বিকেলে কেব্‌ল্‌ কার-এ চড়ে কোরকোভাডো পাহাড়ে উঠল রানা। কোরকোভাডোর চূড়ায় যিশুর বিশাল এক স্ট্যাচু দাঁড়িয়ে আছে। কার থেকে নেমে সরাসরি অবজারভেশন প্যারাপিট-এ চলে এলো ও, দাঁড়াল ঠিক যেখানটায় দাঁড়াবার কথা হয়ে আছে। পাঁচ মিনিট পর আরেকটা কেব্‌ল কারে চড়ে পৌঁছাল হাসান। ওর পাশে দাঁড়িয়ে নিচের শহর, তারপর সারি সারি পাহাড় ও আরেক দিকে বিস্তৃত সাগরের দিকে হাত তুলল সে। ‘ভারি সুন্দর, তাই না, মাসুদ ভাই?’

‘হ্যাঁ,’ বলল রানা। ‘আর সব খবর কি?’

‘বিশেষ সুবিধের নয়, মাসুদ ভাই,’ জবাব দিল হাসান। ‘সোহেল ভাই গত মাসে বললেন, আকার্ডিয়া মারকাসের অ্যাকটিভিটি রেকর্ড করতে হবে। তার প্ল্যানটেশনের ওপর নজর রাখার ব্যবস্থা করলাম। খবর পেলাম এখন থেকে ছয় কি সাত হপ্তা আগে শেষবার তাকে প্ল্যানটেশনে দেখা গেছে। তারপর একটা গুজব কানে এলো, মারকাসকে মাদ্রিদে দেখা গেছে। সেই থেকে আমরা আর প্ল্যানটেশনে নজর রাখছি না।’

‘ওটা গুজব না-ও হতে পারে। মাদ্রিদ ফ্লাইট এথেন্স পর্যন্তও যেতে পারে।’

‘তা পারে।’

‘প্ল্যানটেশনে কি ঘটছে?’ জিজ্ঞেস করল রানা।

‘ওই প্ল্যানটেশনটাই মারকাসের আসল হেডকোয়ার্টার। এখানে, রিয়োয়, সেরবেরাস ইমপোর্ট-এক্সপোর্ট লিমিটেড নামে যে কোম্পানিটা আছে, এই কোম্পানির মাধ্যমে ড্রাগ ব্যবসাটা চালায় সে। সবাই জানে সে-ই মালিক, যদিও অফিসে প্রায় আসে না বললেই চলে। তবে পারাকাটুতে নিয়মিতই আসা-যাওয়া করত-অন্তত ছয় কি সাত হপ্তা আগে করত।’

‘প্ল্যানটেশনটা ওখানে- পারাকাটুতে?’

মাথা ঝাঁকাল হাসান। ‘ওদিকে একটা গ্রাম আছে ঠিকই, কিন্তু গোটা এলাকাটা আসলে ফাঁকা, জনবসতি নেই বললেই চলে। পাহারায় আছে সাবেক গেরিলারা, এখন যারা পেশাদার সৈনিক-মার্সেনারি। সেই সাথে মারকাসের ভক্ত কিছু পলিটিক্যাল ফ্যানাটিকও আছে। তবে সব মিলিয়ে সংখ্যায় তারা খুব বেশি হবে না।’

‘বেমানান কিছু চোখে পড়েছে তোমাদের?’

‘যদি জিজ্ঞেস করেন লোক জড়ো হচ্ছে কিনা, বা অস্ত্রের ভাণ্ডার গড়ে তুলছে কিনা, উত্তরে বলব-না। তবে একজন নতুন লোককে আমরা দেখেছি। ওরকম একটা জায়গায় লোকটাকে বেমানানই বলতে হবে।’

‘কেন?’

