তুরুপের তাস – মাসুদ রানা
কাজী আনোয়ার হোসেন – সেবা প্রকাশনী
প্রথম প্রকাশ ২০০০

০১.

অচেনা মেয়েটাকে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে রানা। মাথায় হাত বুলিয়ে কিংবা ঘুমপাড়ানী গান গেয়ে নয়, মিকি ফিন খাইয়ে।

আজই ভোরে সুইটজারল্যান্ড পৌঁছেছে মাসুদ রানা, ফ্রান্সের থনন থেকে শেষ বোটটা ধরে। ডেকহ্যান্ডের ছদ্মবেশ নিয়েছিল ও, কাজও করেছিল খাঁটি একজন ডেকহ্যান্ডের মতই এবং মনে মনে সন্তুষ্ট ছিল, কারও বাপের সাধ্য নেই চেনে ওকে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে কেউ না কেউ ঠিকই চিনে ফেলেছিল–আর তার অর্থ আগুনে ঘৃতাহুতি। মাটিতে পড়ার আগেই দুম করে ফেটে গেছে মিশন লেপার্ড! ভাবছে রানা, বিসিআইয়ের দুর্ধর্ষ এজেন্ট, মেজর জেনারেল রাহাত খানের ডানহাত কি তবে তার অনন্যসাধারণ শৈল্পিক কৌশল হারাচ্ছে?

ঘুমন্ত মেয়েটির দিকে ভ্রূ কুঁচকে চাইল রানা। না, সে তার টাচ হারাচ্ছে না। হারাতে পারে না। যে মুহূর্তে হারাবে তার পরমুহূর্তে মৃত্যু ঘটবে ওর।

অগোছাল ছোট্ট রূমটায় পায়চারি করছে রানা। মলিন, পুরনো ড্রেসটা এখনও পরনে ওর। রানা এজেন্সির বা বিসিআইয়ের কারও পক্ষে, এমনকি রাহাত খানের পক্ষেও সম্ভবত এই বেশে ওকে চেনা দুঃসাধ্য। অবশ্য বড়জোর দশ মিনিট লাগবে ওর নিজেকে পাল্টে নিতে। মেয়েটিকে আরেক ঝলক দেখে নিল রানা-আরও ঘণ্টা দুয়েক নিশ্চিন্তে ঘুমোবে সুন্দরী। ছোট্ট খাঁচাটার ভেতর চিতাবাঘের মত পায়চারি করতে লাগল ও। হাঁটাহাঁটি করছে যদিও, চোখজোড়া সদাসতর্ক, অস্থির।

ভয় পাওয়ার মত কিছু নেই এঘরে, ইতোমধ্যেই নিশ্চিত হয়ে নিয়েছে। রানা। বাগ, টাইম বোম, অথবা কোনও ধরনের লিসনিং ডিভাইস-না, নেই। জেনেভার একটা অপরিচ্ছন্ন, সস্তাদরের হোটেল রূম এটা। কারও পক্ষে আগেভাগে অত প্রস্তুতি গ্রহণ করা সম্ভব নয়। কেউ জানত না ও আসছে এবং এখানে উঠছে।

নাকি জানত? ব্যাপারটা অসম্ভব মনে হচ্ছে রানার। কিন্তু তাহলে এই মেয়েটা জুটল কিভাবে?

ছোট করে ছাঁটা চুলে দুহাত বুলিয়ে নিল রানা। ছদ্মবেশের স্বার্থে এতটা ছোট করতে হয়েছে ওকে চুল।

খুব সহজভাবে মিশন লেপার্ড-টাকে নিয়েছে রানা। ওর মূল উদ্দেশ্য ভিন্ন। মিশনটা কিছুই না, নিতান্তই সাধারণ–দুনিয়ার সবচাইতে নিরাপদ ব্যাঙ্ক থেকে তুলে আনতে হবে দুনিয়ার সবচেয়ে মূল্যবান এক চিতাবাঘ। এক ফুট উঁচু চিতাবাঘটা, দেড় ফুট লম্বা, চোখে ধারণ করছে পৃথিবীর বিশালতম দুটো রুবি। মূর্তিটা খাঁটি সোনায় তৈরি। টাকা দিয়ে এর বিচার হয় না, জিনিসটা অমূল্য। অনেক কারণেই। চিতাবাঘটাকে হাত করতে চাইছে অনেকে, উদ্দেশ্যও তাদের একেকজনের একেক রকম।

 এই কেসে রানা নিজেকে জড়িয়েছে একান্ত ব্যক্তিগত কারণে। ওর মিউনিখ প্রবাসী এক বন্ধু হঠাৎ কমাস আগে মারা যায়, সপরিবারে। মারা যায়। মানে, মেরে ফেলা হয়। স্বামী-স্ত্রী আর পাঁচ বছরের ফুটফুটে বাচ্চা মেয়েটা আরও অনেক বিদেশীর মত রুডলফ ব্রিগলের নৃশংস সন্ত্রাসের শিকার হয়। রানার বন্ধু, কায়সার রশীদ, অভিবাসী হিসেবে মিউনিখে থাকত। কিন্তু নিও নাজীরা ইদানীং জার্মানীর নানা জায়গায় বিদেশীদের ওপর চোরাগোপ্তা হামলা চালাতে থাকলে শঙ্কিত হয়ে পড়ে কায়সার। রানার সঙ্গে ওর কথাও হয়েছিল এ ব্যাপারে। রানা ওকে দেশে ফিরে আসতে বলে। কিন্তু বেচারার কপালে থাকলে তো!

রুডলফ ব্রিগলের সন্ত্রাসবাদী দল একাধিক বার রাতের অন্ধকারে আগুন। জ্বেলে ছারখার করে দিয়েছে অভিবাসীদের অনেকগুলো বাড়ি-ঘর। এমনি এক মর্মান্তিক ঘটনায় জীবন্ত দগ্ধ হয়ে বেঘোরে মারা পড়ে কায়সার, তার স্ত্রী মমতাজ আর একমাত্র মেয়ে, ফুলের মতন নিষ্পাপ শিশু রোজানা।

মেনে নিতে পারেনি মাসুদ রানা, কোনও সুস্থমস্তিষ্কের মানুষই পারবে না। প্রতিজ্ঞা করেছে ও, শেষ দেখে ছাড়বে রুডলফ ব্রিগলের।

