কয়েক ধরনের আওয়াজ। নড়ছে কারা? ঘড়-ঘড় শব্দে শ্বাস নিচ্ছে কিছু! গুঙিয়ে উঠল কেউ!

মিতার মনে হলো, ওর আগমনে ঘুম ভেঙে জেগে উঠেছে বিশ্রামরত ভয়ঙ্কর কোনও হিংস্র জানোয়ার!

হঠাৎ করেই বেড়ে গেল বিশ্রী দুর্গন্ধ!

এটা কোথায়? ভীত স্বরে জিজ্ঞেস করল মিতা।

নিভল করিডোরের বাতি। দুই চাইনিজ উঠেছে এলিভেটরে। বুজে যাচ্ছে দরজা, পুরো বন্ধ হওয়ার আগেই একজন বলল: এখন থেকে এটাই তোমার বাড়ি!

.

০৬.

শক্ত মেঝেতে পাতলা চাদরের ওপর চুপ করে শুয়ে আছেন প্রফেসর জর্জ হ্যারিসন, চোখ সোজা খড়ের হলদেটে ছাতে। মাউন্ট পুলিমাণ্ডো থেকে প্রায় বয়ে নিজেদের চিয়াপাস ইণ্ডিয়ান গ্রামে তাকে এনেছে পিকো। তাতে লেগেছে কয়েক দিন। প্রতিদিন আগের চেয়েও দুর্বল হয়েছেন ডক্টর। বুলেটের ক্ষতে ধরে গেছে ইনফেকশন। ওই বিপদ কম নয়, তার ওপর তার ঘাড়ে চেপে বসেছে গ্রামের বদমাশ এক ওঝা। ওই থুথুড়ে বুড়োর স্থির বিশ্বাস, দারুণ কোনও জাদু দিয়ে সুস্থ করবে কালো লোকটাকে।

দুর্গন্ধময় ওই ব্যাটা খুন করবে বুঝেই, ডক্টর হ্যারিসন পিকোকে বলেছেন, সত্যিকারের ডাক্তার ডেকে আনতে। এখন চাই অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ। এ কথা মনে গেঁথে যেতে কাছের শহরের উদ্দেশে রওনা হয়েছে পিকো। কিন্তু ওদের গ্রাম এতই দুর্গম, কাছের জনপদ ঘুরে আবার ফিরে আসতে লাগবে তিন থেকে চার দিন।

ততদিন বাঁচবেন কি না, এ নিয়ে গভীর সন্দেহে আছেন প্রফেসর। গ্রামের মোড়ল গভীর শ্রদ্ধা রাখে ওই শয়তান বুড়োর ওপর। তাই নিজ বাড়ি থেকে হ্যারিসনকে পাচার করে দিয়েছে ওই ব্যাটার বাড়িতে। এখন যা খুশি করতে পারে সে!

হ্যারিসনের বামপাশে কড়মড় আওয়াজে পুড়ছে চ্যালা কাঠ। চাইলেও দেখতে পাবেন না ওদিকটা। গুলি খেয়ে নিচের ওই গাছে গিয়ে বাড়ি খাওয়ার পর থেকেই মেরুদণ্ড যেন লোহার শিক। আড়ষ্ট হয়ে গেছে দেহ। একটু নড়লেই এমন খচ্‌ করে লাগছে, মনে হচ্ছে ছিঁড়ে পড়ছে পেশি।

বামহাত নিচে নিয়ে আস্তে করে উরুর ক্ষত স্পর্শ করলেন হ্যারিসন। ফুলে আছে গর্তের চারপাশ। তবুও বলতে হবে, কপাল ভাল, সরাসরি মাংস ভেদ করে বেরিয়ে গেছে বুলেট।

দেবতার ওই দ্বীপেই অ্যান্টিসেপটিক মলম মেখে ক্ষত ব্যাণ্ডেজ করেছেন, তবুও ধরে বসল ইনফেকশন। পা যে শুধু ফুলে গেছে তা নয়, জ্বরও এসেছে। হাত ফিরিয়ে এনে কোলে রাখলেন হ্যারিসন। ঘামছেন দরদর করে। কপাল থেকে চোখে পড়ল একফোঁটা লোনা জল। মাথা ঝেড়ে ওটা ফেলে দিলেন চোখ থেকে।

মন খারাপ লাগছে তাঁর। তিনিই বারোটা বাজিয়ে দিয়েছেন নিজের। একরাতে স্টাডিতে বসে পড়ছিলেন ব্রাযিল থেকে সংগ্রহ করা মায়ান প্রাচীন গ্লিফ। তখনই চোখে পড়ল; মায়ানদের লিখিত বক্তব্য। ওদের ছিল নিজস্ব গার্ডেন অভ এডেন টুলান যুইয়োয়া। বুঝলেন, আরও আছে অমন বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী স্ফটিক। প্রথমটার নাম: যিপাকনার হৃদয়। কল্পকাহিনির মায়ান এক ভয়ানক জন্তু যিপাকনা। পরের তিনটে হচ্ছে: মন উৎসর্গের আয়না, দূর সাগরের আত্ম উৎসর্গের আয়না, আর শেষেরটা দেহ উৎসর্গের আয়না।

কিন্তু কোথায় আছে ওই তিনটে স্ফটিক পাথর?

নিজের সব নোট ও ছবি ঘাটতে শুরু করে জানলেন, বহু দূরে নেয়া হয়েছিল ওই চার পাথর। একটা ছিল ব্রাযিলে, অন্য দুটো শত মাইল দূরে, আর শেষেরটা সাগর পাড়ি দিয়ে রাখা হয়েছিল অন্য কোথাও। যেসব চিহ্ন ছিল, সেগুলোকে আর যাই হোক, মানচিত্র বলা যাবে না। তবে তিনি নানান হিসেব কষে বুঝলেন, দুটো পাথর গেছে উত্তরে ইউক্যাটানের দিকে। অন্যটা উত্তর চিন বা দক্ষিণ সাইবেরিয়ায়। এ-ও ঠিক, স্রেফ শখে করা হয়নি ওই কঠিন কাজ। জরুরি উদ্দেশ্য ছিল প্রাচীন আমলের মানুষগুলোর।

বিষয়টা বুঝে সরাসরি যোগাযোগ করলেন এনআরআই এর চিফ জেমস ব্রায়ানের সঙ্গে। ওটা অনুচিত ছিল, আরও মন্দ কাজ করেছেন মিষ্টি মেয়ে মিতাকে এসবে জড়িয়ে।

অবশ্য, এখন বুঝতে পারছেন, তাঁর ধারণা ভুল নয়। ওসব আয়না বা পাথর ব্যবহার হতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কোনও কাজে। নইলে কেন তাদেরকে মেরে ফেলতে চাইল একদল লোক? কারা তারা? অন্য কোনও দেশের স্পাই?

