তারানাকে ইন্টারকনের লবিতে পৌঁছে দিয়ে হেঁটেই নিজের হোটেলে ফিরছে রানা। বেশ রাত হয়েছে, আর রাতের বেলাই রিয়ো যেন জেগে ওঠে। চওড়া ফুটপাথ দখল করে নিয়েছে হকাররা, তাদের দোকানের সামনে দেশী-বিদেশী ট্যুরিস্টরা ভিড় জমিয়েছে। বিশ্বাস করা কঠিন, তবে ঘটনা সত্য-এই এভিনেডা রিয়ো ব্রাঙ্কোয় রিকন্ডিশন করা গাড়ি থেকে শুরু করে হীরের আঙটি পর্যন্ত কিনতে পাওয়া যায়।

বাঁক নিয়ে কয়েকটা রাস্তা পার হয়ে এলো রানা, কোথাও একটা খালি ট্যাক্সি নেই। এদিকের রাস্তা প্রায় নির্জন, দোকানপাট বেশিরভাগই বন্ধ। সামনের একটা দোকানের দরজায় গাঢ় ছায়া, সেই ছায়া থেকে বেরিয়ে এসে রানার দিকে মুঠো করা হাত চালাল এক লোক। মুঠোর ভেতর একটা ছুরির হাতল।

দোকানটাকে পাশ কাটিয়ে প্রায় চলে এসেছে রানা, ঠিক এই সময় হামলাটা হলো। লোকটা আর যদি এক সেকেন্ড দেরি করত, তাকে রানা দেখতেই পেত না; হামলাটা সফল হোত, পিঠে ছুরি খেয়ে ফুটপাথে পড়ে থাকত ও। কিন্তু কাজটা করার ব্যাকুলতা আর উদ্বেগ তাকে এক সেকেন্ড আগে নড়িয়ে দিয়েছে, আর তার সেই নড়াটা ধরা পড়ে গেছে রানার চোখের কোণে।

ছুরির ফলা পিঠে গাঁথতে যাচ্ছে, দ্রুত মোচড় খেয়ে আঘাতটা ঠেকাবার জন্যে বাঁ হাত বাড়িয়ে দিল রানা। কব্জির সঙ্গে কব্জির শক্তি পরীক্ষা চলল এক কি দুই সেকেন্ড। ছুরির ফলা জ্যাকেট ও শার্ট চিরে দিল ইঞ্চি তিনেক, তারপর লাল রক্তের অগভীর একটা খাল কাটল ওর বাম বাহুতে। লোকটার ভার এড়াবার চেষ্টা না করে নিজের ওপর তাকে আসতে দিল রানা, তারপর তার সঙ্গে নিজেও ঘুরল, দু’হাতে ঠেলে দিল পাশের বিল্ডিঙের নিরেট দেয়ালে।

লোকটা বাকারা। তারানাকে না পাবার আগেই যদি হারাতে হয়, এই ভয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীকে খুন করতে চাইছে। অন্তত প্রথমে রানা এটাই ভাবল। তারপর দেখল, না-এ লোকটা বাকারার চেয়ে লম্বা, বয়সও বেশি। ব্রাজিলিয়ান গুণ্ডা।

খালি হাতটা দিয়ে পিস্তল বের করবে রানা, কিন্তু লোকটা ওকে নিজের খালি হাত দিয়ে ধরে রেখেছে। আবার ছুরি চালাল সে, এবার টার্গেট করল রানার মুখ। মাথাটা ঝট করে সরিয়ে নিতে পারল ও, তবে কানের লতিতে ফলার খোঁচা লাগল। তৃতীয়বার ছুরি তুলল সে, শরীরের সমস্ত ভার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছে রানার গায়ে।