রানা ব্যক্তিগত কাজে জেনেভা যাচ্ছে শুনে মেজর জেনারেল ওর ওপর চাপিয়ে দিলেন মিশন লেপার্ডের ভার। রাশেদকে পাঠাচ্ছিলেন তিনি, কিন্তু রানার ব্যক্তিগত আক্রোশকে কাজে লাগানাৈর উদ্দেশে ওকে অনুরোধ করলেন চিতাবাঘটা এনে দেয়ার জন্যে। ব্রিগলও নাকি লেগেছে ওটার পেছনে, হাত করতে চাইছে দুষ্প্রাপ্য মূতিটাকে।

এক কথায় রাজি হয়ে গেছে রানা। দেখে নেবে ও, কতবড় সন্ত্রাসী লোকটা। দলবল লেলিয়ে দিয়ে নিরীহ নারী-পুরুষ-শিশু হত্যা করতে যার বাধে না, নির্মম প্রতিশোধ নেবে ও তার ওপর। দুঃখজনক ঘটনাটা ঘটার পরপরই জার্মানীতে চলে যায় রানা। কিন্তু দেখা পায়নি ব্রিগলের। আশ্চর্যজনকভাবে হঠাৎ করেই উধাও হয়ে যায় লোকটা। কিন্তু এখন নাকি সে চিতাবাঘের মূর্তিটার পিছনে লেগেছে। শুনে খুশি হয়েছে-রানা। কপাল গুণে সুযোগ এসে গেছে ওর। সামনে।

আচ্ছা, এই মেয়েটিও কি চাইছে মূর্তিটা?

সোফার কাছে এসে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে যুবতাঁকে দেখল রানা। বাচ্চামানুষের মতন ঘুমাচ্ছে। ফুটফুটে একটা বাচ্চা! কত হবে, আন্দাজ করল রানা, পঁচিশের একটু এদিক বা ওদিক। প্রশান্ত মুখের চেহারায়, আবছা রেখাগুলো যেন অভিজ্ঞতা ও ভোগান্তির ইঙ্গিত দিচ্ছে। দামী ফেইল স্যুটের আড়ালে যুবতীর। দেহবল্লরী দীর্ঘ ও ঢেউ খেলানো। বিশেষজ্ঞের রায় দিল রানা—নিঃসন্দেহে আকর্ষণীয়।

সোফায় শরীর মোচড়াল মেয়েটি, ঘুমের মধ্যে অস্থির। তার খাটো স্কার্টটা কুঁচকে উঠে গেল ওপরদিকে। চিন্তিতভঙ্গিতে, বেইজ স্টকিং পরা ফর্সা, সুগঠিত পা-জোড়া জরিপ করল রানা। এবার নুয়ে পড়ে, স্কার্টটা তুলে দিল। ওপরে। সুডৌল দুই ঊরুতে কালো রঙের চওড়া গার্টার। দুটো গার্টারেই একটা করে খুদে হোলস্টার। এবং হোলস্টার দুটোয়, ধবধবে সাদা সাটিন সিল্কের পটভূমিতে, নিরীহ ভঙ্গিতে সেটে রয়েছে ছোট্ট একটা ছুরি ও খুদে একটা পিস্তল।

খাপ থেকে আলগোছে অস্ত্র দুটো তুলে নিল রানা, সতর্ক রইল মেয়েটির শরীরে যাতে স্পর্শ না লাগে। তারপর স্কার্টটা টেনে নামিয়ে দিয়ে, অস্ত্র দুটো নিয়ে, টিমটিম করে জ্বলা একমাত্র ল্যাম্পটার কাছে চলে এল।

আদৌ ছুরি নয় এটা, ছোট্ট একটা স্টিলেটো। স্পেনে তৈরি পিচ্চি একটা সূচ। খাজ কাটা। পিস্তলটা ওয়েবলির তৈরি ক্ষুদ্রতম অটোমেটিকের সর্বশেষ সংস্করণ। লিলিপুট। ওটা মুঠোয় পুরে দাঁত বের করে হাসল রানা। ট্যাক্সিতে করে এখানে আসার সময় কে ভেবেছিল ওর যুবতী সঙ্গিনীটি সশস্ত্র? পপ-গানের। মতন শব্দ করে পিস্তলটা, এবং জায়গা মত লাগানো গেলে .৪৫ কোল্টের। চেয়ে, অথবা রানার সঙ্গে করে আনা লুগারটার চাইতে কম ভয়ঙ্কর নয়।

ঘরের একপাশে অপ্রশস্ত, স্প্রিং দেবে-যাওয়া খাটটার কাছে এসে দাঁড়াল রানা। গ্ল্যাডস্টোন ধাচের ইয়া বড় এক সুটকেস পড়ে রয়েছে ওটার ওপর। কুমীরের চামড়া দিয়ে তৈরি সুটকেসটার গায়ে ফাটা-ফাটা ট্র্যাভেল স্টিকার সাটা গোপন তল ও পার্শ্বদেশ রয়েছে জিনিসটার। এক গাদা খুদে থলিতে ও কম্পার্টমেন্টে ঠাই পেয়েছে ওষুধ ভর্তি নানা পদের শিশি-বাতল আর সাজ সরঞ্জাম। রানার এবারের মিশনের জন্যে বিশেষভাবে তৈরি করে দিয়েছে এটা, বিসিআই। আনতে চায়নি রানা, জগদ্দল পাথরের মতন মনে হচ্ছিল ওর কাছে জিনিসটাকে। কিন্তু বুড়ো খানের ওপর কথা বলে কার সাধ্য। টেকনিক্যাল ডিপার্টমেন্টের আশরাফ চৌধুরীর ওপর তার অগাধ বিশ্বাস। বিভিন্ন ধরনের গ্যাজিট তৈরিতে লোকটার জুড়ি মেলা ভার, মনে মনে স্বীকার করে রানাও। কাজেই আশরাফ চৌধুরী সুটকেসটা গছিয়ে দিতে চাইলে আর কোন ওজর আপত্তি টেকেনি।

সুটকেসে ছুরি ও পিস্তল চালান করে, ঘুরে দাঁড়াতে গিয়ে, থমকে গেল। রানা। সুটকেসটার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইল। কপাল কুঁচকে গেছে ওর। এটাকে সঙ্গে করে আনাটা কি ঠিক হয়েছে? সামান্য একজন ডেকহ্যান্ডের লাগেজ হিসেবে কি মানানসই জিনিসটা? এরই কারণে কি, আক্কেল সেলামী দিতে হবে ওকে নিজের জীবন দিয়ে?