হ্যারিসন নিজেকে চেনেন, তাই আনমনে বললেন: যতবড় বিপদই হোক, একবার সুস্থ হলেই আবারও খুঁজব ওই স্ফটিক।

কে যেন ঢুকেছে কুঁড়েঘরে।

ঘাড় কাত করে দেখতে চাইলেন হ্যারিসন। পিকো? এলে?

জবাব দিল ফিসফিসে এক কণ্ঠ: পিকো এক্সিহুয়া থেকে ফেরেনি।

এবার তরুণকে দেখলেন প্রফেসর। সে ইংরেজি জানে। তাঁর আর ওঝার কথা চালাচালি করে।

ছেলেটার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে হাস্যকর, বিদঘুটে পোশাক পরা বুড়ো ওঝা। মাথায় পাখির পালকের মুকুট। কণ্ঠে মরা মানুষের হাতের হাড়। কোমরে পাতার তৈরি কৌপীন।

কখন ফিরবে পিকো? জানতে চাইলেন হ্যারিসন।

হয়তো ফিরবে আগামীকাল বা তার পরের দিন, বলল দোভাষী, কিন্তু সেজন্যে অপেক্ষা করতে পারব না আমরা। বিষ ছড়িয়ে পড়ছে রক্তে।

মাথা কাত করে ওঝার জড় করা জিনিসপত্র দেখতে চাইলেন প্রফেসর। ওঝা কী করতে চান?

উনি বলছেন, তিনি জেনে গেছেন কেন আপনি অসুস্থ, জানাল দোভাষী।

আমি অসুস্থ, কারণ গুলি লেগেছে পায়ে, বিরক্ত হয়ে বললেন হ্যারিসন। ইনফেকশন হয়েছে।

দোভাষী জানাতেই বিশ টাকার রসগোল্লার মত ফোলা, সর্দিঝরা নাক নেড়ে প্রবল বেগে মাথা নাড়ল ওঝা। অন্য কারণে রোগ হয়েছে হ্যারিসনের। ঝড়ের বেগে বলল কী যেন।

আপনার অন্য কিছু হয়েছে, বলল তরুণ দোভাষী, আপনি জানেনও না জীবনে আসলে কী চান। ওসব জানেন ওঝা। ভয় নেই আপনার, যা চান, সেটা এনে দেবেন তিনি। বুক থেকে দূর হবে ভয়। ওঝা বলেছেন, আপনার আত্মা লড়ছে সত্যের বিরুদ্ধে।

আমি মরেছি, বিড়বিড় করলেন ডক্টর হ্যারিসন। সুস্থ থাকলে দুনিয়ার এপার আর ওপার নিয়ে ওঝার সঙ্গে আলাপ জুড়তেন, এখন আস্তে করে নামিয়ে নিলেন মাথা। মুখ তুলে কথা বলতে গিয়ে ঘাড়ে এমনই ব্যথা, মনে হচ্ছে আপাতত মাথাটা খুলে ঝুলিয়ে রাখা উচিত শিকেয়। বুড়োটা মেরে ফেলবে, কিন্তু কিছুই করতে পারব না, খুব দুঃখ নিয়ে বিশাল এক দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি।

পাশে বসে প্রফেসরের মুখে ফুঁ দিল ওঝা।

তার দাঁতের ফাঁকে জমা পচা মাংসের ভয়ানক দুর্গন্ধে নাক কুঁচকে ফেললেন হ্যারিসন।

চিৎকার করে একনাগাড়ে কী যেন বলে চলেছে নোংরা বুড়ো।

আপনার বিষাক্ত রক্তই ডেকে এনেছে খারাপ আত্মা, বলল দোভাষী। আর তাই ঘুমের ভেতর আসছে সে। বাজে সব স্বপ্ন দেখাচ্ছে। কিন্তু এবার রক্ষে নেই তার। সহজ লোক নন সর্বজ্ঞানী ওঝা বামা হাগুড়ি। ওই মন্দ আত্মাকে তাড়া দিয়ে পাঠিয়ে দেবেন অন্য জগতে। তখন ঠিকই কাজ করবে তাঁর ওষুধ।

কচমচ শব্দ পেলেন হ্যারিসন। উস্কে দেয়া হয়েছে আগুন। গালে লাগছে তাপ। বিড়বিড় করে কীসব বকতে শুরু করেছে হারামি ওঝা। তার পাশেই বসে কী যেন গুঁড়ো করছে ছোকরা। ঢেলে দিল একটা কাপে। এবার যোগ করল ছাগলের দুধ। তিন সেকেণ্ড পর ঘাড় ধরে তুলে হ্যারিসনের মুখে ঢেলে দেয়া হলো ওই তরল!

জিনিসটা এতই তিতা, হ্যারিসন এত অসুস্থ না থাকলে এক লাফে ছাত ফুড়ে পৌঁছে যেতেন সপ্ত আসমানে। গলা দিয়ে বেরোল শুধু গোঙানি। পাঁচ সেকেণ্ড পর কেমন নেশা নেশা লাগল তার। হঠাৎ ঝাপসা হয়ে গেল ঘরের সব কিছু।

কানের কাছে গুনগুন করছে ওঝা। পাতার পাখা দুলিয়ে গনগনে করে তুলছে আগুন। প্রফেসরের মনে হলো, বনবন করে ঘুরছে গোটা ঘর। ভারী হয়ে উঠল তার মাথা। দূর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে ওঝার কণ্ঠস্বর। অচেনা কোথাও থেকে আসছে দোভাষীর দুর্বল স্বর। হঠাৎ শুনলেন আরেকজনের কণ্ঠ।

পিকো? আশা নিয়ে ডাকলেন হ্যারিসন।

না! পিকো নয়, এ তো মহিলা কণ্ঠ!

কথা বলছে খুব ফিসফিস করে!

ডক্টর হ্যারিসনের চোখের সামনে বারকয়েক হাত দোলাল ওঝা। সারামুখে পড়ল কীসের মিহি গুঁড়ো। আগুনের আভায় ঝিকমিক করছে। তারই মাঝে প্রফেসর দেখলেন একটা মুখ। ওদিকে মন দিতে চাইলেন।

কিন্তু হাত নেড়ে গুঁড়ো সরিয়ে দিল ওঝা।

ক-কী দিয়েছেন আমাকে? ক্ষীণ, স্বরে বললেন হ্যারিসন।

জবাব দিল তরুণ দোভাষী, ওই জিনিস ঠাণ্ডা করে দেবে কালো জগতের আত্মাটাকে। আর বিরক্ত করতে পারবে না আপনাকে।

কিছুতেই কিছু যায়-আসে না, মনে হলো হ্যারিসনের। টের পেলেন, কমে গেছে উরুর ব্যথা। ভাবলেন, পৃথিবী ছেড়ে যাচ্ছেন বহু দূরে কোথাও। মনে পড়ল প্রিয় স্ত্রীর কথা। কয়েক বছর আগে মাত্র তিন দিনের জ্বরে মৃত্যুবরণ করেন উনি। সবসময় ভরসা দিতেন বিপদে। আগলে রাখতেন স্বামী ও সন্তানকে। নিজে অসুস্থ, তবুও উল্টে সান্তনা দিয়েছিলেন হ্যারিসনকে চিন্তা কোরো না, আমি না থাকলেও সবই ঠিকভাবে চলবে।

তুমি কোথায়, হান্না? বিড়বিড় করলেন প্রফেসর। আমি তোমাকে খুঁজে বের করব!