‘ওখানে যারা থাকে সবাই কাজের লোক। কেউ বসে বসে খায় না। কিন্তু এই লোকটাকে আমরা কেউ কোনও কাজ করতে দেখিনি।’

‘লোকটাকে কবে থেকে দেখছ ওখানে?’ জিজ্ঞেস করল রানা। ‘শুনেছি, দেখিনি; তিন মাস আগে মারকাসই নাকি সঙ্গে করে নিয়ে আসে ওকে। গত তিন হপ্তায় মাত্র একবার ঘরের বাইরে বেরিয়েছে সে, সঙ্গে দু’জন গার্ড ছিল। মাসুদ ভাই, আমার ধারণা লোকটা মারকাসের বন্দী।’

‘দেখতে কেমন? বয়স কত?’

‘আমরা তার ফটো তুলেছি, তবে অনেকটা দূর থেকে। বয়স, এই বাহানড়ব থেকে পঞ্চানড়ব, সবেমাত্র কপালের পাশে পাক ধরেছে চুলে। সব সময় সিল্কের শার্ট পরে, গ্রামের কয়েকজন লোক অন্তত তাই বলল।’

রানার মনে হলো, এই ভদ্রলোক গ্রীক শিপিং ম্যাগনেট ডাফু সালজুনাস হতে পারে। উল্টোপাল্টা রাজনৈতিক বিবৃতি দিয়ে এথেন্সের পরিস্থিতি গরম করার পর ব্রাজিলে এসে বন্ধু আকার্ডিয়া মারকাসের আতিথ্য গ্রহণ করেছে? নাকি বিবৃতিগুলো দেয়ইনি, এবং এখানে মারকাসের হাতে বন্দী হয়ে আছে?

হাসানের সঙ্গে জরুরী কয়েকটা কথা সেরে কোরকোভাডো পাহাড় থেকে নেমে এলো রানা। পাঁচটা বাজতে এখনও দেরি আছে, একটা ট্যাক্সি নিয়ে সোজা সেরবেরাস ইমপোর্ট-এক্সপোর্ট লিমিটেড কোম্পানির অফিসে চলে এলো ও। অফিস বিল্ডিংটা তিনতলা, ওপরতলায় সেরবেরাস। এলিভেটর কাজ করছে না, সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হলো। রিসেপশন হলে যে মেয়েটা বসে আছে, ওকে দেখেই কেমন যেন সজাগ হয়ে উঠল রানার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়।

‘বলুন, আপনার জন্যে কি করতে পারি।’ ভাষাটা পর্তুগীজ।

রানা ইংরেজি বলছে। ‘আমি মিস্টার মারকাসের সঙ্গে দেখা করতে চাই।’

মেয়েটার চোখ দুটো আরও সরু হয়ে গেল। ভাঙাভাঙা ইংরেজিতে বলল, ‘আমার বিশ্বাস আপনি ভুল জায়গায় চলে এসেছেন, সিনর।’

‘কি আশ্চর্য, তা কি করে হয়!’ রানাকে হতভম্ব দেখাচ্ছে।

‘মিস্টার মারকাস নিজে আমাকে বলেছেন সেরবেরাস ইমপোর্ট- এক্সপোর্ট অফিসের মাধ্যমে আমি তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারব।’

‘সিনর, এখানে মিস্টার মারকাসের কোন অফিস নেই…’

হঠাৎ একটা প্রাইভেট অফিসের দরজা খুলে রিসেপশনে বেরিয়ে এলো এক লোক-সুদর্শন, শক্ত-সমর্থ। ‘কোন জটিলতা?’ জানতে চাইল সে; কর্কশ সুর, প্রশেড়বর ভঙ্গিটা অমার্জিত ।

‘আমি মিস্টার মারকাসকে খুঁজছি।’ রানা হাসল।

‘কি জন্যে?’

ধমকের সুরে করা প্রশ্ন, গায়ে না মেখে রানা বলল, ‘মিস্টার মারকাস বলেছিলেন, এখানে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করলে পাইকারি দরে জাপানি ক্যামেরা কিনতে পারব আমি।’ এখন আবার হতভম্ব দেখাচ্ছে ওকে। ‘আমি কি সত্যি ভুল করে অন্য কোন অফিসে ঢুকে পড়েছি? এটা সেরবেরাস নয়?’