গতি তার খুব বেশি হয়ে গেল। রানাকে তো ফেললই, নিজেও দড়াম করে ফুটপাতে আছাড় খেলো। ডান হাতের মোক্ষম একটা ঘুসি মারল রানা তার চোয়ালে। কি আশ্চর্য! যেখানে হাড় ভেঙে যাবার কথা, ভাব দেখে মনে হলো লোকটা কোন ব্যথাই পায়নি। পরস্পরকে ধরে একটা গড়ান খেলো ওরা, রানাকে এখনও প্রতি মুহূর্তে প্রাণপণ চেষ্টা করতে হচ্ছে শরীরের এখানে সেখানে লক্ষ্য করে চালানো ছুরিটা যেন ওর নাগাল না পায়। ইচ্ছা এবং চেষ্টা দুটোই আছে, হয় পিস্তল নাহয় ছুরিটা বের করবে, কিন্তু কোন সুযোগই পাওয়া যাচ্ছে না।

এক মুহূর্তের জন্যে রানার শরীরে চড়াও হলো প্রকাণ্ড প্রতিদ্বন্দ্বী। পর্তুগীজ ভাষায় খিস্তির সঙ্গে ছুরির কোপ মারল ওর বুক বরাবর। ফলাটা চওড়া, তবে বেশি লম্বা নয়, ডগাটা ক্ষুরের মত ধারাল। একেবারে শেষ মুহূর্তে ছুরি ধরা হাতের কব্জি ধরল রানা, অন্ধকারেও দেখল চওড়া ফলা চকচক করছে। দু’জনের দুটো হাত থরথর করে কাঁপছে-খুনী ফলাটা গাঁথবে, রানা গাঁথতে দেবে না। ডান হাতটা কোন রকমে মুক্ত করে নিয়ে তার মুখে আঙুল চালাল ও। আঙুলের ডগায় তার চোখ, অনুভব করতে পেরে নখ সহ আঙুলটা ভেতরে সেঁধিয়ে দেয়ার চেষ্টা করল রানা-হাত ও বাহুর পেশি ফুলে উঠছে। চোখের মণি ফট্‌ শব্দ করে ফেটে গেল। গর্তটা থেকে বেরিয়ে এলো রানার ভেজা আঙুল।

‘মারে। বাপরে। আল্লারে!’ যন্ত্রণায় কোঁকাচ্ছে লোকটা, খালি হাতে চোখ চেপে ধরেছে, ভুলে গেছে অপর হাতে ধরা ছুরির কথা। কাতর একটা অস্ফুট আওয়াজ করে রানার গা থেকে গড়িয়ে পড়ল সে।

ইতিমধ্যে রানার হাতে নিজের ছুরি বেরিয়ে এসেছে। তবে প্রায় অজ্ঞান একজন লোককে খুন করতে পারবে না ও। তাছাড়া, মারপিট দেখে লোকজন যেহেতু সরে গেছে, আর পুলিসও আসছে না; লোকটাকে কথা বলানো যায় কিনা দেখতে চায় ও। বসতে যাবে, ঘ্যাঁচ করে আবার ছুরি চালাল লোকটা। এবার ব্যর্থ হলো না। অন্ধের মত চালিয়েছিল ছুরিটা, যেখানে লাগার কথা সেখানেই লাগল। গতি মন্থরই ছিল, তারপরও পা সরিয়ে নেয়ার সময় পায়নি রানা। ফলে ওর একটা জুতোর নাক কাটা গেল। খুন করার জন্যে নয়, আত্মরক্ষার তাগিদে নিজের অজান্তে ছুরি চালিয়েছে রানাও; ফলাটা অদৃশ্য হয়ে গেল লোকটার পাঁজরের ফাঁক দিয়ে ভেতরে। হাতল টেনে ছুরিটা বের করল রানা, লোকটার শার্টে রক্ত মুছল। কয়েক সেকেন্ড ছটফট করে স্থির হয়ে গেল দেহটা।

সার্চ করে তেমন কিছু পাওয়া গেল না। তবে একটা আইডেনটিটি কার্ড ফাঁস করে দিল সব। লোকটা সেরবেরাস ইমপোর্ট-এক্সপোর্ট কোম্পানির একজন কর্মচারী। দেখা যাচ্ছে কার্লোস মোলাডো যতটা ভাবা গিয়েছিল তারচেয়ে অনেক সিরিয়াসলি নিয়েছে ওকে। কিংবা হয়তো এথেন্সে মারকাসকে ফোন করেছিল, আর মারকাস বলেছে শেখ মাসুদ নামে কারও সঙ্গে তার কোন কথা হয়নি। মোলাডো সম্ভবত ওকে ইন্টারপোল বা জাতিসংঘের অ্যান্টি-ড্রাগস স্কোয়াডের কোন লোক বলে ধরে নিয়েছে। যাই ধরে নিয়ে থাকুক, ওর পিছনে লোক লাগিয়েছে সে। কাজেই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রিয়ো ছেড়ে পারাকাটুতে চলে যাওয়া উচিত ওর। হোটেলে ফেরার পথে আর কিছু ঘটল না। রাতটাও কাটল নির্বিঘ্নে।