 শ্রাগ করে কাজে মন দিল রানা। অনেক দেরি হয়ে গেছে, আর পিছু চেয়ে, লাভ নেই, এখন শুধু আগে বাড়ার পালা। কিন্তু কেউ একজন কিছু একটা ভুল। করেছে। কোনওখানে। কোনওভাবে।

ঘুমন্ত সুন্দরীকে আবার পরখ করে নিল ও। এখনও আউট হয়ে আছে। স্কার্টটা আবারও টেনে নামিয়ে দিয়ে দ্বিতীয়বারের মত যুবতীর পার্সটা ঘেঁটে দেখল, স্রেফ নিশ্চিত হওয়ার জন্যে। লাগেজ নেই মেয়েটির সঙ্গে।

 ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলো না এবারও। যুবতীদের পার্সে সচরাচর যা থাকে একটা কম্প্যাক্ট, টিসু, তিনটে লিপস্টিক, চেঞ্জ, আধ-ভর্তি, এক প্যাকেট বেনসন। ফরাসি ও জার্মান মুদ্রা প্রচুর পরিমাণে, কিন্তু সুইস ফ্রাঁ নেই। ব্যাপারটা। বিস্ময়কর নয় মোটেই। রানার সঙ্গে লেক পার হয়েছে ও-সত্যি বলতে কি রানাকে তুলে নিয়েছিল বোটে-এবং তারপর থেকে এখন অবধি কারেন্সি পাল্টে নেয়ার সময় পায়নি।

পাসপোর্টটা পড়ে এবারও আগেরবারের মতই আগ্রহ ও বিস্ময় বোধ করল রানা। জার্মান। নিজের পরিচয় দিচ্ছে ব্যারোনেস জুলি গ্রাফ হিসেবে। রবার্টা জুলি গ্রাফ। রবাটা? ইংরেজ নাম নয়? ভবিষ্যতে জিজ্ঞেস করে জেনে নেবে। রানা-আদতেই যদি ভবিষ্যৎ বলে কিছু থেকে থাকে ওদের।

পাসপোর্ট হাতে সোফার কাছে ফিরে এসে মেয়েটির ঘুমন্ত মুখটা পরীক্ষা করল রানা। কোন সন্দেহ নেই, এই মেয়েই ব্যারোনেস! অন্তত এটুকু বলা যেতে পারে, ব্যারোনেসের পাসপোর্টে ওটা এই মেয়েরই ছবি।

 কে জানে, এই মেয়ের ব্যারোনেস হওয়া অসম্ভব নয়, পোশাক-আশাক তো রীতিমত জমকালো আর দামী।

পার্সের মধ্যে পাসপোর্টটা ছুঁড়ে দিয়ে, হতবিহ্বল দৃষ্টিতে নোনা ধরা সিলিঙের দিকে চেয়ে রইল রানা। হোটেল হিলসনে জোরজার করে রানার সঙ্গে আসার পর থেকেই, কেমন জানি খানিকটা ভীত-সন্ত্রস্ত দেখাচ্ছিল যুবতাঁকে। আচ্ছা, এই মেয়ে কাউন্টার-স্পাই নয় তো? হয়তো কাজ করছে স্বাধীনভাবে, ধান্ধা করছে দুতরফ থেকেই ফায়দা লোটার। সন্দেহটা অমূলক নয়। স্টীমারে সেই প্রথম থেকেই, সাধারণ এক ডেকহ্যান্ডের ছদ্মবেশধারী, রানার সঙ্গে ঢলাঢলির কম চেষ্টা তো করেনি মেয়েটি, তারপর তো একরকম জবরদস্তি করেই হোটেল অবধি এসে উঠেছে। যা-ই হোক, খোলসা করে ব্যাপারটা জানতে হবে রানার।

সুটকেস থেকে তাই ওয়াইনের বোতলটা বের করেছিল ও। অবস্থান নিয়েছিল মেয়েটি ও দরজার মাঝখানে, এবং দুজনের জন্যে ঢেলেছিল ছোট্ট দুটো ড্রিঙ্ক। কায়দা করে যুবতীর গেলাসে ফেলে দিয়েছিল ঘুমের ওষুধ।

পরিচয় জেনে নেয়া গেছে মেয়েটির, এখন কি করবে ওকে নিয়ে?

শীঘ্রিই ভোর হয়ে যাবে। দ্রুত এখান থেকে বেরিয়ে মেজর জেনারেলের সঙ্গে কথা বলা দরকার। কি ঘটছে জানাবে তাকে। মিশন লেপার্ড হয়তো এরইমধ্যে চালু হয়ে গেছে। কিংবা এই ব্যারোনেস ভদ্রমহিলা হয়তো ও যা ভাবছে সে সব কিছুই নয়, আজব ধরনের কোন কলগার্ল। বস হয়তো কিছু জানাতে পারবেন এ বিষয়ে। মিকি ফিনের ওপর পরিপূর্ণ আস্থা আছে রানার, কিন্তু সাবধানের মার নেই। সুটকেস থেকে, বিশেষভাবে তৈরি হাত-পা-মুখ বাধার স্ট্র্যাপগুলো বের করল ও। কাজ সারা হয়ে গেল, এক মিনিটের মধ্যে। এখন নিশ্চিন্ত, নড়াচড়ার।

সুযোগ পাবে না ব্যারোনেস। এক চিলতে একটা বাথরূম, কুমীরের চামড়ার সুটকেসটা নিয়ে ঢুকল ওখানে রানা। অল্প কিছুক্ষণ লাগল জুরিখের কাছে জন্ম। নেয়া, ডেকহ্যান্ড কেনেট ডাহলিনের ছদ্মবেশ পাল্টে ফেলতে।

একটু পরেই ওহাইয়ো, আমেরিকার মিস্টার উইলিয়াম হথর্নকে বাথরূম থেকে বেরিয়ে এসে, ঘুমন্ত মেয়েটিকে পরীক্ষা করতে দেখা গেল। মুখের বাধন শ্বাসরোধ করবে না ওর; এবং রানা আগেই লক্ষ করেছে যুবতী মুখ দিয়ে শ্বাস নেয় না। ঊর্ধ্বমুখী বেয়াড়া খাটো স্কার্টটা আবারও টেনে নামিয়ে দিল রানা, থুড়ি, মিস্টার হথর্ন।

ভুড়িওয়ালা মি. হথর্ন একজন বিশিষ্ট ভদ্রলোক, মাথার চুল ধূসর ও পাতলা হয়ে এসেছে তার। ভুড়িটা বাগাতে ছোটখাট একটা রাবারের পনশ ব্যবহার করতে হয়েছে রানাকে।

রানা বেরোতে যাবে এমনিসময় মাথায় ঘাই মারল চিন্তাটা। আরেহ! ও এত অসতর্ক হলো কবে থেকে? মেয়েদের চিরাচরিত ও বহুল ব্যবহৃত গোপনীয় স্থানটার কথা বেমালুম ভুলেই গেছে!