‘মিস্টার মারকাস হলেন বোর্ড চেয়ারম্যান,’ বলল লোকটা। ‘তবে এখানে তাঁর কোন অফিস নেই, কোম্পানির হয়ে তিনি কোন ব্যবসাও করেন না। কোম্পানির প্রেসিডেন্ট হলাম আমি। আপনি ইচ্ছে করলে আমার সঙ্গে আলাপ করতে পারেন।’

‘উনি সিনর কার্লোস মোলাডো,’ বলল মেয়েটা, গলার সুরে গর্ব বা দম্ভ কিছু একটা আছে।

‘পরিচিত হয়ে খুশি হলাম, সিনর,’ বলে ডান হাতটা বাড়াল রানা। লোকটা অনিচ্ছাসত্ত্বেও ধরল, ভঙ্গিটা আড়ষ্ট। ‘আমার নাম শেখ মাহাথির মাসুদ। চেরি’স রেস্টুরেন্টে হঠাৎই মিস্টার মারকাসের সঙ্গে দেখা ও পরিচয় হয় আমার বেশ কয়েক হপ্তা আগে। বলেছিলেন, প্রায় এরকম সময়েই ইউরোপ ট্যুর শেষ করে রিয়োতে ফিরবেন, তখন আমি তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারব।’

‘তিনি এখনও এথেন্সে,’ বলল মেয়েটা।

মেয়েটার দিকে চোখ গরম করে তাকাল কার্লোস মোলাডো, তারপর রানার দিকে ফিরে বলল, ‘আমি যেমন বলেছি, এখান থেকে মিস্টার মারকাসের সঙ্গে যোগাযোগ বা ব্যবসা করা যাবে না। তবে আপনার অর্ডার নিয়ে আমরা আলাপ করতে পারি।’

‘আচ্ছা! মানে, আমি আসলে সরাসরি মিস্টার মারকাসের সঙ্গে ব্যবসা করতে চেয়েছিলাম। আপনি বলতে পারেন, এথেন্স থেকে কবে তিনি ফিরবেন?’

কপালের পাশে মোলাডোর একটা শিরা কেঁপে উঠেই থেমে গেল। ‘আমাদের ধারণা ইউরোপ থেকে ফিরতে আরও অনেক দেরি হবে তাঁর, মিস্টার মাসুদ। ব্যবসা করতে চাইলে আপনাকে আমার সঙ্গে কথা বলতে হবে।’

এতক্ষণে হাসল রানা। ‘আমি যোগাযোগ করব, মিস্টার মোলাডো। সময় দেয়ার জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ।’

একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল ওরা, রিসেপশন থেকে বেরিয়ে এলো রানা। একটা ট্যাক্সি নিয়ে হোটেলে ফেরার পথে ভাবল, মেয়েটার অসতর্কতা অন্তত একটা ব্যাপারে নিশ্চিত হতে সাহায্য করেছে ওকে। কায়সার যেমনটি বলেছিল, আকার্ডিয়া মারকাস সত্যি ওই সময়ে এথেন্সে ছিল। এখন দেখতে হবে হাসানের ফটোটা বিলিওনেয়ার ডাফু সালজুনাসের সঙ্গে কিছুটা হলেও মেলে কিনা। যদি মেলে, অ্যাকশনে যেতে বেশি সময় নেবে না ও।

বাস ডিপোটা সেন্ট্রাল এভেনিডা-য়, হাসানের কথামত এগারো নম্বর ডাবল ডেকারে উঠে দোতলার বারো নম্বর সিটে বসল রানা। সিটের তলাটা হাতড়াতেই টেপ দিয়ে আটকানো এনভেলাপটা পাওয়া গেল। দুই স্টপেজ পর বাস থেকে নেমে ছোট একটা কাফেতে ঢুকল ও। কফির অর্ডার দিয়ে এনভেলাপটা খুলল।