সকাল ন’টায় এভেনিডা প্রেসিডেন্টা ভারগাস-এ চলে এলো রানা, বসল ছোট্ট একটা কাফেতে; একটু পর বাকারাকে নিয়ে ওর টেবিলে হাজির হলো তারানা। একসঙ্গে কাজ করতে হবে, এই সুযোগে তারানার সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ হবার সুযোগ পাবে রানা, সম্ভবত এই কথা ভেবে খুবই উদ্বিগড়ব হয়ে পড়েছে বাকারা। তার আচরণ আগের চেয়েও কর্কশ ও অমার্জিত লাগল রানার।

রামাল্লা থেকে পাঠানো ফ্যাক্স বার্তাটা কাল রাতেই পেয়েছে তারানা, তাতে ওদের দু’জনকে রানার সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। দু’দলেরই উদ্দেশ্য এক-আকার্ডিয়া মারকাসকে ধরা।

বাকারা প্রস্তাব দিল রানাকে, ‘ডাফু সালজুনাস সম্পর্কে তথ্য দরকার হলে পারাকাটুতে আপনি একা যান না কেন।’ তার কালো চোখে অকারণ জিদ, সামনের কফি ভর্তি কাপ একবার ছোঁয়নি পর্যন্ত। ‘আমাদের মিশন সম্পূর্ণ আলাদা-মারকাসকে খোঁজা, এবং তাকে খতম করা। জানা কথা, পারাকাটুতে তাকে আমরা পাব না।’

তার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে তারানার দিকে তাকাল রানা। ‘তুমি কি বলো?’ জিজ্ঞেস করল ও।

‘আমি কি চাই তা আগেই হাবিবকে বলে দিয়েছি,’ বলল তারানা, একটু বিব্রত। ‘তোমার অ্যাপ্রোচ শুধু তোমার জন্যে নয়, আমাদের জন্যেও সঠিক।’

‘তারানা!’ চাপা গলায় হিসহিস করে উঠল বাকারা। ‘সেক্স তোমার মাথা খারাপ করে দিয়েছে! এই মাসুদ রানা নির্ঘাত তোমার লাভার। উনি যা-ই বলুন, সবকিছুতে তুমি যুক্তি খুঁজে পাচ্ছ।’

‘ওহ্‌, হাবিব, প্লীজ!’ নিচু গলায় বলল তারানা; শুধু বিব্রত নয়, রীতিমত অপমান বোধ করছে সে।

রানা বলল, ‘কাউকে জ্ঞানদান করা আমার স্বভাব নয়। তবে একসঙ্গে কাজ করতে হলে ভাবাবেগের লাগাম সবাইকেই টেনে রাখতে হবে।’

ঝট্‌ করে চেয়ার ছাড়ল বাকারা, দুই কোমরে হাত রেখে বলল, ‘দেখুন, মিস্টার মাসুদ রানা…’

‘বাকারা, বসো!’ শান্ত, কিন্তু দৃঢ় কর্তৃত্বের সুরে নির্দেশ দিল তারানা।

ফোঁস-ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলছে বাকারা, তারানার দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে থাকল-মনে হলো নির্দেশটা অমান্যই করতে যাচ্ছে। তবে না, ধীরে ধীরে আবার বসল সে। নিঃশ্বাসের সঙ্গে কি বলল বোঝা গেল না, তবে রানার চোখের দিকে তাকাচ্ছে না।

‘এরপর যদি কখনও আবার এরকম ভুল করো, তোমাকে কঠিন শাস্তি পেতে হবে, হাবিব,’ বলল তারানা। ‘আমি কি বলছি বুঝতে পারছ তো?’