বুকচেরা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল মি. হথর্ন। এ ধরনের কাজ তার মতন। ভদ্রলোকের সাজে না। কিন্তু রানার কথা আলাদা।

 অগত্যা, যুবতীর পাতলা ব্লাউজটার বোতামগুলো খুলে ফেলতে হলো। হাফ ব্রা মেয়েটির ভরাট বুকের প্রায় সবটুকুই অনাবৃত করে রেখেছে। বুকের উপত্যকা থেকে চেন ধরে টেনে সিলভার লকেটটা তুলে আনল রানা।

জিনিসটা প্রকাণ্ড। আকারে সিলভার ডলারের প্রায় সমান হবে। আঙুলের টোকায় খুলল ওটা রানা। একদৃষ্টে দীর্ঘক্ষণ চেয়ে রইল ভেতরের ফটোটার দিকে।

মুখের চেহারা বিকৃত হয়ে গেল মাসুদ রানার মত কঠোর-হৃদয়, বেপরোয়া পুরুষেরও।

.

০২.

লকেটের চেহারাটা-বাকা, কুঁচকানো মৃত মুখটাকে আদৌ যদি চেহারা বলা যায়-একজন প্রৌঢ় জার্মানের।

আবছাভাবে মনে পড়ছে রানার, নিও-নাজীদের বিরোধিতা করার কারণে হত্যা করা হয় এই লোকটিকে। জার্মান এক পত্রিকায় সম্ভবত সচিত্র প্রতিবেদন দেখেছিল সে। বেশ কয়েক বছর আগে।

 কিন্তু এ লোকের ছবি কি করছে ব্যারোনেসের বুকের মাঝখানে? এর সাথে কি সম্পর্ক ঘুমন্ত রাজকন্যার?

লকেটটা যেখানে ছিল রেখে দিয়ে এটে দিল রানা ব্লাউজের বোতামগুলো। হাত বুলিয়ে দিল মেয়েটির গালে। কে এই ব্যারোনেস? ছুরি-পিস্তল সঙ্গে রাখে, গলায় পরে নৃশংস হত্যাকাণ্ডে নিহতের ছরি, ভাবছে রানা।

ঘুমের মধ্যে একবার নড়ে মৃদু গুঙিয়ে উঠল যুবতী। মুখের চেহারা লালচে দেখাচ্ছে ওর, হানি-ব্লন্ড চুল কুঁকড়ে, লতিয়ে পড়ে রয়েছে কপালময়। ঘুমাও, সোনা-মাণিক, বিড়বিড় করে আওড়াল রানা, আমি একটু বেড়িয়ে আসি।

 অগোছাল ঘরটার চারধারে, চকিত চাহনি বুলিয়ে নিল রানা শেষবারের। মত। দরজার লকটা খুব একটা মন্দ নয়। বাথরূমে জানালার বালাই নেই। ঝুলকালি-মাখা, ফাটল ধরা, ঘরের সবে ধন নীলমণি জানালাটাও বন্ধ। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে এক ফোঁটা বাতাস ঢোকারও সুযোগ রাখেনি।

 নোংরা একটা প্যাটাইনার মধ্যে দিয়ে জং ধরা ফায়ার এস্কেপটার দিকে, উঁকি মারল রানা। পাক খেয়ে, চার ধাপে পেছনের এলাকায় নেমে গেছে ওটা। ওখানে পড়ে থাকা ব্রক্স, পরিত্যক্ত ক্যান, বেতের ঝুড়ি ইত্যাদির ছায়া লক্ষ করে উপলব্ধি করল রানা, তুরিত হানা দেবে ঊষা।

শীতল সারিয়্যালিস্টিক আলোয়, সামনে বিছিয়ে থাকা দানা বাঁধা ছায়াদের সঙ্গী করে, খোয়া-পাথরের শূন্যগর্ভ শব্দ শুনতে শুনতে, সংকীর্ণ গলিগুলো দিয়ে। এগোচ্ছে রানা। একবার, একটা ইন্টারসেকশনে, ওর দিকে আসতে দেখল দুজন পুলিসকে। একটা দোকানের পাশে চট করে আড়াল নিল রানা। কিন্তু ঘুরে অন্যদিকে চলে গেল দুই পুলিস। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল ও। জেনেভা পুলিসের সঙ্গে কোন হাঙ্গামায় জড়াতে চায় না রানা। কি ব্যাখ্যা দেবে সে, যদি জিজ্ঞেস করা হয়, বিশিষ্ট বিজনেসম্যান মি. উইলিয়াম হথর্ন অচেনা শহরে রাতবিরেতে ঘুরঘুর করছে কেন?

কুয়াই-দু-মন্ট-ব্লাঁ-তে এসে একটা ট্যাক্সি র‍্যাঙ্ক খুঁজে পেল রানা, জানত পাবে। সাধের চটকা ভাঙানোতে রক্তচক্ষু মেলে চাইল শোফার। প্রতিবাদ করতে মুখ খুলে, আবার কি ভেবে যেন বন্ধ করে ফেলল। এই হোদলকুতকুত, বুড়ো আমেরিকানটার মাথা খারাপ হলে কি আর করা, যেখানে, নিয়ে যায় যাবে। হাজার হলেও কাস্টোমার-লক্ষ্মী। মেদবহুল কাঁধ  কঁকিয়ে, প্রাচীন এঞ্জিনটা স্টার্ট দিল সে। বিদেশী মোটা বুড়োটার চোখজোড়া কেমন জানি অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছিল ওকে। তরবারির মত ঝকঝকে, তীক্ষ্ণ দুচোখের দৃষ্টি সোজা অন্তরে গিয়ে বেঁধে, লোকটার ভুড়ির সঙ্গে ওটা একেবারেই বেমানান।

অ্যালনস! পেছন থেকে বলল ভুড়িঅলা। ভাইট!

মারদে! বলল ড্রাইভার। তবে আত্মগতভাবে।

.