তাঁর নাকের ডগায় পাখির পালক নাড়ছে ওঝা শালা! ভীষণ হাঁচি আসতেই মস্ত হাঁ মেললেন প্রফেসর। কিন্তু খপ করে মুখ চেপে ধরল ওঝা। হাঁচির চাপা কয়েকটা বিস্ফোরণের পর নেতিয়ে গেলেন ডক্টর।

ঝুঁকে তাঁর চোখ দেখছে ওঝা। দাউদাউ করে জ্বলা আগুনে ফুঁ দিয়ে তুলছে কালচে ধোঁয়া। হাতে কী যেন দেখলেন হ্যারিসন। ওঝাকে ভেদ করে তার চোখ গেল বহু দূরে। দেখলেন স্ত্রীকে। শুনলেন রিনিঝিনি কণ্ঠ: না, আমার কাছে এসো না, আমাকে নিয়ে যাও তোমার কাছে!

স্ত্রীকে কাছে টেনে নিতে দুহাত তুললেন হ্যারিসন, আর তখনই আগুনের মাঝ থেকে টকটকে লাল লোহার শিক তুলে তার ক্ষতে চেপে ধরল ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর ওঝা!

করুণ এক বিকট আর্তচিৎকার ছাড়লেন প্রফেসর, তারপর একবার দাপড়ে উঠেই অচেতন হয়ে গেলেন!

.

০৭.

 মাঝরাত। মেঘভরা আকাশে থেকে থেকে উঁকি দিচ্ছে একটা দুটো নক্ষত্র।

হংকং থেকে তিন মাইল পুবে ল্যান্ট্যাউ দ্বীপের চেপ ল্যাপ কোক এয়ারপোর্টে নামল এয়ারবাস এ-থ্রিএইটি কার্গো বিমান।

দেরি না করে কার্গো আনলোডে ব্যস্ত হয়ে উঠল কুরা। তাদের একজন বোধহয় সুপারভাইযার। হাত লাগাল না কাজে।

মালামাল নামিয়ে উজ্জ্বল বাতি ভরা প্যাসেঞ্জার টার্মিনালের দিকে গেল বিমান। তবে নতুন করে এয়ারক্রাফটে ওঠেনি ওই সুপারভাইযার। বিশাল এক ওয়্যারহাউসের র‍্যাম্পের পাশে থামল সে।

এনআরআই চিফের মোটা অঙ্কের ঘুষ পেয়েছে রাতের ফোরম্যান ও কাস্টমস অফিসার। আগেই ঠিক করা আছে, কীভাবে গোপনে এয়ারপোর্ট থেকে বেরোবে মাসুদ রানা।

ওর জন্যে অপেক্ষা করছিল ফোরম্যান। চট করে লুকিয়ে ফেলল ওকে ওয়্যারহাউসে। একটু পর এল কাস্টম্স্ অফিসার। রানার জন্যে এনেছে ট্র্যাভেল পেপার্স ও পাসপোের্ট। আগেই এনআরআই এজেন্ট রেখে গেছে রানার উপযুক্ত পোশাক।

আধঘণ্টা পেরোবার আগেই দ্বিতীয় শিফটের ক্রুদের সঙ্গে এয়ারপোর্ট ছাড়ল রানা, অন্যদের মতই উঠে পড়ল হংকংগামী বাসে। কথা হয়েছে, চালক ওকে নামিয়ে দেবে শহরের মাঝে।

রাত দুটোয় হংকঙের সেন্ট্রাল ডিস্ট্রিক্ট-এ পৌঁছুল বাস। চারপাশে সাদা ও হলদে স্কাইস্ক্র্যাপার। ঝলমল করছে কোটি বাতি। বিশেষ করে চোখে পড়ছে কমলা হ্যালোজেন বালব। নিচু মেঘে গুঁতো খেয়ে ফিরছে অত্যুজ্জ্বল আভা। এত রাতেও পুরো নির্জন নয় রাস্তা। বরাবরের মতই এবারও রানা টের পেল মস্ত এ শহরের ব্যস্ততা, চাপা এক গুনগুন আওয়াজ।

অনেকে ভেবেছিল কমিউনিস্ট চিন হংকং ফিরে পেলে হারিয়ে যাবে ঝাঁ-চকচকে শহর। তখন এখান থেকে সরিয়ে অন্য দেশে টাকা নিয়েছে বড় ব্যবসায়ীদের অনেকে। কিন্তু কিছু দিন পর টের পেল, কিছুই বদলে যায়নি হংকঙের। শুধু তাই নয়, এ শহরের ছোঁয়া লেগেছে গোটা চিনে। আধুনিক হয়ে উঠছে এ দেশের অন্য সব বড় শহর।

চিনা কমিউনিস্ট সরকার সৃষ্টি করেছে প্রচণ্ড ক্ষমতাশালী একদল ব্যবসায়ী। আর তাদেরই সেরা বিলিয়নেয়ার হুয়াং লি ল্যাং। তার সম্বন্ধে ফু-চুঙের সঙ্গে আলাপ করেছে রানা। মিথ্যা আশ্বাস দেয়নি ওর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সতর্ক করেছে ওকে। পারতপক্ষে ওই লোককে ঘাঁটাতে যাবে না চিনা ইণ্টেলিজেন্স। মহাচিন সরকার আঙুল না নাড়লেও ওই লোকের ব্যক্তিগত আর্মিই যথেষ্ট, ওদের বসের বিরুদ্ধে কিছু করতে গেলে ভয়ানক বিপদে পড়বে যে-কেউ।

বাস থামতেই কাঁধে ব্যাগ তুলে নেমে পড়ল রানা, ঢুকল ফুটপাথের পাশে ছোট এক খাবারের দোকানে। ক্যান্টোনেজ চিকেন ও এক কাপ সবুজ চা সাবাড় করে বেরিয়ে এল পাঁচ মিনিট পর। হাঁটতে শুরু করে পৌঁছুল পেনিনসুলা হোটেল এ। পাসপোর্ট অনুযায়ী ওর নাম মিস্টার টেলি রিগ্যান। ষোলোতলায় ভাড়া করা হয়েছে সিঙ্গল কামরা।

কাউন্টারে ক্লার্কের কাছে জিজ্ঞেস করল রানা, আমার কোনও মেসেজ এসেছে?