অনেকক্ষণ ধরে দেখল রানা ফটোটা। টেলিফটো লেন্স ব্যবহার করা হলেও, ছবিটা ভাল ওঠেনি। ছবিতে তিনজন লোক দেখা যাচ্ছে, অযতেড়ব তৈরি একটা র‍্যাঞ্চ হাউস থেকে এই মাত্র বেরিয়ে হেঁটে আসছে ক্যামেরার দিকে। হাসান মাঝখানের লোকটার চেহারার বর্ণনা দিয়েছে রানাকে। দূর থেকে তোলা, মুখটা ছোট দেখাচ্ছে, তাসত্ত্বেও স্মৃতিতে ধারণ করা ডাফু সালজুনাসের চেহারার সঙ্গে এই লোকের হুবহু মিল দেখতে পাচ্ছে ও। বাকি দু’জনকে কখনও দেখেনি।

দুইজনের মাঝে গম্ভীর মুখে হাঁটছে সালজুনাস। তিনজনের কেউই কথা বলছে না, তবে বাঁ দিকের লোকটা এমন ভঙ্গিতে সালজুনাসের দিকে তাকিয়ে রয়েছে যেন এইমাত্র একটা প্রশ্ন করে উত্তর শোনার জন্যে অপেক্ষায় আছে সে। সালজুনাসের মাথাটা নিচে ঝুঁকে আছে, চেহারা থমথমে।

ফটোটা এনভেলাপে ভরে পকেটে রেখে দিল রানা। বুঝেছে, কায়সারের জার্নালিস্টিক অবজারভেশন নির্ভুল: যেভাবেই হোক ডাফু সালজুনাসের এথেন্স হেড অফিস দখল করে নিয়েছে আকার্ডিয়া মারকাস, এবং তারপর থেকে সালজুনাসের নামে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানোর চক্রান্ত করছে।

কফি শেষ করে ইন্টারকনে ফোন করল রানা, কথা বলল তারানার সঙ্গে। মেয়েটা যেন ওর ফোন পাবার অপেক্ষাতেই ছিল। রানার প্রশেড়বর উত্তরে জানাল, একঘেয়ে সময় কাটছে তার, ওর সঙ্গ দারুণ ভাল লাগবে। তার সঙ্গে সামান্য একটু তর্ক হয়েছে হাবিব বাকারার, তাই একাই সে একটা নাইটক্লাবে চলে গেছে। তারানাকে রানা সময় দিল রাত ন’টা।

ট্যাক্সি নিয়ে মেইন পোস্টঅফিসে চলে এলো ও। একটা বুদে ঢুকে ফোন করল ঢাকায়, সোহেলের নম্বরে।

কয়েকবার রিঙ হতে অপরপ্রান্ত থেকে কর্কশ গলার গালি ভেসে এল, ‘এই অসময়ে কোন্‌ শালা রে?’

‘আমি না হয়ে কলটা যদি বস্‌ করতেন?’

‘এই ফোনের নম্বর আমি শুধু আমার শালাদেরকেই দিই,’ ঘুম জড়ানো গলা সোহেলের। ‘বলে ফেল্‌, খবর কি?’

‘খবর হলো, পারাকাটুর কাছে মারকাসের প্ল্যানটেশনে বন্দী জীবন কাটাচ্ছেন ডাফু সালজুনাস। আমি এ-ও জানতে পেরেছি যে মারকাস এখন এথেন্সে।’

‘ইন্টারেস্টিং,’ মন্তব্য করল সোহেল। ‘তবে এ-সব আমাদের কাছে তেমন উত্তেজক কোন খবর নয়।’

‘আমি বলতে চাইছি কায়সারের ধারণা ঠিকই ছিল।’

‘কাজেই তুই এখন পারাকাটু যাচ্ছিস?’

‘হ্যাঁ। তবে একটা ঝামেলা দেখা দিয়েছে।’

‘ঝামেলা? তা প্রাণের বন্ধুকে বলতে অসুবিধে কি!’ সোহেলের গলায় বিদ্রূপ। ‘বিশেষ করে বন্ধুটি যখন চিরকাল তোর উপকার করার জন্যেই এই ধরাধামে এসেছে। শালা, ঝামেলার ওস্তাদ!’

হাসল রানা। ‘রিয়োয় পুরানো এক পি.আই.বি এজেন্টের সঙ্গে দেখা। জেরুজালেমে একটা অপারেশনে আমার সঙ্গে ছিল মেয়েটা।’

‘কে? তারানা আজিজ?’