প্রায় চল্লিশ মিনিট পর সুসজ্জিত, খুদে ডিপোটা থেকে বেরিয়ে এল মাসুদ রানা। জরাজীর্ণ, প্রাচীন এক বিল্ডিঙের নিচে, একটা সেলার। ওখানে রানা এজেন্সির। অফিসের, অর্থাৎ ডিপোটার অবস্থান। ছোট অথচ শক্তিশালী রেডিও ট্রান্সমিটার। ঢাকায় বিসিআই ফোন সিস্টেমে সংযোগ ঘটিয়ে দিয়েছে রানার।

রানা যখন ঢুকেছে দুজন লোক ছিল তখন ডিপোতে। ওদের সঙ্গে কথা বলার পর এবং বিশেষ একটি ইশারা করে, কার্ড প্রদর্শনের পর ভারী দরজার বার নামানো হয় ওর জন্যে।

বাইরে মধ্য সেপ্টেম্বরের চোখ ধাঁধানো সকাল। দামী সুইস ওয়াইনের মত স্বচ্ছ, ঝলমলে, তাজা বাতাস; সূর্যের ঠাণ্ডা আলোয়, রোনের নীলগোলা পানিতে সোনালি চুড়ির প্রতিফলন যেন। খোয়া বিছানো সরু একটা ব্রিজ অতিক্রম করছে এ মুহর্তে রানা। হোটেলে হেঁটে ফিরবে ঠিক করেছে ও। হাতে সময় রয়েছে পর্যাপ্ত। মেয়েটি আরও অন্তত এক ঘণ্টা আরামে ঘুমাবে। দীর্ঘ, পেশল পা দুটো স্ট্রেচ করার প্রয়োজন অনুভব করছে রানা, উইলিয়াম হথর্নের ভূমিকায় অভিনয় করতে করতে খিল ধরে গেছে পেশিতে। মাথাটাও একটু-আধটু খাটানো দরকার। মিশনটা যা ভেবেছিল মোটেই তত সহজ নয়, ক্রমেই জটিল। হয়ে উঠছে। বসের সঙ্গে কথোপকথনের পুরো বিষয়টা উল্টেপাল্টে বিবেচনা করছে রানা। অনেক প্রশ্নেরই জবাব জানা হয়েছে ওর, আবার অনেক প্রশ্ন তৈরি হয়েছে মনে।

ব্রিগল আর নাকাতা রওনা হয়ে গেছে। দুজনেই স্পষ্টত জেনেভার উদ্দেশে মুভ করছে। হয়তো পৌঁছেও গেছে ইতোমধ্যে। ওরা চিতাবাঘটা হাত করার পরপরই ওটা ছিনিয়ে নিতে বলেছেন বস রানাকে।

সম্প্রতি ওকে যে ব্রিফিং দেয়া হয়েছে সেটার কথা ভাবছে রানা। রুডলফ ব্রিগল আর হির্দেতোশি নাকাতা হচ্ছে সেই দুই শৰ্মা, মাসের পর মাস, এমনকি বছরের পর বছর ধরে চোখে চোখে রাখা হচ্ছে যাদেরকে। বিসিআই ও আরও গোটা ছয়েক দেশের এজেন্সি ধৈর্য ধরে অপেক্ষায় আছে, সোনার চিতাবাঘ তুলে। নিতে কবে মাঠে নামে লোক দুটো। অবশেষে কাজে নেমে গেছে তারা।

 দুদিন আগে টোকিও ত্যাগ করেছে নাকাতা। গন্তব্য জেনেভা। কাভার নিয়েছে সে ক্যামেরা বিক্রেতার। আর চারদিন আগে হামবুর্গ ছেড়েছে দ্বিগল। তারও গন্তব্য, বলাইবাহুল্য, সেই একই।

 প্রশ্ন করে জেনে নিয়েছে রানা, ব্যারোনেস রবার্টা জুলি গ্রাফ জার্মান। ইন্টেলিজেন্সের একজন এজেন্ট। তার পরিচয়ে কোন খুঁত নেই। এই মিশনে। তার অন্তর্ভুক্তির কারণ রুডলফ ব্রিগল নিজের চেহারা পাল্টে নিয়েছে, প্লাস্টিক সার্জারি করে। রানার কাছে লোকটার যে ছবি আছে সেটা এখন অর্থহীন। একমাত্র ব্যারোনেস গ্রাফই চেনে রুডলফ ব্রিগলের আসল চেহারা।

বস স্পষ্ট ভাষায় রানাকে সাবধান করে দিয়েছেন কালকেউটের চাইতেও শতগুণ ভয়ঙ্কর এই জার্মান সন্ত্রাসী সম্পর্কে। বলেছেন, তোমাকে আর নতুন করে কি বলব। তবে একটা কথা, রানা, কাভার ফাস হয়ে গেলে ব্রিগল জেনে যাবে তুমি কে। কিংবা জানার সুযোগ পাবে। কিন্তু সে ঠিকই নিশ্চিত থাকবে তুমি ওকে চিনতে পারবে না–পারতেও না, যদি না ওই ব্যারোনেস মেয়েটা আমাদের পক্ষে থাকত। আসলে সমস্ত প্ল্যানই নাকি ব্রিগলের। নাকাতা নাচছে। তার কথায়।

কিন্তু, স্যার, আমতা আমতা করে বলেছে রানা, ব্যারোনেস আমাকে চিনে নিয়ে বোটে তুলল কিভাবে?

তোমার জেনেভায় ঢোকার সম্ভাব্য কয়েকটা রুট জানিয়ে দিয়েছিলাম বন কে। তোমার উদ্ভট সুটকেসটার স্টিকারগুলোর কথাও বলেছিলাম। বিসিআইয়ের পক্ষে টেম্পোরারি এজেন্টের কাজ করছে এখন ব্যারোনেস।

 ব্যারোনেসের লুকেটে পোরা ছবিটার কথা বসকে জানিয়েছে রানা।

লোকটা নিশ্চয়ই ওর বাবা, বলেছেন বস। ব্যারোনেস ছবিটা সঙ্গে নিয়ে ঘোরে, ব্রিগলকে খুন করতে হবে সেই প্রতিজ্ঞাটা নিজেকে মনে করিয়ে দেয়ার জন্যে। তোমার মত সে-ও লোকটাকে পচা ঘায়ের মত ঘৃণা করে, লোকে অন্তত তাই বলে। ব্রিগলকে বাগে পাওয়ার জন্যে গত কয়েক বছর ধরেই লেগে আছে পিছনে। জুডাসের মত চিনিয়ে দেবে সে ব্রিগলকে। বাকি কাজ তোমার। তুমি হুঁশিয়ার না থাকলে ও নিজেই হয়তো ফাঁক পেয়ে খুন করে বসবে লোকটাকে। লক্ষ রেখো মেয়েটার দিকে, রানা। ও এখন কোথায়? তোমার হোটেলে?