বাকারা ইতস্তত করছে। কথা যখন বেরুল, তাতে ঝাঁঝের মাত্রা কম নয়। ‘হ্যাঁ।’

‘তুমি যা ভাবছ তা আসলে সত্যি নয়। রানার সঙ্গে আমার বা আমার সঙ্গে রানার ওরকম কোন সম্পর্ক কোনকালে ছিল না, আজও হয়নি। হবে যে, সে সম্ভাবনাও এখন আর নেই-কারণ এখন আমি অন্য একজনকে ভালবাসি। তবে যেহেতু রানা একজন ভদ্রলোক, আর তাকে অপমান করা হয়েছে, আমাদের উচিত তার কাছে ক্ষমা চাওয়া। তোমার কি মনে হয়?’

বাকারা বুঝতে পারছে, ক্ষমাটা তাকেই চাইতে বলা হচ্ছে। টেবিলে পড়ে থাকা তার হাত দুটো শক্ত মুঠো হয়ে গেল। ‘তুমি যা বলবে তাই হবে,’ অবশেষে বলল সে।

‘আমি বলছি, ক্ষমা চাওয়া উচিত।’

রানার দিকে তাকাল না বাকারা। কাফে’র ভেতর যথেষ্ট ঠাণ্ডা, তারপরও ঘামছে সে। ‘ঠিক আছে। আমার ভুল হয়েছে-দুঃখিত।’

‘আরেকটা কথা,’ বলল তারানা। ‘তুমি হয়তো ধরে নিয়েছ একই অ্যাসাইনমেন্টে কাজ করছি বলে আমার সঙ্গে ব্যক্তিগত কিছু একটা ঘটবে তোমার। কিন্তু আসলে তা ঘটবে না। এই ব্যাপারে তোমার মনে কোন ভুল ধারণা থাকা উচিত নয়।’

‘মানলাম, উচিত নয়।’ মাথা নত করে আছে বাকারা।

‘এখন রানার সঙ্গে পারাকাটুতে যাচ্ছি আমি,’ বলল তারানা।

‘তুমি যদি মনে করো কাজটা বোকামি হচ্ছে, আমি কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করব অ্যাসাইনমেন্ট থেকে তোমাকে যেন সরিয়ে নেয়া হয়।’

এতক্ষণে মুখ তুলে তারানার দিকে তাকাল বাকারা। তার চোখ-মুখ বদলে গেছে, অনেক নরম লাগছে দেখতে। ‘তুমি জানো আমি তোমাকে একা ছাড়তে পারব না।’ রানার দিকে একবার তাকাল সে। ‘তুমি আর মিস্টার রানাই নেতৃত্ব দিচ্ছ, বোঝা গেল। তুমি গেলে আমিও যাব। ’

রানাকে তারানা জিজ্ঞেস করল, ‘কখন যাচ্ছি আমরা?’

চুপচাপ বসে ওদের আলাপ শুনছিল রানা। মনে মনে হাসছিল তারানার নির্জলা মিথ্যা শুনে। আগের অ্যাসাইনমেন্টে অনেক কিছুই ঘটেছিল ওদের মধ্যে, কিন্তু বাকারাকে সেসব জানতে দিতে চাইছে না ও। তবে কি ‘অন্য একজন’কে ভালবাসার কথাটাও মিথ্যা? বাকারার আক্রোশ থেকে বাঁচাতে চেষ্টা করছে রানাকে বা নিজেকে?

‘আমি অযথা দেরি করতে চাই না,’ বলল রানা।

‘চলো তাহলে রেন্ট-আ-কার অফিস থেকে একটা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ি,’ বলল তারানা। ‘জানো তো, আমাদেরকে টিজুকা বনভূমির ভেতর দিয়ে যেতে হবে।’

‘আমরা রওনা হব সন্ধ্যায়,’ বলল রানা। ‘যা গরম পড়েছে, রাতে গাড়ি চালাতেই সুবিধে।’

‘আমার তাতে কোন আপত্তি নেই,’ জানাল বাকারা। চেহারায় অস্বাভাবিক শান্ত, ঠাণ্ডা একটা ভাব ফুটে আছে। এটা কিসের লক্ষণ, রানা বুঝতে পারছে না। সরল ছেলেটা কি বিশ্বাস করেছে তারানার সব কথা?