জী, রানার হাতে সাদা একটা এনভেলপ দিল যুবতী।

কামরার চাবি সংগ্রহ করে একটু সরে এসে খাম খুলল। রানা। ভেতরের কাগজে কারও নাম নেই। শুধু চারটে শব্দ: উপভোগ করুন মোপেড ভ্রমণ।

খাম ও কাগজ পকেটে রেখে লিফটে চেপে ষোলোতলায় উঠল রানা, তালা খুলে ঢুকে পড়ল নিজের কামরায়।

বিছানায় বসে ব্যাগ থেকে বের করল জেমস ব্রায়ানের দেয়া ল্যাপটপ কমপিউটার। যন্ত্রটা চালু করে ঢুকল ইন্টারনেট-এ। ব্যবহার করল বিশেষ এনক্রিপশন করা প্রোগ্রাম। কানেকশন সিকিয়োর হওয়ার পর দেখল কোনও মেসেজ এসেছে কি না। তেমন কিছু নেই। ট্যাপ করল রানা নিজের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে।

সিকিউরিটি প্রোটোকল শেষ হলে দেখল, জেমস ব্রায়ানের কাছ থেকে ওর অ্যাকাউন্টে ক্রেডিট করা হয়েছে পুরো দুই মিলিয়ন ডলার। সারাজীবনের সঞ্চয় ভদ্রলোক তুলে দিয়েছেন ওর হাতে। বদলে চেয়েছেন, যেন আমেরিকায় নিরাপদে পৌঁছে দেয়া হয় মিতাকে।

মৃদু হাসল রানা।

মিতা প্রিয় বান্ধবী। ওর বিপদ হয়েছে জানলে নিজে থেকেই এ দেশে ছুটে আসত ও, সেজন্যে প্রয়োজন হতো না কারও টাকা। ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ও প্রোগ্রাম থেকে লগ আউট শেষে ব্রাউয়ার বন্ধ করে ল্যাপটপ শাটডাউন করল ও।

একবার দেখল হোটেলের ডেস্ক থেকে পাওয়া এনভেলপ, তারপর চোখ রাখল কাগজের ওই চারটে শব্দের ওপর। উঠে চলে গেল পিকচার উইণ্ডোর সামনে। কাঁচে নাক ঠেকিয়ে দেখল নিচে। রাস্তার ওদিকে একটু দূরে মোপেড ভাড়ার দোকান। কন্ট্যাক্টের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হলে ভোরে যেতে হবে ওকে ওখানেই।

.

০৮.

 বদবু ভরা আঁধারে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে মিতা। নড়াচড়া করছে কী যেন। এগিয়ে আসছে ওর দিকে। আত্মরক্ষার জন্যে সতর্ক হয়ে পযিশন নিল মিতা। হামলা ঠেকাবে। গলা উঁচু করে জানতে চাইল: কে? নিজের পরিচয় দাও!

নিচু স্বরে বলল এক লোক, বিশ্রামের সময় বিরক্ত করছ। নিজেই বরং চেহারা দেখাও!

ঘরের এক পাশে জ্বলছে তেলের একটা প্রদীপ। আবছা ওই আলোয় কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তবে চোখ সয়ে আসতে মিতা দেখল, ওর দিকে পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে বয়স্ক এক লোক। গাল ভরা দাড়ি, মুখ ঢাকা পড়েছে ঝোঁপের মত গোঁফে। ঘরের মেঝেতে নোংরা কাঁথা পেতে শুয়ে আছে বেশ কয়েকজন। মিতার মনে হলো, তারা ঘুমন্ত। পেছনে পাথরের দেয়াল। একসময়ে এই ঘরের মাঝে ছিল লোহার একসারি শিক। দুভাগে ভাগ করা হয়েছিল এই জেলখানা।

এটা কি জেল?

বয়স্ক লোকটা বলল, হ্যাঁ, ফাটক। কোনও আদালত শাস্তি দেয়নি আমাদের, তবুও বাকি জীবন থাকতে হবে এখানে। ধরে নাও, নরকে পৌঁছে গেছ, মেয়ে। এর চেয়ে খারাপ জায়গা নেই।

ভারী গলায় ধমক দিল কে যেন, চোপ, বুড়ো শালা!

ঘরের এক পাশে আরেক বন্দিকে দেখল মিতা।

সে যুবক। আকারে প্রকাণ্ড।

আগ্রহ নিয়ে মিতাকে দেখছে সে। জিভ বের করে লোভীর মত ঠোঁট চাটল।

শিউরে উঠল মিতা। বুঝে গেছে, সুযোগ পেলে ওর বারোটা বাজাবে ওই লোক।

কে তুমি? মন শক্ত করে কড়া সুরে জানতে চাইল ও। বয়স্ক মানুষটাকে ধমক দিচ্ছ কেন? তোমার খায় না পরে?

মনে হলো, ওর কথায় অপমানিত হয়েছে বিশালদেহী যুবক।

মিতা বুঝে গেল, এই কারাগারে সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে হলে দাপট দেখাতে হবে। বুঝিয়ে দিতে হবে, কম যায় না ও-ও।

কাঁথা ছুঁড়ে ফেলে উঠে দাঁড়াল যুবক। মিতার চেয়ে অন্তত দেড় ফুট লম্বা সে। ওজনে কমপক্ষে এক শ বিশ পাউণ্ড বেশি। অন্য বন্দিদের তুলনায় বেশি খাবার পায়। মিতা বুঝে গেল, শক্তি খাঁটিয়ে অন্যদের খাবার কেড়ে নেয় এই লোক। নারকীয় এই খাঁচার ইঁদুরগুলোর রাজা সে।

মিস্টার লৌ নামে ডাকবে, গম্ভীর কণ্ঠে জানিয়ে দিল যুবক। এখানে থাকবে বহু বছর। কাজেই বুঝে নাও কী করতে পারবে, আর কী পারবে না। আমার কথার বাইরে গেলে রক্ষা নেই।

এগোতে শুরু করেছে লৌ।

আত্মরক্ষার জন্যে তৈরি হয়ে গেল মিতা।

প্লিয, থামো! বলল বুড়ো, এখন মারামারি কোরো না। দূরের দেয়ালে আঙুল তাক করল সে। ওখানে সরু ফাটল। একসময় ছিল গানপোর্ট। একটু আগেও ওদিক ছিল কালো, এখন ওখানে মৃদু আবছা ধূসর আলো। ভোর হচ্ছে।