‘হ্যাঁ।’

‘শালার কপাল! যেখানে যত সুন্দরী আছে তারা শুধু তোকেই দেখতে পায়? তারানাও তোর পিছু নিয়েছে?’

‘আমার নয়,’ বলল রানা। ‘সন্দেহ করছি, তারানা মারকাসের পিছু নিয়েছে। আবু ইসহাক ইমাম সালেহকে খুন করার জন্যে আমরা তো মারকাসকেই সন্দেহ করি, তাই না?’

‘হ্যাঁ, করি।’

‘তারানার সঙ্গে একজন এক্সিকিউশনার রয়েছে,’ বলল রানা।

‘আমার ধারণা মারকাসের খবর নিতে এসেছে। এই মুহূর্তে ওরা হয়তো জানে না যে মারকাস এখন এথেন্সে। কিন্তু আমি চাই না আমরা সবাই একই সময়ে প্ল্যানটেশনে গিয়ে ভুল বুঝে পরস্পরকে গুলি করে অপারেশনটার বারোটা বাজাই।’

‘তো আমি কি করতে পারি?’

‘তুই প্যালেস্টাইন ইন্টেলিজেন্সের সঙ্গে যোগাযোগ করে নিশ্চিত হতে পারিস তারানা আর বাকারার মিশনটা আসলে কি। তারানার চীফ মোমেনুর রাহমান তোর বন্ধু, সত্যি কথাটা তোকে অন্তত অবশ্যই জানাবে।’

‘তা হয়তো জানাবে,’ কয়েক সেকেন্ড ইতস্তত করার পর জবাব দিল সোহেল।

‘ঘটনা যদি তাই হয়, অর্থাৎ আমার আর তারানার মিশন যদি একই হয়, খোলা মন নিয়ে পরস্পরকে কিভাবে সাহায্য করা যায় তা নিয়ে কথা বলতে পারি আমরা। কিংবা অন্তত একে অন্যের পথে বাধা না হওয়ার চেষ্টা করতে পারি।’

এবার উত্তর দিতে আরও দেরি করল সোহেল। প্রায় চল্লিশ সেকেন্ড পর মুখ খুলল। ‘এ-ব্যাপারে আমি একা কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারব না। আমাকে বসের সঙ্গে আলাপ করতে হবে। তুই একটা নম্বর দে, আমি ফোন করে জানাব কতটুকু কি করতে পারব।’

খোলা লাইন নিরাপদ নয়, তবু বাধ্য হয়ে হিলটনের নম্বরই দিল রানা। ‘কথা বলবি বাংলাতেই, কারও পুরো নাম উচ্চারণ করবি না,’ সাবধান করে দিয়ে বলল ও।

হিলটনে ফিরল রানা। দেড় ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর প্রত্যাশিত ফোনটা এল। সবই ভাল খবর। সোহেলের মুখে সব কথা শোনার পর বিসিআই চীফ মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) রাহাত খান তাঁর অন্যতম দুর্ধর্ষ স্পাই এম.আর.নাইন-এর বর্তমান তৎপরতার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন, এবং ওর ব্যক্তিগত মিশনটাকে বিসিআই-এর একটা গুরুত্বপূর্ণ অ্যাসাইনমেন্ট হিসেবে অফিশিয়াল অনুমোদন দিয়েছেন। পি.আই.বি চীফের সঙ্গে কথা বলেছে সোহেলও। ইতিবাচক সাড়া দিয়েছেন মোমেনুর রাহমান। রানা এখন আকার্ডিয়া মারকাসের বিষয়ে তারানার সঙ্গে খোলাখুলি আলাপ করতে পারবে। প্রসঙ্গক্রমে জানা গেছে, বাকারা সঙ্গে থাকলেও অ্যাসাইনমেন্টটার নেতৃত্ব দিচ্ছে তারানাই। রানাকে একটা কোড ওয়ার্ড দেয়া হলো, শুনে তারানা বুঝতে পারবে তার বর্তমান কাজ সম্পর্কে ওর সঙ্গে আলাপ করার নির্দেশ দিয়েছেন চীফ মোমেনুর রাহমান।