পুরানো একটা টয়োটা ল্যান্ড রোভার নিয়ে সন্ধ্যায় রওনা হলো ওরা। ব্রাজিলিয়া হাইওয়ে ধরে ছুটল গাড়ি, নাম হাইওয়ে হলেও রাস্তার অবস্থা বিশেষ সুবিধের নয়। বাংলাদেশের রাজপথের কথা মনে পড়ছে রানার। সারা দুপুর আর বিকেলটা ওরা বিশ্রাম নিয়েছে, তা সত্ত্বেও ঘনঘন প্রবল ঝাঁকি অল্পক্ষণেই ক্লান্ত করে তুলল ওদেরকে। সারারাত গাড়ি চালিয়েও খুব বেশি দূর এগোনো গেল না। পরদিন সবচেয়ে গরমের সময়টা গাড়ি থামিয়ে ছায়ায় শুয়ে-বসে কাটাবার কথা ভাবা হলেও সেটা কাজে পরিণত করা গেল না মশা-মাছির উপদ্রবে। দ্বিতীয়বার থামল ওরা ছোট্ট এক গ্রামের ভেতর, রেস্তোরাঁর সামনে। রেস্তোরাঁর মালিক লোকটা ভাল, রানাকে ডেকে সাবধান করে দিয়ে বলল, ‘আপনারা বিদেশী মানুষ, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গ্রাম থেকে বেরিয়ে যান। গ্রামের কেউ নয় তারা, জঙ্গল থেকে আসে। বিদেশী কাউকে দেখলেই হয়, যা পাবে সব কেড়ে নেবে।’

তাকে ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় নিল রানা।

আরও একটা রাত গাড়ি চালিয়ে পরদিন সকালে পারাকাটুতে পৌঁছাল ওরা।

হাইওয়ের পাশে পারাকাটু ছোট একটা গ্রাম। গ্রাম হলেও, সাদা চুনকাম করা পাকা ঘরগুলোয় কয়েক হাজার লোক বাস করে। সারি সারি হোটেল-রেস্তোরাঁও দেখা গেল। পালা করে গাড়ি চালাচ্ছে রানা ও বাকারা, রানার নির্দেশে গ্রামে থামল না ওদের ল্যান্ড রোভার। মারকাসের লোকজন গ্রামে খাওয়াদাওয়া বা কেনাকাটা করতে আসতে পারে, ওদেরকে দেখতে পেলে সতর্ক হয়ে যাবে।

পারাকাটু থেকে প্ল্যানটেশনের দিকে রাস্তা পাওয়া যাবে মাইল পাঁচেক। মেটো পথ, পথ না বলে খানা-খন্দের সমষ্টি বললেই হয়। দু’পাশে গভীর জঙ্গল, ভেতরটা দিনের বেলাও প্রায় অন্ধকার। পথ কোথাও এতই সরু যে জানালা গলে গাছপালার ডাল ল্যান্ড রোভারের ভেতরে ঢুকে আরোহীদের চোখে-মুখে ঝাপটা মারতে চাইছে। বাধ্য হয়েই গাড়ি আস্তে আস্তে চালাচ্ছে বাকারা, এই সুযোগে ঝাঁক ঝাঁক মশা ভেতরে ঢুকে ওদের উন্মুক্ত ত্বকে হামলা চালাল। রানা এজেন্সির রিয়ো শাখার প্রধান হাসান রানাকে জানিয়েছে, এই পথ থেকে আরও অন্তত দশ মাইল দূরে মারকাসের প্ল্যানটেশন। ওদের প্ল্যান, পথ যেটুকু পাওয়া যাবে তার অর্ধেকটা ব্যবহার করবে। সেটুকু পার হতেই ঘণ্টাখানেক লেগে গেল। নেহাতই ভাগ্য বলতে হবে যে উল্টোদিক থেকে কোন গাড়ি আসেনি। এত কাছাকাছি এসে শত্রুদের চোখে ধরা পড়তে চায় না ওরা।