জ্বী, স্যার, জবাব দিয়েছে রানা। গভীর ঘুম দিচ্ছে। ওকে মিকি ফিন খাইয়ে দিয়েছি।

.

ছোট ব্রিজটা পেরিয়ে, মি. হথর্নের হুঁড়ি ও চরিত্রের সঙ্গে মানানসই চলনভঙ্গি রপ্ত করে নিতে, একটুক্ষণের জন্যে বিরতি নিল মাসুদ রানা। ঝট করে চারদিকে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে ভুড়িটা হাতিয়ে যথাস্থানে ফের বসিয়ে নিল।

তিন মাস আগে, মেজর জেনারেল রাহাত খানের অফিসে মনটা চলে গেল ওর। বস্ তখনই আভাস দিয়েছিলেন, শীঘ্রি সুইটজারল্যান্ড যেতে হতে পারে ওকে।

তারপর তো ব্রিফিঙের নামে সোহেলের ওই বকবকানি। সুইস ব্যাঙ্ক ও ফ্রেঞ্চ কী সম্পর্কে কান পচিয়ে ছেড়েছিল ওর।

বিশেষ করে জেনেভা আর বার্নের সুইস ব্যাঙ্কগুলো, ডিপোজিটরদের চেনার জন্যে গোপন কোড ব্যবহার করে থাকে, বলে সোহেল। এই অ্যাকাউন্টগুলো এমনই ক্লোজলি গার্ড দেয়া হয় যে-কী আর বলব-কাগজে কলমে কিছুই পাবি না। কোড নম্বরগুলো মুখস্থ করা হয়।

শুনে হাঁ হয়ে গেছে রানা। বলে কি শালা? ডিপোজিটর তার কোড নম্বর মনে রাখতে পারে, কিন্তু ব্যাঙ্ক ম্যানেজার কিভাবে?

সোজা, কথা কেড়ে নিয়েছে সোহেল। অবশ্য তোর কাছে সবই কঠিন। রানাকে চোখ পাকাতে দেখে মুখ টিপে হেসে ফের বলে চলে, ওদের অনেক ম্যানেজার আর সহকারী থাকে। কাজেই অল্প কয়েকজনের কোড নম্বর মুখস্থ করে রাখা এমন কোন কঠিন কাজ নয়, বোঝা গেছে, বুন্ধু কাহিকে?

মুখ বুজে গালি-গালাজ হজম করতে করতে সোহেলের কথামত পান। করেছে রানা।

এবার আয় ফ্রেঞ্চ কী-র প্রসঙ্গে। এই যে দেখ, একটা পিচ্চি গ্যাজিট। জীবনেও তো দেখিসনি, আদেখিলে কোনখানের, আগে আশ মিটিয়ে দেখে। নে। স্টীলের খুদে রডটা রানার উদ্দেশে ছুঁড়ে দেয় সোহেল।

জিনিসটা লুফে নিয়ে ভাল করে লক্ষ করে রানা।

এই সো কল্ড চাবিগুলো মুখস্থ করা কোড নম্বরের জায়গা নেয়। বড়সড় কোন ভল্ট ভাড়া দেয়া হলে সচরাচর ব্যবহার করা হয় এগুলো। সাধারণ সেফ ডিপোজিট বক্স হলে নয়। এই রড, কিংবা চাবি, ভল্টলকের মাঝখানের বিশেষ একটা গর্তে ঢোকানো হয়। ক্লায়েন্ট আর ব্যাঙ্ক ম্যানেজারের সামনে ভল্ট লক করা হলে, গর্তে গুঁজে দেয়া হয় ফ্রেঞ্চ কী। তারপর বিশেষভাবে তৈরি একটা। করাত দিয়ে কেটে ফেলা হয় ওটাকে, ফলে চাবিটার দুপ্রান্তে স্পেশাল চিহ্ন রয়ে যায়। লকের ভেতর ঢুকে থাকে চাবির একটা অংশ। বাকি অর্ধেকটা দিয়ে দেয়া হয় ক্লায়েন্টকে। চাবির দুটো অংশ ম্যাচ করলে পরই কেবল খোলা যাবে ভল্ট, কাটা অংশ পরস্পর জুড়তে হবে ভল্ট খুলতে হলে। বিশেষভাবে তৈরি। ওই করাতটাকেও এরপর ধ্বংস করে দেয়া হয়। দুটো চাবি কখনোই এক হবে। অর্থাৎ বিশেষ ভল্টটা খুলতে বিশেষ, ওই চাবি লাগবে, এছাড়া হচ্ছে না।

কিন্তু ধর, ক্লায়েন্ট যদি কাউকে টুকরোটা দিয়ে দেয়, কিংবা ওটা চুরি যায়? খেই ধরিয়ে দেয় রানা।

এক্ষেত্রেও ব্যাপারটা ঠিক তাই ঘটেছে। শোনা যায়, ইয়ামাগুচি নাকাতা। আর কার্ল ব্রিগল যার যার ছেলেকে দিয়ে গেছে চাবির টুকরো।

আবার বর্তমানে ফিরে এল রানা। হিদেতোশি নাকাতা ও রুডলফ ব্রিগল এখন উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া চাবির টুকরো জুড়ে সোনার চিতাবাঘটা হাতাতে চাইছে।

…মি. উইলিয়াম হথর্ন ফিরতি পথ ধরে, থপথপ করে হোটেলের উদ্দেশে হেঁটে চলেছে। মান্যবর ব্যক্তিটি ভুড়ি দুলিয়ে, খোয়া বিছানো গলিটা দিয়ে হাঁটার সময় ভয়ানক লজ্জিত বোধ করছে। তার মতন এতবড় একজন বিজনেস ম্যাগনেট কিনা এই নোংরা গলিপথ ধরে…ছি, আর ভাবতে পারল না সে। জেনেভার বাসিন্দারা যার যার দৈনন্দিন কাজে পথে নামায় ব্যস্ত হয়ে উঠেছে সড়কগুলো। হোঁতকা আমেরিকানটির দিকে এখন কারও দৃষ্টিক্ষেপের সময় নেই। খানিকটা অভিমান মত হলো রানার। ছদ্মবেশ ধরতে খাটুনি কি কম? বাইক ও ছোট ছোট মোটর গাড়িগুলো হর্ন বাজিয়ে কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে। সূর্য এমুহূর্তে আধ ঘণ্টা ওপরে অবস্থান নিয়েছে, নির্মল সোনালী আলো। অকাতরে বিলিয়ে দিচ্ছে গলি, তস্যগলিতে। বাতাসে প্রথম শরতের ফিকে গন্ধ।