ইন্টারকনে ন’টার কিছু পরে পৌঁছাল রানা। সেজেগুজে তৈরি হয়েই ছিল তারানা, ওকে দেখে মিষ্টি করে হাসল। নিচে নেমে এসে একটা ট্যাক্সি নিল ওরা। আগেই কথা হয়েছে, ওরা যদি একসঙ্গে ডিনার খায়, বিলটা তারানা মেটাবে। তাকে নিয়ে কোন ক্যাসিনো বা নাইট ক্লাবে যাবে রানা, ভাল লাগলে কিছুক্ষণ নাচবে দু’জন, কারও যদি ইচ্ছে হয় সে দু’এক ঢোক ড্রিঙ্কও করতে পারবে। সবশেষে, একঘেয়েমি কেটে গেলে, তারানাকে তার হোটেলে পৌঁছে দেবে রানা। পৌঁছে দেবে মানে শুধুই পৌঁছে দেবে।

ড্রাইভার আর প্যাসেঞ্জারদের মাঝখানে কাঁচের সাউন্ডপ্রূফ পার্টিশন আছে, বোতাম টিপে সেটা তুলল রানা, তারপর তারানাকে জিজ্ঞেস করল, ‘বাকারার খবর কি?’

তারানার চেহারা দেখে বোঝা গেল না প্রশ্নটা শুনে তার কি পঙতিক্রিয়া হলো। ‘কি খবর জানতে চাইছ?’ পাল্টা প্রশ্ন করল সে।

‘অত্যন্ত জেলাস মনে হলো। তোমরা কি খুব ঘনিষ্ঠ?’ হেসে ফেলল তারানা। ‘তুমি জানো, আমার চেয়ে তিন বছরের ছোট ও। সেটাও তেমন কোন ব্যাপার নয়। আসলে ওকে বোঝানোই যাচ্ছে না যে আমি একজনকে ভালবাসি।’

‘এখন আমি জেলাস ফিল করছি!’ হাসল রানা।

হেসে ফেলল তারানাও। তারপর বলল, ‘আমি আসলে এই অ্যাসাইনমেন্টে বাকারাকে সঙ্গে নিতে চাইনি, কিন্তু বার বার বলা সত্ত্বেও কর্তৃপক্ষ কথাটা কানে তুলল না। পিস্তল আর রাইফেলে ওর হাত খুব ভাল।’

‘তারমানে এই অ্যাসাইনমেন্টে ও থাকছেই।’

তারানা চিন্তিত, রানার দিকে তাকিয়ে আছে। ‘হ্যাঁ।’

‘তোমাদেরকে দেখেই আমি আন্দাজ করতে পারি ব্রাজিলে কেন এসেছ,’ বলল রানা। ‘বিসিআই হেডকোয়ার্টার থেকে তোমাদের রামাল্লায় যোগাযোগ করা হয়েছিল। আমার অনুমান সত্যি বলে জানা গেছে। কাজেই এখন আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে দেখতে পারি এই ব্যাপারে পরস্পরকে সাহায্য করার আদৌ কোন সুযোগ আছে কিনা।’

তারানার সবুজাভ চোখ দুটো একটু সরু হলো। ‘কিন্তু রানা, পি.আই.বি অফিস থেকে আমাকে বা বাকারাকে কিছুই জানানো হয়নি।’

‘কয়েক ঘণ্টার মধ্যে একটা ফ্যাক্স পাবে তুমি। তবে তার আগে আমাকে একটা কোড ওয়ার্ড ব্যবহার করতে বলা হয়েছে, ওটা শুনলে তুমি নাকি বুঝতে পারবে বিশ্বাস করে সব কথা বলা যায় আমাকে। শব্দটা হলো-বিসমিল্লাহ।’

অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল তারানা। ‘ওহ্‌, গড! দ্যাট ইজ দ্য রাইট ওয়ার্ড!’