হাইওয়ে থেকে প্রায় ছ’মাইল দূরে ঝোপ-ঝাড়ের ভেতর ল্যান্ড রোভারটাকে লুকিয়ে রাখল ওরা। পথ নেই, জঙ্গল ভেঙে হাঁটো; প্রত্যেকের হাতে একটা করে রিপেল্যান্ট-এর ক্যান রয়েছে, মশা তাড়াবার জন্যে সেপ্র করে এগোও।

অযত্নে তৈরি করা মারকাসের র‍্যাঞ্চসদৃশ ভবনটা আকাশ ছোঁয়া একটা ইউক্যালিপটাস গাছ থেকে আধমাইল দূরে। ফাঁকা জায়গার কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে গাছটা, কাছেই উঁচু একটা কাঁটাতারের বেড়া। বেড়ার ওপারের জায়গাটাও একসময় প্ল্যানটেশনের সীমানার ভেতর ছিল, জঙ্গল সেটাকে পুনর্দখল করে নিয়েছে। গাছটাকে রানা এজেন্সির রিয়ো শাখার লোকজন কিছুদিন অবজারভেশন পোস্ট হিসেবে ব্যবহার করেছিল। ভ্যাপসা গরম আর মশা-মাছির অসহ্য উপদ্রব সহ্য করে তারানা আর বাকারাকে ওই গাছটার দিকেই নিয়ে যাচ্ছে রানা। পৌঁছাতে ঘণ্টা তিনেক লাগল ওদের। গাছটার মাথার কাছাকাছি বাঁশ ও পাম গাছের পাতা দিয়ে তৈরি একটা খুদে প্ল্যাটফর্ম আছে, প্ল্যানটেশন থেকে দেখতে পাওয়া যায় না। গাছের গায়ে বাঁশের ধাপও তৈরি করা আছে, ফলে ওপরে উঠতে কোন সমস্যা হবে না। তবে ওঠার পর দেখা গেল তিনজনই হাঁপাচ্ছে। ‘এত কষ্ট করে কোন লাভ হলো কি?’ তারানার গলায় একটু যেন রাগ।

গলায় ঝোলানো বিনকিউলারটা চোখে তুলে দূরে, প্ল্যানটেশনের দিকে তাকাল রানা। কয়েক মুহূর্ত পর তারানাকে জিজ্ঞেস করল, ‘কি দেখছ?’ তার চোখেও একটা বিনকিউলার রয়েছে।

ডাল ও পাতার ফাঁক দিয়ে গোটা ফার্ম এলাকাটা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে ওরা। মূল ভবন বা র‍্যাঞ্চ হাউসের চারপাশে ছোটবড় আরও কিছু দালান দেখা যাচ্ছে, তবে পিছনটায় ওগুলোর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি-দেখতে অনেকটা ব্যারাক-এর মত। সব মিলিয়ে বিশাল আর গুরু-গম্ভীর একটা ভাব আছে। কাঁটাতারের বেড়াটা নতুন, পুরানোটা হারিয়ে গেছে জঙ্গলের আড়ালে। নতুন বেড়াও এগিয়েছে গাছ ও ঝোপের ভেতর দিয়ে। মেটো পথে কাঁকর ছড়ানো, গাড়ি চলাচল করে; পার্কিং এরিয়াটা বেশ বড়। বেড়ার বাইরে এক সময় রাবার বাগান ছিল, পুরানো মালিক বিদায় নেয়ার পর জঙ্গল সে-সব গ্রাস করে নিয়েছে।

‘আমার একটা প্ল্যান আছে,’ চোখ থেকে নিজের বিনকিউলার নামিয়ে বলল বাকারা।

‘শোনা যাক,’ উৎসাহ দিল রানা।

‘গাড়িতে আমার স্কোপ-সাইটেড রাইফেল আছে,’ বলল বাকারা। ‘ওটা হাতে থাকলে এখানে বসে সারাদিন আমি মারকাসের লোকজনকে গুলি করতে পারব। একসময় র‍্যাঞ্চ খালি হয়ে যাবে, গুলি করার মত কাউকে পাব না। আমি বলতে চাইছি, র‌্যাঞ্চের ভেতর আমাদের ঢোকারই কোন দরকার নেই।’

‘ঘর থেকে ওদের সবাইকে তুমি বের করবে কিভাবে?’ জিজ্ঞেস করল রানা। ‘বের যদি হয়ও, যখন গুলি হবে তখন ওদেরকে তুমি ঘরের বাইরে থাকতে বাধ্যই বা করবে কিভাবে?’