রিস্টওয়াচ বলছে ঝাড়া পঁচিশ মিনিট ধরে হাঁটছে রানা। আর দুই, বড়জোর তিন মিনিটের মধ্যে হোটেলে পৌঁছে যাবে ও।

লাগল আসলে পাক্কা দুমিনিট। গোলগাল আমেরিকান ভদ্রলোকটি হেলতে দুলতে বাঁক ঘুরে অ্যালী ডি নেপোলিয়নে ঢুকল। এঁদো গলির আবার গালভরা। নাম, বলল মনে মনে, এবার আচমকা ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়ল। ঝটিতি– বিস্ময় ও সতর্কতার লেশমাত্র না দেখিয়ে-ঘুরে দাঁড়িয়ে দৃষ্টি স্থাপন করল ছোট্ট একটা পুরানো বইয়ের দোকানের জানালায়। মুহূর্তে উবে গেছে নাদুসনুদুস মি. হথর্নের চরিত্র। সে জায়গা দখল করে নিয়েছে এখন মাসুদ রানা। প্রতিটি ইন্দ্রিয় সজাগ তার, সতর্ক দেহের প্রতিটি পেশি। দেখেই চিনেছে রানা। ওই যে, হোটেল হিলসনের সামনে দুজন ওয়াচার।

গাট্টাগোট্টা লোক দুজনের গায়ে কালো রেইনকোট ও মাথায় নরম ফেল্ট হ্যাট। হোটেলের উল্টোদিকে, একটা কাঠের হোর্ডিঙে অলস ভঙ্গিতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ওরা, সিগারেট টানছে আর একঘেয়ে গোমড়া দৃষ্টিতে চেয়ে। রয়েছে হোটেলটার অন্ধকারময় প্রবেশমুখের দিকে।

 দোকানের জানালায় মন দিয়ে মেডিকেলের ধুলো পড়া মোটা বইগুলো। দেখার ভান করছে এখন রানা। শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত লয়ে বইছে ওর, অতিপরিচিত রোমাঞ্চের অনুভূতি হচ্ছে, সঙ্গে খানিকটা ভীতিও মিশেছে। অতীতে অসংখ্যবার এই বিশেষ অনুভূতিটা জীবন রক্ষা করেছে ওর।

পুলিস না! সেকেন্ডের ভগ্নাংশের মধ্যে রানার মস্তিষ্ক সম্ভাবনাটা যাচাই করে বাদ করে দিল। ওর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চোখ বলছে লোক দুটো পুলিস নয়। পুলিস আসার কোন কারণ নেই, কেনেট ডাহলিনের কাগজপত্রে তো কোন গলদ নেই। আধ মাতাল নাইট পোর্টার, রানার কাছ থেকে অগ্রিম ভাড়া নিয়েছিল যে, ব্যারোনেসের দিকে তাকায়ইনি বলতে গেলে। আরও হাজারো গেস্টের মতন এরাও এসেছে, কঘণ্টা বাদে চলেও যাবে। রানার হাতে চাবি গুঁজে দিয়ে কাউচে আবার নাক ডাকাতে চলে গিয়েছিল লোকটা।

যেখান থেকে এইমাত্র এসেছে সেই কোনাটার দিকে পিছাতে শুরু করল রানা। একপাশে কাত হয়ে পিছাচ্ছে ও, একেকবারে এক ফুট এক ফুট করে, পাহারাদার, দুজনের ওপর ডান চোখ স্থির রেখে। একজনকে ওর দিকে একনজর চাইতে দেখল। মি. হথর্নের মোটা শরীরের ভেতরে কাঠ হয়ে গেল রানা, অপেক্ষমাণ। ওরা যদি স্পট করে থাকে রানাকে, মেয়েটা যদি চিনিয়ে। দিয়ে থাকে, তবে চেনাবে ডাহলিনকে। উইলিয়াম হথর্নকে নয়। তবু সাবধানের মার নেই।

 যে লোকটা তাকিয়েছিল ওর দিকে, সে এবার সিগারেটের শেষটুকু ড্রেনে টোকা মেরে ফেলে দিল। থুথু ছিটাল। সঙ্গীকে কিছু একটা বলতে, হেসে উঠল দুজনেই। এবার আবার ক্লান্তিকর নজরদারী আরম্ভ করল।

সাঁত করে কোণ ঘুরে বেরিয়ে এল রানা। মি. হথনের ছদ্মবেশ খসে পড়ছে দ্রুত। দৌড় পায়ে হাঁটছে এখন সে, হোটেলের পেছন দিকের ছোট অ্যালিটার উদ্দেশে এগোচ্ছে। জানালা দিয়ে আগেই দেখে রেখেছিল ওটা।

ব্যারোনেস গ্রাফ এখনও রয়েছে ওই নোংরা হোটেল কামরাটায়। হাত-পা মুখ বাধা অবস্থায়। সম্ভবত এখনও ঘুমের রাজ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। নিরপেক্ষ হলে মহাবিপদের মধ্যে রয়েছে সে। আর তা যদি না হয়-সেটাও জানতে হবে রানাকে! কারণ পাহারাদার দুজন যদি পুলিস না হয় তবে নির্ঘাত ব্রিগলের আর নয়তো নাকাতার অনুচর। কিংবা দুজনেরই। ধরে নেয়া যায়, দুজনেই এখন জেনেভায়, এবং খুব সম্ভব দলবলের সঙ্গে যোগ দিয়েছে।

অ্যালির বাঁক ঘুরে দৌড় লাগাল রানা। রবারের পেটটার একটা ভালভ খুলে দিতে হুশ করে বেরিয়ে গেল বাতাস। জিনিসটা চুপসে মিশে গেল চামড়ার পেটের সঙ্গে।