একটু পর আসবে, আবারও বলল লোকটা, এখন মারপিট শুরু করলে কাউকে খাবার দেবে না ওরা।

ঘুরে বুড়ো মানুষটাকে দেখল মিতা। গায়ে মাংস নেই, বেরিয়ে গেছে বেচারার পাজরের হাড়। অগ্রসরমাণ লৌ-র দিকে চোখ রেখে পাথরের বাঙ্কের দিকে পিছিয়ে গেল ও।

মেঝেতে বসে পড়ল লৌ, ঘুমন্ত এক লোককে ডেকে তুলে দেখাল মিতাকে। ওই মেয়ে বাড়াবাড়ি করছে।

চুপচাপ মাথা দোলাল তার চেলা।

পেরোল থমথমে কয়েক মিনিট, তারপর সরু ফাটল দিয়ে এল সূর্যের সোনালি আলো।

জেগে উঠছে কারাগারের অন্য বন্দিরা।

মিতা দেখল, ওরা এই ঘরে আছে মোট সাতজন। বুড়ো, লৌ, তার বন্ধু, সর্বক্ষণ চোখ নামিয়ে রাখা ভারতীয় এক মহিলা, ইউরোপিয়ান এক প্রৌঢ়, চার-পাঁচ বছরের এক ছেলে আর ও নিজে।

ছেলেটার পাশের প্রৌঢ় খাটো। অবশ্য চওড়া কাঁধ। মনে হলো অসুস্থ। কথা ছেড়ে উঠে বসল না। কয়েক সেকেণ্ড দেখার পর মিতার মনে হলো, ওই লোক মৃত্যুপথযাত্রী।

.

০৯.

 মোপেড ভাড়া দেয়ার দোকানের সামনে লাইনে দাঁড়িয়ে চারপাশ দেখছে মাসুদ রানা। আকাশছোঁয়া সব দালানের ফাঁক দিয়ে রাস্তায় পড়েছে সূর্যের লালচে রোদ। এরই ভেতর শুরু হয়ে গেছে সকালের হুড়োহুড়ি। নানাদিকে ছুটছে গাড়ি, বাস ও ট্রাক। গাড়িঘোড়ার মাঝ দিয়ে পথ করে নিচ্ছে পথচারী ও শত সাইকেল আরোহী। বাঁক নিয়ে পরের জ্যামে গিয়ে থামছে ডাবল-ডেকার বাস। বোধহয় ঝট করে লেন বদল করতে ওগুলোর ড্রাইভারদেরকে বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়েছে ফর্মুলা ওয়ান কর্তৃপক্ষ থেকে। সর্বক্ষণ চলছে হর্নের প্যাঁ-পোঁ-ভ্যাঁ! পথচারী এড়াতে গিয়ে ইন্টারসেকশনে কর্কশ শব্দে ব্রেক কষছে গাড়ি।

গোলমেলে এই পরিবেশে মোপেড নিয়ে রাস্তায় নামা সহজ কথা নয়। ব্যাপারটা প্রায় শত শত গরুর স্ট্যাম্পিডের সময় ছাতি হাতে তেড়ে যাওয়ার মত। তবুও মোপেড ভাড়া দেয়ার দোকানের সামনে চাইনিজ ও বিদেশির দীর্ঘ লাইন। সবারই চাই হালকা বাহন।

লাইনে দাঁড়ানো কাস্টোমারদের ওপর চোখ পড়তেই রানাকে দেখল ক্লার্ক। হাতের ইশারা করে ডাকল, কাম কাম, স্যল! আপনার বাইক লেডি।

লাইন থেকে বেরিয়ে এল এভারেস্ট বিজয়ী রানা। হিংসা নিয়ে ওকে দেখছে সবাই। ক্লার্কের পিছু নিয়ে দোকানের অন্দরমহলের দিকে পা বাড়াল ও। একটু বিস্মিত, কোনও মোপেড চায়নি। এই লোক ওকে চিনে ফেলেছে, কারণটা বোধহয় এনআরআই চিফ জেমস ব্রায়ান। ছবি দেখানো হয়েছে ওর।

কাম-কাম, স্যল!

দোকানের একেবারে শেষাংশে পৌঁছে রানা দেখল, সামনের দরজা পেরোলেই সারি দিয়ে রাখা অন্তত চল্লিশটা ধচা মোপেড।

দরজার ওদিকে যেতেই দেখল চার চাইনিজ লোককে। তবে দুঃখের কথা, তাদের হাতে সাবমেশিন গান! মাযল ওর বুকেই তাক করা!

মাই গত, মাই গত! মাথার ওপর দুহাত তুলল ক্লার্ক। ভালই অভিনয়। পরে কেউ বলতে পারবে না সে-ই ফাঁসিয়ে দিয়েছে রানাকৈ। চরকির মত ঘুরেই আবারও ঢুকে পড়ল দোকানের ভেতরে। তাকে আর দেখা গেল না।

এ ধরনের বিপদের জন্যে তৈরি ছিল না রানা।

চার চাইনিজের একজন হাতের ইশারা করল ওকে। বসতে হবে পাশের ওই ওঅর্ক বেঞ্চে। পেছন থেকে ওর কাঁধে চাপ দেয়ায় বেঞ্চে বসল রানা। এক পাশ থেকে এল এক চাইনিজ, তন্নতন্ন করে সার্চ করল ওর দেহ।

অস্বাভাবিক কিছুই পেল না। চুপ করে বসে আছে রানা। ভাবছে, শুধু যে হুয়াং লি ল্যাং-এর লোকদের ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে, তা নয়, আর কোনও দলও নেমেছে অন্য কোনও উদ্দেশ্যে। অবশ্য এরা হতে পারে সিক্রেট পুলিশ বা মিনিস্ট্রি ফর স্টেট সিকিউরিটির সদস্য। শেষের ওই সংগঠন এফবিআই-এর মতই। তবে এরা এত তাড়াতাড়ি ওকে খুঁজে নেয়ায় বেশ বিস্মিত রানা।

এখন কথা হচ্ছে, ওকে টার্গেট করল কেন?

এখনও কিছুই করেনি ও!

পাসপোর্ট নিয়ে দেয়া হলো পেছনের লোকটার হাতে। পাতা ওল্টাবার খসখস শব্দ শুনল রানা। কয়েক সেকেণ্ড পর বলে উঠল পেছনের লোকটা, তো কেন হংকঙে এসেছেন, মিস্টার… টেলি রিগ্যান?