‘তোমাদের চীফ পাঠিয়েছেন।’

এক মুহূর্ত চিন্তা করল তারানা। ‘ঠিক আছে, রানা। তবে তোমার সঙ্গে কতটা ফ্রী হওয়া যাবে, সেটা ফ্যাক্স না দেখে বলতে পারব না।’

রানা ধরেই নিয়েছে তারানা সাবধানে এগোবে। ফিল্ডে তার অভিজ্ঞতা খুব কম নয়। ‘বেশ। আমি তাহলে শুধু কয়েকটা আইডিয়ার কথা বলি তোমাকে। তোমার মুখ খোলার কোন প্রয়োজনই নেই।’

‘দ্যাট’স ফেয়ার।’

‘আমরা দু’জনই আকার্ডিয়া মারকাসকে খুঁজছি, উদ্দেশ্য একই তবে একই কারণে নয়,’ বলল রানা, দেখল তারানার চেহারায় কোন ভাব ফুটছে না। ‘তোমরা তাকে শাস্তি দিতে চাও আবু ইসহাক ইমাম সাহেলকে খুন করার অপরাধে। আমরা তাকে কেন খুঁজছি সেটা ব্যাখ্যা করা একটু কঠিন। ধরো, গ্রীসে একটা রক্তক্ষয়ী সামরিক অভ্যুত্থান ঘটতে যাচ্ছে। ধরো, ডাফু সালজুনাসকে কিডন্যাপ করা হয়েছে।’

‘গ্রীক শিপিং ম্যাগনেট?’

‘হ্যাঁ। তাঁকে হয়তো তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে পারাকাটুতে আটকে রাখা হয়েছে। কিন্তু মারকাস এথেন্সে, কাজেই সে না ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে তোমাদের। আর যদি ইউরোপে যেতে চাও, সেটা আলাদা কথা। কিন্তু আমার ধারণা, পারাকাটুতে গেলে এমন কিছু পেতে পারি, মারকাসকে ধরতে খুব সুবিধে হবে। ওখানে গিয়ে মিস্টার সালজুনাসের সঙ্গে কথা বলতে চাই আমি।

‘যদি আগ্রহ থাকে, আমার সঙ্গে পারাকাটুতে যেতে পারো তোমরা। ভেতরে ঢুকতে হলে, হয়তো গোলাগুলি করতে হতে পারে। ব্যাপারটা নিয়ে বাকারার সঙ্গে আলাপ করো তুমি, তারপর ফ্যাক্স পাবার পর কাল আমাকে জানাও কি করবে।’

‘আমরা যদি সত্যি মারকাসকেই ধরতে এসে থাকি, এখান থেকে সরাসরি এথেন্সে চলে যাওয়াটাই কি আমাদের জন্যে ভাল হয় না?’

‘মারকাস মিস্টার সালজুনাসের কোলোসস পেন্টহাউস দখল করে সেটাকে তার হেডকোয়ার্টার বানিয়েছে। সালজুনাসের ওই পেন্টহাউস নাকি আধুনিক একটা দুর্গ বিশেষ। তুমি আর বাকারা ছোট একটা টীম, ওখানে ঢুকতেই পারবে না। ওখানে ঢোকার গোপন কোন উপায় নিশ্চয়ই আছে। আর সেটা একমাত্র মিস্টার সালজুনাসেরই জানার কথা।’

রানার কথায় যুক্তি আছে, মাথা ঝাঁকিয়ে সেটা স্বীকারও করল তারানা, তবে বলল, ‘কাল তোমাকে জানাব, কেমন? এ-প্রসঙ্গের এখানেই ইতি। তুমি বরং বিস্তারিত শোনাও, আমাকে নিয়ে আজ রাতে তোমার প্ল্যানটা কি।’

‘প্ল্যানের আর থাকলটা কি! আদ্ধেকটাই তো বাদ করে দিলে। খেয়ে-দেয়ে তোমাকে ইন্টারকনে পৌঁছে দিয়ে বুড়ো আঙুলটা চুষতে চুষতে নিজের হোটেলে ফিরে যাব, এই হচ্ছে প্ল্যান।’

খিলখিল করে হাসল তারানা কিছুক্ষণ। চোখ বাঁকিয়ে চাইল রানার দিকে।

Super User