দৌড়নোর ফাঁকে বিশ্বস্ত সঙ্গী তিনটিকে পরখ করে নিল রানা। লুগারটা বেল্টে, প্লাস্টিকের হোলস্টারে নিরাপদে রয়েছে; আস্তিনে তৈরি সাপের মতন বিষাক্ত স্টিলেটো; গ্যাসের খুদে অথচ মারাত্মক বড়িটা পকেটে বসে শুধু। হুকুমের প্রহর গুণছে। দৌড়চ্ছে আর ভাবছে রানা কোটা ব্যবহার করবে, যদি প্রয়োজন পড়ে। মনে প্রাণে চাইছে দরকার পড়বে না। লুগারটা শোরগোল সৃষ্টি করবে, মনোযোগ কাড়তে না চাইলে অস্ত্রটা ব্যবহার না করাই ভাল। আর প্রায় অচেনা হোটেলরূমে পয়জন গ্যাস লোফালুফি করার কোন অর্থ নেই। তারমানে গতি নেই স্টিলেটো ছাড়া। নিঃশব্দ অথচ ভয়ঙ্কর।

হোটেল হিলসনের পেছনের ফেন্সটা এক লাফে উড়ে পেরোল রানা, টাল সামলে নিল ল্যান্ড করে। ভুল হতে পারে.ওর, ব্যাক ইয়ার্ডের আবর্জনার মধ্য দিয়ে পথ করে এগোনোর সময় স্বীকার করল ও মনে মনে। সত্যিকারের বিপদ এখনও হয়তো আসেইনি, নিছক কল্পনা করে নিচ্ছে মগজ। লোক দুটোকে হয়তো এমনি এমনিই পাহারায় লাগানো হয়েছে। ভেতরে হয়তো দলের আর কেউ নেই। কিন্তু রানার মন বলছে ভুল করছে না ও। ওর ইন্দ্রিয় বিপদের সঙ্কেত দিচ্ছে। মেয়েটির এবং ওর দুজনের জন্যেই হুশিয়ারি জানান দিচ্ছে। এবং মাসুদ রানার ওয়ার্নিং সিস্টেম ভুল করে কদাচ।

 মরচে ধরা ফায়ার এস্কেপটা দিয়ে সর্পিল গতিতে উঠে যাচ্ছে রানা। নিঃশব্দে। রবারের ভুড়িটা খসানোতে মি. হথর্নের দুসাইজ বড় কাপড়-চোপড় লটপট করছে মাসুদ রানার মেদহীন, ছিপছিপে শরীরে। ওর ঘরের জানালাটার। দিকে অগ্রসর হয়ে গতি সামান্য শ্লথ করল রানা, উবু হয়ে শেষ কয়েক ফুট মাংসের উদ্দেশে এগোনো বাঘের ক্ষিপ্রতায় পেরিয়ে গেল। সাবধানে। ধুলোমলিন জানালাটার কাঁচ ভেদ করে উঁকি দিল। ভেতরের দৃশ্য দেখে দাতে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরল ও। ব্যাপারটা ঘুণাক্ষরেও আশা করেনি। ব্যারোনেস জুলি গ্রাফ বিপদাপন্ন।

মিস্টার হিদেতোশি নাকাতা, সদ্য কারামুক্ত অপরাধী, মোটেই ভদ্রলোক নয়। ছোট্ট রূমটায় দাঁড়িয়ে সে, অচেতন যুবতীর দিকে চেয়ে রয়েছে একদৃষ্টে। ঠোঁট চাটছে লোকটা, মুখটা হাঁ হয়ে রয়েছে তার, লোলুপ দৃষ্টিতে ফুটে বেরোচ্ছে প্রশংসা। বেঁটে জাপানীটার উত্তেজিত শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ পর্যন্ত শুনতে পাচ্ছে রানা।

নাকাতাকে হঠাৎ করে একটু চিন্তিত মনে হলো। ঘরের দরজাটার কাছে। গিয়ে ওটা বন্ধ করে এল। লকটা যতটা ভেবেছিল ততটা পোক্ত না, ভাবল। রানা। এবং তালা খোলার যন্ত্র ওর একার কাছেই নয়, অন্যদের কাছেও রয়েছে।

সোফার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে নাকাতা। জানালার দিকে ক্ৰক্ষেপ করার কথা মাথাতে এলই না তার। লালসায় ধকধক করে জ্বলছে চোখজোড়া। পরিপাটি বিজনেস স্যুট পরিহিত নাকাতাকে রানার চোখে দেখাচ্ছে, একটা লিকলিকে, হলদে মুখো বানরের মত।

ঘুমন্ত যুবতীর গায়ের কাছ বরাবর আরেকটু সরে এল নাকাতা। বাহ্যত মনে হলো জুলি গ্রাফ ঘুমের মধ্যে লাফ-ঝাঁপ করছিল, কারণ তার ফর্সা উরুদ্বয় স্কার্টের আবরণ সরিয়ে উন্মুক্ত হয়ে পড়েছে। আশপাশে ও নিচে চকিত চাহনি বুলিয়ে নিল রানা। ব্যাক ইয়ার্ড খা-খা করছে। ফায়ার এস্কেপে ওকে গুটিসুটি মেরে বসে থাকতে দেখার মত কেউ নেই কাছেপিঠে। হোটেলের সামনে অবস্থানরত লোক দুটো, নাকাতাকে নিয়ে এলাকা ছাড়ার জন্যে নিশ্চয়ই অপেক্ষা করবে।

মি. হিদেতোশি নাকাতা এমুহর্তে মেয়েটির সামনে হাঁটু গেড়ে বসেছে, গোড়ালির স্ট্র্যাপ খুলে কুতকুতে চোখে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছে ফর্সা ধবধবে শরীর। সময় হয়নি, সিদ্ধান্ত নিল রানা। বদমাশটা ব্যারোনেসের জন্যে ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ানো মাত্র হস্তক্ষেপ করবে ও।

 জাপানীটা নিশ্চয়ই ভেবে মরছে কে বেঁধে রেখে গেল যুবতাঁকে দাঁত বেরিয়ে পড়ল রানার।

কিন্তু না, ভাবাভাবির ধার ধারল না নাকাতা। অত সময় নেই তার হাতে। সুবর্ণ সুযোগ হেলায় হারাতে রাজি নয় সে। লোকটা ব্যারোনেসের স্কার্টে হাত রাখতে ঘৃণায় ও রাগে সর্বাঙ্গ জ্বলে উঠল রানার।

নিজেকে গুরুতর আহত না করে, কাঁচের জানালা ভাঙার কায়দা বহু আগেই রপ্ত করেছে রানা। পিছনে সরে গেল ও, জানালাটার দিকে পিঠ অর্ধেকখানি ঘুরিয়ে নিল; তারপর প্রচণ্ড বেগে ক্রুদ্ধ, প্রতিহিংসাপরায়ণ বুলডোজারের মতন কাঁচ ভেঙে, হুড়মুড় করে ঘরের ভেতর গিয়ে পড়ল।

<

Super User