ব্যবসার কাজে, বলল রানা। তবে তার আগে ঘুরে দেখব দর্শনীয় জায়গাগুলো।

পেছনের লোকটা বলল, বিপদ আপনাকে খুব কাছে টানে, তাই না, মিস্টার রিগ্যান? ব্যবসায়ীরা কখনও মোপেড ভাড়া করে না। তাদের লাগে গাড়ি।

ওঅর্ক বেঞ্চে থপ করে ফেলা হলো পাসপোর্ট। চোখের কোণে একটা বুট সামনে বাড়তে দেখল রানা। মাথার পেছনে টেনে নেয়া হলো আগ্নেয়াস্ত্রের স্লাইড। এবার বোধহয় গুলি করে ফুটো করবে ওর মাথা!

পেছন থেকে বলল লোকটা, তো এবার কী ধরনের বিপদে পড়তে চান?

জবাব দিল না রানা, লড়তে তৈরি। চেষ্টা করবে আত্মরক্ষা করতে, কিন্তু থমকে গেল অন্য কারণে। ইংরেজি বললেও এই লোকের কণ্ঠে অন্য ভাষার সুর!

ওর পেছনে অস্ত্র হাতে লোকটা একজন রাশান!

.

১০.

 পাথরের তৈরি কারাগারে খাবার যে এনেছে, তাকে পাহারা দিতে এসেছে সশস্ত্র কজন গার্ড। তুবড়ে যাওয়া নোংরা গামলায় দিয়েছে কয়েক দিন আগে তৈরি পাথরের মত শক্ত, বাসি পাউরুটি ও অতিরিক্ত লবণ দেয়া পচতে শুরু করা ডাল। সাত বন্দির জন্যে সাতটে গামলা, কিন্তু গার্ড ও খাবার পরিবেশনকারী লোহার গেট বন্ধ করে এলিভেটরে ওঠার আগে, নিয়ম অনুযায়ী খাবারের দিকে হাত বাড়াল কেউ।

বন্দিদের মধ্যে প্রথমে সামনে বাড়ল লৌ, বেছে নিল সবচেয়ে বেশি ডাল ভরা গামলা। শুধু তাই নয়, নিজের জন্যে জড় করল সব পাউরুটি। বাচ্চা ছেলেটার বোধহয় খুবই খিদে, হঠাৎ ছুটে এসে লৌ-এর হাত থেকে কেড়ে নিল এক টুকরো পাউরুটি।

খাবার ছিনতাই হয়েছে দেখে খেপা বাঘের মত ছেলেটার ঘাড় আঁকড়ে ধরতে চাইল লৌ। কিন্তু অনেক চালু ওই পিচ্চি। এক দৌড়ে ফিরে গেল ঘরের পেছনে।

এজন্যে তোর হাতদুটো ভেঙে ফেলব! হুঙ্কার ছাড়ল দানব।

জবাব দিল না পিচ্চি। কাঁপা হাতে পাউরুটি তুলে দিতে চাইছে মৃতপ্রায় ইউরোপিয়ান লোকটার মুখে।

ঝড়ের বেগে ওদিকে ছুটল লৌ। ফেরত দে আমার পাউরুটি, হারামজাদা!

সামনে বেড়ে বাধা দিল মিতা। ওর পাউরুটি ও নিয়েছে।

ধাক্কা দিয়ে মিতাকে সরিয়ে ছোঁ মেরে বাচ্চা ছেলেটার হাত থেকে পাউরুটি কেড়ে নিল লৌ। তাতেও রাগ কমেনি, কষে এক চড় বসাল বেচারার মাথার পাশে। ব্যথায় চেঁচিয়ে উঠে এক পাশে পড়ে গেল বাচ্চাটা। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

ভয় পেয়েছে অন্য বন্দিরা।

হতবাক হয়ে লৌকে দেখল মিতা, পরক্ষণে রাগে গনগন করতে লাগল মগজ। কঠোর চোখে বদমাশ লোকটাকে দেখল ও।

অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি দেখে দাঁতমুখ খিঁচিয়ে আপাদমস্তক ওকে দেখল লৌ। দারুণ তোর শরীর, শালী! এবার দেখব কত মজা দিতে পারিস! নিজের নোংরা কৌতুকে হো-হো করে হেসে উঠল নিজেই। ওটা না থাকলে তোকে আগেই মেরে ফেলত ল্যাং!

চোখে আগুন নিয়ে দানবটাকে দেখল মিতা।

ঠোঁট বাঁকা করে বলল লৌ, তুই কি ল্যাং-এর নাগরী, না পতিতা? এবার চেখে দেখব তুই আসলে কী!

ভয় দেখাতে দেড় ফুট ওপর থেকে মিতাকে দেখল সে। ফলে সরে গেছে একটু বামে। সোজা করে রেখেছে পা, একটু বেকায়দা কোমরের ওপরের অংশ।

মাসুদ রানার প্রিয় একটা কৌশল মনে পড়তেই চট করে পাথরের বাঙ্কে বসল মিতা। পিছিয়ে গেছে। যে-কেউ ভাববে ভয় পেয়েছে ভীষণ। চুপ করে দেখল, চওড়া হাসি ফুটে উঠেছে লৌ-এর পুরু দুই ঠোঁটে।

তার মতই নিজেও হাসল, মিতা, তবে হাসিটা মিষ্টি। পরক্ষণে ঝট করে সামনে বাড়ল ওর ডান পা, লাগল দানবের হাঁটুর বাটির ওপর। পুতিয়ে যাওয়া ছোট পটকার মত বিশ্রী ফটাক শব্দে সরে গেল বাটি। চিরকালের কুঁজোর মত বাঁকা হয়ে, হাউমাউ করে উঠে পিছিয়ে যেতে চাইল লৌ।

তখনই বাঙ্ক থেকে সামনে বাড়ল মিতা।

ল্যাংড়া ফকিরের মত টলমল করতে করতে ওর বুকে ঘুষি বসাতে চাইল লৌ। কিন্তু ভজ মেরে সরে গেছে মিতা। দেহের ভারসাম্য রাখতে না পেরে হুড়মুড় করে মেঝেতে পড়ল দানব। এজন্যেই অপেক্ষা করছিল মেয়েটা, ওর বুট পরা পা ঠাস্ করে লাগল লৌ-এর মুখে। নরম হাড় ভেঙে যাওয়ায় নাকের দুই ফুটো দিয়ে ছিটকে বেরোল রক্ত।

ওরে, বাবারে! মেরে ফেলেছে! করুণ আর্তনাদ ছাড়ল চৈনিক দানব।

বাঙ্ক থেকে নেমে মিতার দিকে ছুটে এল লৌ-এর বন্ধু। ট্যাকল করবে, হাত বাড়িয়ে দিয়েছে শত্রুর গলা খপ করে ধরতে। কিন্তু অনায়াসেই ব্লক করল মিতা। ওই লোকেরই গতি কাজে লাগিয়ে জুডোর কৌশলে তাকে ছিটকে ফেলল দেয়ালের ওপর।

তাতেই শেষ হলো না লড়াই। ফেলে দেয়ার সময় লোকটার ডানহাত মুচড়ে ধরেছে মিতা। ওর বামহাতি ঘুষি নেমেছে তার কনুইয়ের পেছনে। ফলে মড়াৎ করে ভাঙল হাড় প্রচণ্ড ব্যথায় পাগল হয়ে উঠল লোকটা। খাবি খেতে লাগল মেঝেতে পড়ে। মিতার জোরালো এক লাথি তাকে পৌঁছে দিল প্রিয় বন্ধুর পাশে। গোঙাতে শুরু করে সে দেখল, টকটকে লাল রক্তে ভেসে যাচ্ছে বন্ধুর মুখ।

দুফুট দূর থেকে দুই মাস্তানকে দেখল মিতা। আরও কিছু লাগবে? নাকি আজকের মত যথেষ্ট হয়েছে?