‘তাছাড়া,’ বলল তারানা, ‘আমরা যদি ভেতরে না ঢুকে বাইরে থেকে হামলা চালাই, আমাদের আগে মিস্টার সালজুনাসের কাছে পৌঁছাবে ওরা। সন্দেহ নেই, খুনও করবে।’

‘ঠিক। আর সালজুনাস খুন হয়ে গেলে এখান থেকে কিছুই আমাদের জানা হবে না।’

ওদের যুক্তি মেনে নিয়ে বাকারা বলল, ‘এটা ঠিক যে সালজুনাসের নিরাপত্তা বিঘিড়বত করা যাবে না। তবে সত্যি বলছি, রাইফেল ব্যবহারের জন্যে এই জায়গাটা আদর্শ।’ কাঁধ ঝাঁকাল সে। ‘দুঃখের বিষয়, কপালে সে-সুখ নেই!’

রক্তপাতের জন্যে অস্থির হয়ে আছে ছোকরা, ভাবল রানা। তার কাছে এটা একটা শিকার অভিযান, যত বেশি পারো মারো। বিকেল পর্যন্ত প্ল্যানটেশনের ওপর নজর রাখল ওরা। লোকজন বিভিনড়ব কাজে ঘর থেকে বেরুচ্ছে, এদিক-ওদিক যাচ্ছে, সব মিলিয়ে তাদের সংখ্যা সাত-আটজনের বেশি নয়। হাসানও এরকম একটা হিসাবই দিয়েছে রানাকে।

ডাফু সালজুনাসকেও দেখতে পেল ওরা, প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে নামার ঠিক আগে। ব্যারাকসদৃশ দালানের একটা ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি, সঙ্গে একজন লোক রয়েছে। অলস পায়ে হাঁটতে হাঁটতে র‍্যাঞ্চ হাউসের সামনে চলে এলেন, তারপর দু’এক মুহূর্ত ইতস্তত করে ভেতরে ঢুকে পড়লেন। চোখে বিনকিউলার থাকায় রানার মনে কোন সংশয় থাকল না যে এই ভদ্রলোকই ডাফু সালজুনাস। আর যাই হোক, এখানে ওরা আলেয়া বা মরীচিকার পিছু নিয়ে আসেনি।

প্ল্যাটফর্ম থেকে নামার আগে প্ল্যানটেশনে ঢোকার প্ল্যানটা ব্যাখ্যা করল রানা। ‘নিচে নেমে গাড়ির কাছে ফিরে যাব আমরা। ভেতরে গাড়ি নিয়ে ঢুকব, ভাব দেখাব যেন আকার্ডিয়া মারকাসের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। গেটের লোকের সঙ্গে কথা যা বলার আমি বলব। বলা হবে আমরা আফগানিস্তান থেকে আসছি। ভেতরে ঢোকার পর দেখা করতে চাইব চসেসা গনজালেসের সঙ্গে, মারকাসের অনুপস্থিতিতে সেই এখানকার সব কিছু দেখাশোনা করে।’

‘তোমাকে ওরা চিনে ফেলবে না তো?’ জানতে চাইল তারানা।

‘প্ল্যানটেশনের এরা কেউ আমাকে কখনও দেখেছে বলে মনে হয় না,’ জবাব দিল রানা। ‘অবশ্য চেহারার বর্ণনা পেলেও পেতে পারে। সামান্য কিছুটা ঝুঁকি, নিতে হবে।’

শোল্ডার পার্স খুলে নাক থ্যাবড়া একটা বেলজিয়ান রিভলভার বের করল তারানা, .২৫ ক্যালিবার। সিলিন্ডার চেক করে আবার সেটা পার্সে রেখে দিল সে। ‘সব ঠিকমতই ঘটবে, ইনশাল্লাহ।’

হেসে উঠে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল বাকারা, ‘এটা কোন ব্যাপারই না। বিপদ দেখলে সব ক’টাকে শুইয়ে দেব।’

Super User