মেঝেতে ছেঁচড়ে পিছিয়ে গেল লৌ। পাশেই তার বন্ধু। মৃদু কাতর ধ্বনি ছেড়ে জেলখানার গভীরে আঁধারে লুকিয়ে পড়ল তারা।

অন্য সবাই প্রশংসার চোখে দেখছে মিতাকে।

খুশিতে খিলখিল করে হাসছে বুড়ো। সামনে বেড়ে প্রাপ্য পাউরুটি নিয়ে খেতে লাগল সে।

যে যার পাউরুটি আর ডাল বুঝে নাও, বলল মিতা। লৌ বা তার বন্ধুর জন্যে কিছুই রাখতে হবে না।

সত্যি? আরেক টুকরো পাউরুটি নিল বুড়ো। অ্যাই, নাও তোমরা! লৌ বা চুং খাবে না! আর খাবেই বা কী করে, সামনের দাঁত তো একটাও নেই! আজ আমাদের পেট ভরে খাওয়ার দিন!

দৌড়ে এসে ডালের সবচেয়ে বড় গামলা ও মস্ত এক টুকরো পাউরুটি নিল পাঁচ বছরের বাচ্চা ছেলেটা। ফিরে গিয়ে চেষ্টা করল মৃতপ্রায় বন্ধুকে খাওয়াতে।

দুর্বল স্বরে বলল লোকটা, তুমি খাও, পাবলো, তোমার কাজে লাগবে।

কথা শুনে তাকে পুব ইউরোপ বা রাশার লোক বলে মনে হলো মিতার। অবাক হয়ে ভাবল, অসুস্থ এই লোক বা বাচ্চা ছেলেটা কী করেছে, যে ওদেরকে এভাবে আটকে রেখেছে। হুয়াং লি ল্যাং! এটা অসম্ভব, এরা হুমকি ছিল ওই লোকের কাছে!

কষ্টেসৃষ্টে মেঝেতে উঠে বসে মিতাকে বলল লোকটা, এবার ওরা খুন করবে আপনাকে। থামবে না প্রতিশোধ না নিয়ে।

মৃদু মাথা নাড়ল মিতা। মনে আছে রানার একটা কথা: হাত-পা যদি চালাতেই হয়, তো এমনভাবে চালাও, শত্রু যেন আগামী কয়েক দিনের ভেতর উঠে বসতে না পারে।

না, কাজ ঠিকই শেষ করেছি, ভাবল মিতা। লোকটাকে বলল, ভাববেন না, আপাতত এক সপ্তাহের ভেতর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না ওরা।  

ঘুমের সময় সাবধান, বলল ককেশিয়ান। প্রথম সুযোগেই খুন করবে। ছোট্ট ছেলেকে দেখাল সে। রাতে আপনার ওপর চোখ রাখবে পাবলো। কখনও ঘুমায় না ও।

ছেলেটাকে দেখল মিতা, বাঙ্কে বসে ছোট্ট একটা চড়ই পাখির মতই ঘাড় কাত করে ওকে দেখছে।

পাবলো কি আপনার ছেলে? জানতে চাইল মিতা।

না, মাথা নাড়ল প্রৌঢ়। কিডন্যাপ করেছিলাম ওকে, যাতে বিক্রি করতে পারি হুয়াং লি ল্যাং-এর কাছে।

বিস্মিত হলো মিতা। আসলে কী বলতে চাইছে লোকটা? ওর মনে হয়েছে, বাচ্চাটাকে অন্তর থেকে ভালবাসে সে। আপনি কিডন্যাপ করেছিলেন?

বাবা-মার কাছ থেকে নয়, ওর কোনও পরিবার নেই। সেই ছোটবেলা থেকে যেখানে ছিল, সেই দালানের চেনা কিছু লোকের কাছ থেকে নিয়েছিলাম। তবে ওটা ওর বাড়ি ছিল না।

দেখে তো ওকে রাশান মনে হচ্ছে, আন্দাজ করল মিতা।

মৃদু মাথা দোলাল লোকটা। ওর দায়িত্বে ছিল সায়েন্স ডিরেক্টোরেট। বছরের পর বছর এক্সপেরিমেন্ট চালিয়েছে।

কেন যেন খাড়া হয়ে গেল মিতার ঘাড়ের রোম।

 এক্সপেরিমেন্ট?

জবাব দিতে গিয়ে বেদম কাশির কারণে থেমে গেল লোকটা। একটু পর সামলে নিয়ে বলল, যদি বলতে পারতাম যে ওকে রক্ষা করতে চেয়েছি, তা হলে মনটা ভাল হতো, কিন্তু পুরো ঘটনা অনেক জটিল। পাবলোকে চেয়েছিল হুয়াং লি ল্যাং। আমাদেরকে বলেছিল, ওকে নিরাপদে রাখরে। ব্যবস্থা করবে চিকিৎসার। কিন্তু বাস্তব কথা হচ্ছে, পাবলোকে চুরি করি আমরা পয়সার জন্যে।  

ওকে কিডন্যাপের পর কী হয়েছিল? কী করে এই নরকে এসে পড়লেন?

আরেক দফা প্রচণ্ড কাশি ঝাঁকিয়ে দিচ্ছে লোকটাকে। কিছুক্ষণ পর দমক থেমে গেলে বলল, ট্রলার নিয়ে বেয়ারিং সি পাড়ি দেয়ার সময় পড়লাম ভয়ানক বিপদে। নষ্ট হলো ন্যাভিগেশন সিস্টেম ও রেডিয়ো। শুধু তাই নয়, পথ হারিয়ে ট্রলার চলে গেল আর্কটিক-এ। আমার নাবিকরা বলতে লাগল, অভিশাপ পড়েছে আমাদের ওপর। হয়তো ঠিকই বলেছিল ওরা।

অভিশাপ? কীসের অভিশাপ? জানতে চাইল মিতা।

আমি ট্রলারের ক্যাপ্টেন, কমপাস অনুযায়ী সারারাত দক্ষিণে গেলাম, কিন্তু ভোরে সূর্য উঠলে দেখলাম গেছি পুরো উল্টো দিকে। পিছু নিল হাঙর আর কিলার ওয়েইল। যেন জানত, শেষ পর্যন্ত ওদের পেটে আমরা যাবই। ট্রলার ঠেলে নিয়ে বারবার ফেলল হিমশিলার ওপর। একেকবারে হামলা করল দুই থেকে তিনটে। জাহাজ ডুবে যাচ্ছে দেখে লাইফবোটে চড়ল নাবিকরা। কিন্তু ওদের ওপর চড়াও হলো ওরা। সাগরে পড়তেই খুন হলো আমার নাবিকরা। নিজের চোখে দেখলাম, তলিয়ে গেল লাইফবোট। তবে বেঁচে গেলাম আমি পাবলোকে নিয়ে। ঠাই হলো বড় এক টুকরো বরফের ওপর।

অসুস্থ লোকটার কাছে যেতেই পচা মাংসের গন্ধ পেল মিতা। নোংরা কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে রাখা হয়েছে কেটে ফেলা ডান হাঁটু। এ ছাড়া, গ্যাংগ্রিনে কালো দুহাত, নাক ও মুখ। কিন্তু ক্যাপ্টেনের মত অসুস্থ হয়নি পাবলোলা।

ছেলেটার ফ্রস্টবাইট হয়নি কেন? জানতে চাইল মিতা।

ছুরি দিয়ে বরফ খুঁড়ে ছোট গুহা তৈরি করি, বলল সার্গেই দিমিতভ। সর্বক্ষণ আগলে রেখেছিলাম ওকে। ওখানেই ছিলাম পুরো তিন দিন। সূর্য উঠল না। বুঝলাম চতুর্থ দিন মরে যাব আমরা। কিন্তু তৃতীয় সন্ধ্যায় এল হেলিকপ্টার। আমাদের খুঁজে বের করে সরিয়ে নিল হুয়াং লি ল্যাং–এর লোক।

কী কারণে আপনাকে এই জেলখানায় আটকে রেখেছে সে?

কোর্স থেকে এত সরে গিয়েছিলাম, ওরা ধরে নিয়েছে বিশ্বাসঘাতকতা করতে চেয়েছি।

পাবলোকে দেখল মিতা। এত কিছু হলো ছোট্ট এই ছেলের জন্যে? এর কারণ কী? কে এই ছেলে?

ওর কোনও পরিবার নেই। বংশ জানা নেই আমার। কিন্তু খুব অস্বাভাবিক ক্ষমতা আছে ওর। দুর্বল লাগতেই কাঁথার ওপর শুয়ে পড়ল ক্যাপ্টেন দিমিতভ। জন্ম থেকেই ওর ডিজেনারেটিভ নিউরোলোজিকাল ডিসঅর্ডার রোগ। ওর বাবা-মার টাকা ছিল না যে চিকিৎসা করাবে, তাই দান করে দেয় রাশান সায়েন্স ডিরেক্টোরেটকে। বিজ্ঞানীরা একের পর এক এক্সপেরিমেন্ট করতে লাগল পাবলোর ওপর। অনেকটা ঠেকিয়েও দিল অসুখ। কিন্তু এর ফলে শুরু হলো সাইড এফেক্ট। অনেক কিছু দেখতে আর শুনতে পায় পাবলো। সাধারণ মানুষ এসব জানতেও পারে না।

কাঁপা ক্যাপ্টেন দিমিতভের কণ্ঠ।

তার বক্তব্য সঠিক, না জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকছে, এ নিয়ে মনে গভীর সন্দেহ তৈরি হয়েছে মিতার। জানতে চাইল, তা হলে কি পাবলো আসলে সাইকিক?

মৃদু মাথা নাড়ল দিমিতভ। না, ওটা দৈহিক। ম্যাগনেটিক অ্যানোম্যালি বা ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ডিসটার্বেন্স চট করে টের পায়। ফলে সাধারণ মানুষ যা বুঝবে না, ওর কাছে সেসব পানির মত পরিষ্কার।

মিতা চমকে গেছে ফিযিসিস্ট হিসেবে। একটু পর জানতে চাইল, সত্যিই কি তা পারে?

জানি না, আবারও কাশতে লাগল ক্যাপ্টেন। কাশি থেমে যাওয়ার পর বলল, হুয়াং লি ল্যাং মনে করত পাবলো ওসব পারে।

দিমিতভ অতীত ক্রিয়া ব্যবহার করেছে, তাই জানতে চাইল মিতা, তো ওকে এখানে ফেলে রাখল কেন? ল্যাং এখন আর তা মনে করে না?

আস্তে করে মাথা নাড়ল ক্যাপ্টেন। না, তার কোনও কথাই শুনবে না পাবলো। হুমকি দিয়ে, মারপিট করে বা ড্রাগ দিয়েও ওর মুখ খোলাতে পারেনি সে। বড়জোর নিজের সঙ্গে কথা বলে বা গান গায়। মরে গেলেও সরবে না আমার কাছ থেকে। তাই শেষে আমার সঙ্গে ওকেও এখানে পাঠিয়ে দিয়েছে ল্যাং। তার লোকজন জানিয়ে দিয়েছে, চোখের সামনে আমার মৃত্যু দেখতে হবে ওর। তখন ঠিকই খুঁজে নেবে নতুন প্রভু।

বাচ্চা ছেলেটাকে দেখল মিতা। সড়াৎ-সড়াৎ আওয়াজ তুলে ডালে চুমুক দিচ্ছে ও। পাবলো কি বুঝতে পেরেছে, কী চাইছে ল্যাং?

আমার তো তা-ই মনে হয়, বলল দিমিতভ, তবে কিছুই পাত্তা দিচ্ছে না ও।

হঠাৎ মুখ তুলে তাকাল ছেলেটা, চোখ গেল এলিভেটরের বন্ধ দরজার ওপর। কিছুইঘটল না। বাইরে থেকে এল না কোনও আওয়াজ। কিন্তু কয়েক সেকেণ্ড পর শাফটের নিচে এসে থামল এলিভেটর কার। খুলে গেল দরজা।

টেইযার হাতে বেরিয়ে এল গার্ডরা।

আপনার নাম কি? সার্গেইর কাছে জিজ্ঞেস করল মিতা।

সার্গেই দিমিতভ, বলল ট্রলারের ক্যাপ্টেন। কথা শেষে ভীষণ কাশতে লাগল। বিশ সেকেণ্ড কেশে মুখের ওপর থেকে সরাল ঘেঁড়া কাঁথা। ওই ক্লাপড়ে মেখে আছে তাজা রক্ত।

মিতা বুঝে গেল, বড়জোর আর দুএক দিন আছে, মানুষটা।

<

Super User